জন্মদিনের কেক


সেদিন মনজিনিস এ গেছিলাম । সকাল বেলা সারা রাতের ক্লান্তি আর খিদেতে চুই চুই কর পেট দুটো চিকেন স্যান্ডুইচ নিয়ে বসেছি ,বিশেষ তাড়া ছিল না সেদিন তাই এসি দোকানঘরে বসে একটু সময় নিয়েই খাচ্ছিলাম।

এমন সময় এক পিতা পুত্রের আগমন। পুত্র টি বড়জোর বছর পাঁচেক,সাথে শীর্ণকায় দারিদ্রক্লিষ্ট মজদুর বাবা। দোকানে ঢুকেই বিস্মিত ছেলেকে বললেন ," নে দ্যাখ এবার্। যা নিবি দ্যাখ"।
দোকানের সার্ভিস বয়দের ও চাউনি খুব একটা আপ্যায়ন সুলভ নয়। কিঞ্চিৎ গম্ভীর মুখেই তাকিয়ে ওই অনাহূত আগন্তুক এর দিকে। বেচারি বাবা টি এমনি ই ঘাবড়ে গেছে ,তারপর চেষ্টাকৃত স্মার্টনেস দেখাতে গিয়ে আরো গোলমাল করে ফেলছে। আর বাচ্চা ছেলেটির চোখে যেন গোটা গ্যালাক্সি। .,এত ঐশ্বর্য যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে থাকতে পারে ,সেটাই বোধহয় তার হিসেবেই বাইরে।

এরপর শুরু হলো বার্থডে কেক বাছাই করা। খুব সম্ভবত ছোট্ট ছেলের জন্মদিন বড়লোকদের মতো পালন করার ইচ্ছাতেই এই 'মনজিনিস ' এ আগমন। ছেলেটির তো সব কটি কেক ই পছন্দ ,,অনেক ঝাড়াই বাছাই করে একটা বাছাই ও হলো। কিন্তু মুশকিল হল অন্য জায়গায়।

.....লোকটি হাতের মুঠো মধ্যে দলা পাকানো ঠিক একটি একশো টাকার নোট। একটিই। আর কিচ্ছু নেই। হয়তো তার ধারণা ছিলো ১০০টাকা একটা গোটা কেক কেনার পক্ষে যথেষ্ট .,.হয়তো ওটা তার গোটা একদিনের রোজগার্। কিন্তু হা হতোস্মি ,..পছন্দের কেক তো নয় ই ,বরং হিসেব করে দেখা গেলো সবচেয়ে কমদামি ভ্যানিলা কেকটার ও দাম ১৬০ টাকা। এর কমে কোনো বার্থডে কেক হয় না। অসহায় বাবাটি অবান্তর কিছু তর্ক করল সার্ভিস বয়য়ের ছেলেগুলির সাথে। ছেলেগুলি উদাসীন ভঙ্গিতে পাত্তাই দিলো না।

আমি অনেক্ষন ধরে লক্ষ করছিলাম এই নরনারায়ণদুটিকে। ছেলের চোখ ছলছলে ,অপ্রস্তুত বাবার ছটফটানি, সব মিলে বড় অসহায় এক পরিস্থিতি। পায়ে পায়ে এগোলুম আমি । সসঙ্কোচে বললুম
"কিছু মনে করবেন না ,এই কেকটা আমায় কিনে দিতে দেবেন ওকে? "
"না দাদা লাগবে না। "
"দিন না কিনে দিতে ,না হয় ছেলেটার মুখ চেয়েই কিনে দিতে দিন? "
"বললাম তো লাগবে না। " ক্ষুব্ধ বাবার কড়া উত্তর্।
"তাহলে অন্তত ৬০টাকাই আমায় দিতে দিন ,যেটুকু কম পড়েছে? "
"নাআআআ। আমাদের লাগবে না। "

অসহায় সেই মানবশিশু বাবার আড়ালে দাড়িঁয়ে আমার দিকে করুন মুখে তাকিয়ে। ঝকঝকে দুই চোখে হাজার ওয়াটের আলো। কিন্তু নাহ। কিছুতেই বাবা গললো না। কেক কেনাও আর হলো না। এমন অভিজ্ঞতা অবশ্য আমার আগেও হয়েছে। ট্রেনে শ্রমিক মায়ের কোলে শীর্ণকায়া শিশুটি চিল চিতকার করে একটা কমলালেবু চেয়েছিল। আমার হাজার অনুরোধ উপরোধেও সেই মা আমায় কমলালেবু কিনে দিতে দেয়নি। নিজে তার বললে কিনে দিয়েছিল ২টাকার ঝুরিভাজা,তবুও আমায় দিতে দেয়নি।

বাবা-ছেলে চলেই যাচ্ছিল দোকান ছেড়ে। হঠাৎ কি মনে করে বাবা কাউন্টারের সামনে এলো। ভালো করে দাম দেখে দেখে ছেলেকে কিনে দিলো দুটো প্যাস্ট্রি আর কিছু চকলেটে ক্যান্ডি । সঙ্কুচিত ,ব্যর্থ বাবাটি দাম মেটাচ্ছেন ওই ১০০ টাকার হিসেবের মধ্যেই ,আর ছেলেটি পায়ে পায়ে এসে দাড়িয়েছে আমার পাশে। হঠাৎ দেখি আমার প্যান্টে ঈষৎ টান। দেখি পাশে দাড়িঁয়ে সেই দেবশিশু। সেই জ্বলজ্বলে কাচস্বচ্ছ চোখ। আমার ভারতবর্ষ ... আমার অপমানিত সত্তায় প্রলেপ দিচ্ছে নির্মল এক হাসি দিয়ে। .,দেখি হাতে গুঁজে দিলো একটি ক্যান্ডি । ওই সামান্য সম্ভারের থেকেও সে আমায় দিতে পারলো ? চোখে জল এসে গেলো আমার্। অবচেতন ভাবে হাত বাড়ালাম সেই পুন্যের দানে। এ জিনিস অস্বীকার করব ,এত স্পর্ধা আমার কই?

হায় রে ছেলে , তোকে আমি উপহার দিতে গেছিলাম ?...উল্টে তুইই আমায় দিয়ে দিলি? সারাজীবন ধরে হামলে পড়ে নিতে নিতে আমি তো ভুলেই গেছিলাম যে দিতে গেলেও কিছু যোগ্যতা লাগে। পকেটে টাকা থাকলেই দেওয়া যায় না।

এই আমার দেশ। সুজলা সুফলা জন্মভূমি। এখানে ভিখারীকে ভিক্ষা দিতে গেলেও প্রণাম করতে হয় ,কারণ সে আমায় দান করার সুযোগ করে দিয়েছে। এখনো হয়তো আমার অন্তর থেকে সেই প্রণাম আসেনি ,তাই বুঝি আমার দান গ্রহণ করলেন না আমার জীবনদেবতা।

বাবার হাত ধরে পরিপূর্ণ মনে বেরিয়ে যাচ্ছে আমার ছোট্ট ভারতবর্ষ ...মনে মনে বললুম তোকে উপহার দিতে আর পারলাম কই? বরং তোর দান ই হাত পেতে নিলাম। তবুও মনেপ্রাণে আশীর্বাদ করলাম অনেক অনেক বড়ো মানুষ হ।

Comments