হাজার তারার আলোয় ভরা চোখের তারা তু্ই স্বপ্ন দিয়ে সাজাই তোকে কান্না দিয়ে ধুই
মায়ের শরীরটা খারাপ ছিল তাই দুদিন ছুটি নিয়ে ছিলাম | শেয়ালদা থেকে ফিরছি অলস দুপুর তাই ট্রাম | ট্রামটা ইনকাম ট্যাক্স বিল্ডিং ওই সামনের সিগন্যালে দাঁড়িয়ে । সামনেই সেন্ট অগাস্টিন নামি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল | জাস্ট স্কুলটা ছুটি হয়েছে বোধহয় সামনে পার্ক করা কার এর জন্য রাস্তাটা জ্যাম | ট্রামটা দাঁড়ানো দেখে কিছু মায়েরা উঠলেন তাদের কচিকাচাদের নিয়ে | ট্রামটা বাচ্ছাদের কলকলানিতে যেন সজীব হয়ে উঠলো । কথা শুনে বুঝলাম সকলেই ক্লাস টুতে পড়ে । আজ রেজাল্ট ছিল , সকলেই ক্লাস থ্রী উঠেছে । বেশ লাগছিলো কল কল করে কথা বলে চলেছে ছেলেমেয়েগুলো ; কিছু বাচ্ছা আবার মায়ের ফোন নিয়ে গেমস খেলতে ব্যাস্ত হয়েগেল | আর একদিকে বাচ্চাদের মায়েরা নিজেদের মধ্যে কথোপকথনে ব্যাস্ত ; কিছু শোঅফ, কিছু পিনপিসি তাই ফেইসবুক ফিড স্ক্রল করছিলাম। হঠাৎ আওয়াজ তা বেড়ে যায়তে তাকালাম , ওদের কথা থেকেই বুঝলাম ওদের মধ্যে একটি ছেলে যার নাম অংকিত সে প্রথম হয়েছে । তার ওপর তার আবার আজ জন্মদিন । একে তো ভালো রেজাল্ট প্লাস জন্মদিন তাই ডাবল আনন্দ | তাই ট্রামের মধ্যেই শুরু হলো জন্মদিন পালন । প্রচুর চকোলেট আর মিষ্টি এই সামান্য উপকরন। যার জন্মদিন সে বাকি বন্ধুদের চকোলেট আর মিষ্টি দিতে লাগলো।
এরই মধ্যে ট্রামটা আবার দাঁড়ালো। সেখান থেকে উঠলো আর এক ছোট্ট ছেলে তার মায়ের সঙ্গে। পোশাক দেখে বোঝা যায় পৌরসভার স্কুলের ছাত্র। বয়সে ওই বাচ্চাগুলোর চেয়ে ছোটোই হবে। অতি যত্নে তেল দিয়ে পরিপাটি করে চুল আঁচড়ানো । পরনে স্কুল ড্রেস, পায়ে হাওয়াই চটি। মায়ের চেহারায় দারিদ্রতার ছাপ স্পষ্ট। ছেলেটি এতক্ষন জানালার বাইরে মুখ বাড়িয়ে ছিল বলে নজর পড়েনি । এবার মায়ের বারণ শুনে সে এদিকে ঘুরে বসে। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া বাচ্চাগুলোর উল্টো দিকেই বসেছে ওরা। এবার ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করলো উল্টোদিকের বাচ্চাদের হাতের রংবেরঙের চকলেটের মোড়কগুলো । ছেলেটির মা নানা রকম ভাবে ভোলানোর চেষ্টা করে চলেছে । আমি অবাক হয়ে দেখছি উল্টো দিকে বসা আধুনিক ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া বাচ্চাদের মায়েদের । অনেকে বাচ্ছার মায়ের দৃষ্টি ওই ছোট্ট ছেলেটির উপর পড়লেও কেউ এগিয়ে একটা চকলেটে বা মিষ্টি দিলেন না । কী নির্বিকার ভাবে উৎসব পালন করে চলেছেন তারা ! অবাক পৃথিবী অবাক করলে তুমি !!!! আচ্ছা একটা চকোলেটও কী এই বাচ্চা ছেলেটার হাতে দেওয়া যেত না ! ওনারাও তো বাচ্চার মা ! আমি নিজের ব্যাগটা আতিপাতি করে খুঁজলাম , যদি দু একটা ক্যান্ডি কিম্বা এনার্জি বার যদি থাকে ..... অনেক সময় রাখি রাতে ডেস্ক এ বসে খাবার জন্য কিন্তু না সেদিন ছিল না । ছোটো ছেলেটির স্বতৃষ্ণ দৃষ্টি আমাকে যেন প্রশ্ন করছে এ কোন সভ্যতা আর এ কেমন মাতৃত্ব ; কেমন এই সোশ্যাল ক্লাস বাউন্ডারি এ কোন স্বার্থপরতার শিক্ষা আমরা দিচ্ছি নেক্সট জেনারেশনকে | জানলার দিকে মুখ ফেরালাম ,হঠাত করে রাস্তাটা লম্বা মনে হতে লাগলো |
এর মধ্যে ট্রামটা এসে দাঁড়িয়েছে বেকবাগান মোরে ;এক লজেন্সওয়ালা উঠলো | লজেন্সওয়ালার কাছ থেকে দুটো লাল সবুজ রঙের লজেন্স কিনে দিল ছেলেটির হাতে দিলো ছেলেটির মা । ছেলেটির দু'চোখে আনন্দ ঝিলমিল করে উঠলো। শান্তি পেলাম কিছুটা আমি । ইংলিশ মিডিয়ামের ছেলেমেয়েদের নামার সময় হতে তারা উঠে এগিয়ে গেলো দরজার কাছে । হঠাৎ করে যার জন্মদিন সেই অঙ্কিতের মায়ের বোধহয় ঘুমন্ত মানবিকতা বোধ জেগে উঠলো!!!!! নাহ !! বোধহয় একটা চকোলেট বেশি হয়েগেছিল ? সেটা বুঝতে পারলাম না, চোখে একটু অবজ্ঞা নিয়ে নামার সময় একটা চকোলেট বাড়িয়ে দিলেন ওই পৌরসভার স্কুলের ছেলেটির দিকে । আমি দেখলাম ছেলেটি একবার তাকালো দামী চকোলেটটার দিকে । আর একবার সে তাকাল তার মায়ের দিকে । সেই ছোট্ট ছেলেটি মায়ের চোখে কী দেখলো সেই জানে ! কিন্তু তখন অঙ্কিতের মায়ের চোখে মুখে ফুটে উঠেছে অহংকার ..... সে অহংকার কিসের ঠিক বুঝতে পারলাম না আমি, অর্থের ?নাকি সন্তানের সফলতার? না মেকি সোশ্যাল স্ট্যাটাসের ! যারই হোক বেশিক্ষণ তার স্থায়িত্ব রইলনা । ছোট্ট ছেলেটি , যার বাবা মা খুব গরীব , হয়তো এত দামী চকোলেট কিনে দেওয়ার ক্ষমতা তাদের নেই , তাকে পড়তে হয় সাধারণ পুরসভার স্কুলে , সেই ছেলেটি কত অনায়াসে ফিরিয়ে দিলো অঙ্কিতের মায়ের অহংকার । ছোট্ট মুখটা সরল হাসিতে উদ্ভাসিত করে বললো "আমার কাছে আছে তো , এই দেখ ! দুটো... একটা আমার আর একটা ভাইয়ের ... আমার লাগবেনা ।" নির্দিষ্ট স্থানে নেমে গেলো অঙ্কিত আর তার বন্ধুরা । আমি উঠে দাঁড়ালাম , নামতে হবে সামনেই । নামার আগে ছেলেটির গালটা টিপে নাম জিজ্ঞেস করলাম , বললো "অর্ঘয " । চলে গেল ছোট্ট "অর্ঘয " দুটো স্টপেজের পর আমিও নামলাম বুকে একরাশ প্রশ্ন নিয়ে |
বড়ো শিক্ষা দিয়ে গেলো ছোট্ট ছেলেটা আত্মমর্যাদের শিক্ষা আরো একটা জিনিস বুজলাম আধুনিক মায়েরা ছেলেমেয়ের মানুষ করতে গিয়ে প্রথম যে শিক্ষাটা দিচ্ছেন তা হলো স্বার্থপরতার শিক্ষা | জীবনটা বড়ো আর্থসামাজিক প্রয়োজনে কম বেশি আমরা নিজেরটুকু দেখার প্রাক্টিক্যালিটিকে অস্বীকার করতে পারিনা তাই নিজের ভালোভাবাকে আমি স্বার্থপরতার নাম দিচ্ছি না | সহমর্মিতার অভাব নিজের ভালো দেখতে গিয়ে আসেপাশের মানুষ , আমাদের প্রিয় মানুষদের অনুভূতি বা ভালো থাকার অধিকারকে হরণ করা আমার কাছে স্বার্থপরতা | তাই ছেলে বড়ো হয়ে যদি বাবা মায়ের থেকে দূরে হয়ে যায় বা তাদের ওল্ড এইজ হোম পাঠিয়ে দেয় প্রথম দোষ আমরা দিয়ে থাকি ছেলে বা ছেলের বৌকে | নিজেরা যে তাদের ছোট থেকে স্বার্থপর হতে শিখিয়েছি সেই ভুল শিক্ষার দায়ত্বিটা কে নেবে |
আমি নিজে এক মায়ের সন্তান তও বলছি লাইফ ইস এ মিরর| স্বার্থপরতার বিষ সন্তান এর মধ্যে পুতলে সে বিষএর প্রথম শিকার হবেন আপনি নিজে |
Comments
Post a Comment