আঠেরো বছর
যেটা জানিস না সেটা নিয়ে তর্ক করিস না। তোর কাছে ডক্টর অরুন্ধতী সেন ভগবান হতেই পারেন, কারণ তোর মাকে উনি এখন বাঁচিয়ে দিয়েছেন বলে তোর ধারণা হয়েছে। কিন্তু আমার কাছে নয়। তাই আমার কাছে ফালতু জ্ঞান মারতে আসিস না বস। তাছাড়া আই অ্যাম নট অ্যান ইনোসেন্ট চাইল্ড। আমার বয়সটাও আঠেরো হলো রে। অ্যাডাল্ট শব্দটা এখন আমার পাশে আমি বসাতেই পারি। তুই বরং ধ্রুবজ্যোতি সেন সম্পর্কে বল, আমি উত্তর দেবো। দেখ স্কুল টিচার ঠিকই,তবে ভগবান হতেও চায়না। মানুষটা অন্তত মাটিতে পা ফেলে চলে জানিস? আমার বাবা বলে বলছি না, মানুষটাকে বরাবর দেখেছি, সব দিকে নজর। উদাসীনতার মধ্যেও কর্তব্যটুকু করতে ভোলে না। সেই ছোট থেকে আমার সব কিছুতে খেয়াল রেখেছে। আর তোদের চোখের গ্রেট ডক্টর অরুন্ধতী সেন, সে তো নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। আরে যে নিজের সন্তানকে মিনিমাম টাইমটুকু দিতে পারেন না তার আবার মায়া-দয়া! কথাগুলো বেশ চিবিয়ে চিবিয়ে বলছিলো শ্রেয়। ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে ক্ষীণ প্রতিবাদ করার চেষ্টা করছিল ওর বেস্টফ্রেন্ড ডোনা।
আরেকবার বললো, তুই ভাবতে পারছিস না শ্রেয়, আন্টি আমাদের বিপদে কিভাবে পাশে দাঁড়িয়েছেন। তুই তো জানিস, পাপা এখন আসামে পোস্টেড। আমি একা গত পরশু মাকে নিয়ে গ্রিনল্যান্ডে গিয়েছিলাম। যেতেই আন্টির মুখোমুখি। আন্টি আমায় দেখেই নিজের মেয়ের মতই বললেন, কি হয়েছে ডোনা? ততক্ষনে আমার ছোট মামা এসে পৌঁছেছে। আন্টি কিছুটা রিস্ক নিয়েই মায়ের ওই কন্ডিশনে হিস্টারেকটমি করেছেন। যে ডক্টর মাকে দেখছিলেন, তিনি তো কেয়ারলেসের মত অপারেট না করে বিদেশে চলে গেলেন। যাইহোক মা এখন ঠিক আছে। যাই বলিস না কেন, আন্টির হাতে ছুরি কাঁচি কথা বলে রে! এমনকি আমাকে ডেকে বলেছেন, ডোনা তুমি তো শ্রেয়র ফেন্ড, আমার মেয়ের মত। কোন রকম প্রবলেমে পড়লে কল করো। আজ বুঝতে পারছি, কেন লোকে ডক্টর অরুন্ধতী সেনের নাম শুনলে কপালে হাত ঠেকায়। জানিস শ্রেয়, আমি যখন আগে তোর বার্থ ডে তে তোদের বাড়ি যেতাম, তখন আমার আন্টিকে দেখে ভয় ভয় করতো। কিন্তু এই তিনদিন ওনাকে দেখে মনে হচ্ছে, আমার মায়ের সাথে ওনার কোনো তফাৎ নেই। তারপর জানিস, উনি আমাদের কাছ থেকে ফিজ নেন নি। বলেছেন, শ্রেয়র ফ্রেন্ডের মা এর অপারেশন করে ফিজ নিলে, আমার ছেলেটা রাগ করবে যে! আমরা শুধু নার্সিংহোমের টাকাটা দিয়েছি। মাকে আর তিনদিনের মধ্যে রিলিজও করে দেবে। আন্টি না থাকলে যে কি হতো...
শ্রেয় চিৎকার করে বললো, বুলশিট!
ডোনা, তোর মা তোকে ছোটবেলায় গল্প বলে খাইয়ে দিয়েছে, এখনো কষ্ট হলে তুই তোর মায়ের বুকে মুখ গুঁজে কাঁদতে পারিস। তাই এত বড় বড় লেকচার মারছিস। আর আমি তো অবাক হয়ে যাচ্ছি, তুই আমার নার্সারির ফ্রেন্ড হয়েও, সবটা জেনেও হঠাৎ অরুন্ধতী সেনের পক্ষ নিয়ে লড়তে এসেছিস?
কাকিমার অপারেশনের ফিজ দিতে গিয়েছিলিস, ব্যাস ল্যাটা চুকে গেল। নেয়নি সেটাতে তোদের কোনো দায়িত্বও নেই। এত গ্রেটফুল কেন হয়ে গেলি সেটাই তো বুঝতে পারলাম না।
ডোনা আরেকটা কি বলতে যাচ্ছিলো, তার আগেই শ্রেয় বললো, যদি অরুন্ধতী সেনের নামে প্রশংসা করার জন্য আমাকে ফোন করে থাকিস, তাহলে প্লিজ ফোনটা আমি কাটছি। আরেকটা কথা, আমার মনে হয় সব বন্ধুত্বেই কিছু বন্ডিং থাকাটা জরুরি। আমার ছোটবেলা থেকে সবটা জানার পর, যখন তুই একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে যেতে পারিস, তখন আমাদের ফ্রেন্ডশিপের ব্রেকআপ প্রয়োজন। ডোনা থমকে গিয়ে বলল, এত বড় কথাটা তুই বলতে পারলি শ্রেয়? মা এখনো নার্সিংহোমে, এখন তুই এভাবে... বেশ, তাহলে তাই হোক। তোর যদি আমাকে প্রয়োজন না হয়, তাহলে আমারও নেই। ফোনটা কট করে কেটে দিলো ডোনা।
সামনে খুলে রাখা ফিজিক্সের বইটা বন্ধ করে দিয়ে অরিজিৎ সিংয়ের স্যাড সং এ মন দিলো শ্রেয়।
আর মনে মনে বললো, অরিজিৎ বোধহয় ওর জন্যই এই গানগুলো গেয়েছে। ওর মত নিতান্ত অবহেলিত একাকী মানুষের জন্যই এই গানগুলোর সৃষ্টি। ইদানিং শ্রেয়র বন্ধুর সংখ্যা কমতে কমতে তলানিতে এসে ঠেকেছিলো। ডোনা তাও ঝগড়া ঝাঁটি করে টিকে ছিল। ওর কাছে অন্তত মনের কথা শেয়ার করা যেত। বন্ধুরা বলে ডোনার নাকি আলাদা সফ্ট কর্নার আছে শ্রেয়র প্রতি। যদিও শ্রেয় ডোনার ব্যবহারে নির্ভেজাল বন্ধুত্ব ছাড়া আর কিছু দেখেনি এতগুলো বছরে।
জেন্ডার আলাদা হলেই আজও লোকের চোখে বন্ধুত্বটা একটু ইঙ্গিতপূর্ণ হয়ে যায়, তবুও ডোনা আর ওর মধ্যে কখনো কোনো প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়নি। অথচ ওরা জানে ওদের দুজনের মধ্যে অনেক অমিল থাকা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখবে ওদের বন্ধুত্বটাকে। অবসরে ফোন, টিউশন থেকে ফেরার পথে একটু গল্প...কিন্তু অরুন্ধতী সেনের তো সেটাও সহ্য হলো না। যথারীতি নিজের ডাক্তারি ইমেজকে কাজে লাগিয়ে ডোনাদের ফ্যামিলির সবার চোখে পুরো মহীয়সী হয়ে গেলেন।
ডোনাদের বাড়িতে ছোট থেকেই শ্রেয়র যাতায়াত আছে। ডোনার মা ভালোমন্দ রান্না করলেই শ্রেয়র নিমন্ত্রণ থাকে। এখন সে জায়গাটাও দায়িত্ব নিয়ে শেষ করে দিলেন ওর গ্রেট মাদার। শ্রেয় বেশ বুঝতে পারছে, এর পিছনে মায়ের একটা গভীর চক্রান্ত আছে। মা চায় শ্রেয়কে সম্পূর্ণ একা করে দিতে! ও যাতে মনের কথা কোথাও না বলতে পেরে হেরে গিয়ে মায়ের কাছে আত্মসমর্পণ করে। নিজের ওপরেই ঘৃণা হচ্ছে শ্রেয়র, ও কেন এমন মায়ের সন্তান হলো? এর থেকে ও যেকোনো হাউজ ওয়াইফের ছেলে হলে, বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা তিলে তিলে মরে যেত না অন্তত। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে মায়ের হাসি মুখটা দেখতে পেত, বা স্কুল বাসের সামনে দাঁড়িয়ে মায়ের হাত নাড়া, অথবা বাসটা ছেড়ে যাওয়ার সময় চিৎকার করে মা বলতো, দুষ্টুমি করিস না! অন্যান্য মায়েদের মত বাড়ি ফিরলেই আঁচল দিয়ে মুখটা মুছিয়ে বলতো, সব পড়া পেরেছিলিস?
না, এসব কিছুই পায়নি শ্রেয় জন্মে থেকে। কারণ শ্রেয় একজন সেলিব্রিটি সাকসেসফুল ডক্টরের সন্তান কিনা! ও তো বছর তিনেক পর্যন্ত যমুনা মাসিকেই মা মনে করতো। কারণ ঘুম চোখে আর ঘুম ভাঙা চোখে ওর মুখটাই দেখতো। মাঝে মাঝে দেখতো, একটা খুব ব্যস্ত মহিলা কপালে হামি খেয়ে বলছে, গুড বয় হয়ে থেকো। যমুনা মাসিকে একদম বিরক্ত করো না। ভোরে ঘুম ভেঙেই দেখতো ওই মহিলা খুব ব্যস্ত হয়ে কাউকে একটা ফোনে বলছে, সে কি কাল যখন অপারেট করলাম তখন তো বি পি ঠিকই ছিল, তারপর হাই হলো কখন? ওকে, আই অ্যাম কামিং সুন।
মহিলা বেশ ব্যস্ত হয়ে রিস্ট ওয়াচটা পরে, বাবার দিকে তাকিয়ে বলতো, শ্রেয়কে একটু খেয়াল রেখো। আমার একটা ইমার্জেন্সি এসে গেছে। খুব ছোট থেকেই ইমার্জেন্সি কথাটার মানে বুঝে গিয়েছিল শ্রেয়। বুঝেছিল, ওই শব্দটার মানে এই মহিলা সারাদিনের জন্য গায়েব হয়ে যাওয়া। বাবাই ঘুম থেকে উঠিয়ে ব্রাশ করিয়ে দিতো ওকে। তারপর যমুনা মাসি এসে ওকে ব্রেকফাস্ট করিয়ে দিতো।
বাবাও মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতো, অরুন্ধতী, ছেলেটা তোমায় তো ভালো করে চিনছেই না। এবারে একটু কাজের প্রেসার কমাও তুমি। অরুন্ধতী সেন হালকা গলায় বলতো, যাদের মায়েরা বিজি থাকে, তাদের ছেলেরা কি মায়েদের চেনে না? অন্তরের টান, রক্তের টান বলেও তো একটা কথা আছে! শ্রেয় বড় হলেই বুঝতে পারবে তার মা কতটা নিরুপায় আর সেই জন্যই তাকে সাফিসিয়েন্ট টাইম দিতে পারেনা! কিন্তু তাই বলে ভালোবাসে না তা তো নয়?
শ্রেয় বুঝেছিল, মা একজন নামি ডক্টর। নামকরা সার্জেন। তার হাতে নাকি ছুরি-কাঁচি কথা বলে। ভগবানের পরেই রুগীরা তাকে স্থান দিয়েছেন। এত কিছু জানার পরও ওই মানুষটাকে নূন্যতম সম্মান করতে পারেনি ও নিজে। বরং স্কুল টিচার ধ্রুবজ্যোতি সেনকে ও অনেক রেসপেক্ট করে।
বাবা গম্ভীর মানুষ হলেও শ্রেয়র রেজাল্ট দেখেছে সময় মত। পেরেন্টস মিটিং অ্যাটেন্ড করেছে। তাই বাবার প্রতি শ্রেয়র একটা সূক্ষ্ম অনুভূতি কাজ করে। মানুষটা কম কথা বলা গম্ভীর মানুষ হলে কি হবে, কর্তব্যটুকু অন্তত করে। অরুন্ধতী সেনের মত স্বার্থপর নয়। শুধু নিজের নাম-যশ, রেপুটেশন নিয়ে ব্যস্ত নয়।
আই পি এল টা চালালো শ্রেয়। ও নিজে কে.কে.আর এর ভক্ত। কিন্ত ডোনা আবার দাদা পাগলা পাবলিক। যেদিন থেকে সৌরভ গাঙ্গুলি কে.কে.আর ছেড়েছে, সেদিন থেকে ডোনা মনে মনে চায় কে.কে.আর হারুক। নেহাত শ্রেয়র সামনে তেমন বলতে পারেনা সেটাই।
আজ দিল্লি জিতছে দেখে আরেকবার ডোনার মুখটা মনে পড়লো। এতক্ষনে বার দুয়েক ফোন করে বলতো, দেখলি দাদাকে দেখাচ্ছে। কি অ্যাটি দেখলি? শ্রেয় রেগে গিয়ে বলতো, থাম তো, তুই তো এমন বলছিস যেন ব্যাটটা দাদাই চালাচ্ছে। এই নিয়ে দুজনের বেশ কিছুক্ষণ খুনসুটি চলতো। আই পি এলের আসল ফ্লেভারটা আজ মিসিং। ডোনাকে লেগপুল করা হলো না গাঙ্গুলীকে নিয়ে। শ্রেয় নিজে সচিনের ফ্যান ছিল। দাদাকে ওর মন্দ লাগতো না। কিন্তু ডোনার মত অমন অন্ধ ভক্ত নয়।
বার দুয়েক ডোনার নম্বরে কল করেও রিং হবার আগেই কেটে দিলো।
সব থেকে বিরক্ত লেগেছে শ্রেয়র, আন্টির অপারেশনের সময় ডোনা ওকেও তো ডাকতে পারতো। আরে কলকাতা শহরে কি নার্সিংহোমের আকাল চলছে নাকি, যে অরুন্ধতী সেনের আন্ডারে ভর্তি করতে হবে! ডোনা শ্রেয়কে খবরটা দিলো কখন, ওর মায়ের অপারেশন হয়ে যাবার পরে! ওকে এতটা আন্ডারএস্টিমেট কেন করে ডোনা! এখন তো আবার ডক্টর অরুন্ধতী সেনের নামে প্রশংসা শুরু করেছে। শ্রেয়কে স্কুলেও সবাই বেশ হিংসার চোখে দেখতো। সাধারণের থেকে আলাদা ভাবতো বন্ধুরা। সেটাও শুধুমাত্র ওই বিখ্যাত মহিলার জন্য। আজ ওর একমাত্র কাছের বন্ধুর মনেও নিজের চিরস্থায়ী জায়গা করে নিলো মহিলা। আর সেটা করলো শ্রেয়কে জাস্ট ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে। সবাই বলে মা শব্দের মধ্যেই নাকি মায়া শব্দটা লুকিয়ে থাকে। কিন্তু শ্রেয়র অভিজ্ঞতা বলে, মা শব্দের মধ্যে লুকিয়ে আছে, স্বার্থপরতা, অহংকার, অবজ্ঞা।
অসহ্য একটা কষ্ট দলা পাকিয়ে আসছে ওর কণ্ঠনালীর কাছে। আই পি এলের উত্তেজনা ফিকে হয়ে যাচ্ছে সেখানে।
ওর স্কুলের বন্ধু রক্তিম একদিন বলেছিল, আমরা এক ক্লাসে বসি ঠিকই কথাই, হয়তো টিফিন ভাগ করেও খাই, কিন্তু আমার বাবা বলেছে, তোর মায়ের দুটো অপারেশনের টাকায় আমাদের গোটা মাসের সংসার খরচ চলে যায়। তাই বুঝলি শ্রেয়, তুই আমার বন্ধু হতে পারিস না। সেদিন ঘরে ফিরে বালিশ আঁকড়ে খুব কেঁদেছিল ক্লাস নাইনের ছেলেটা।
সেদিনও বাবা নিজের বইয়ের জগতে ব্যস্ত ছিল। মাঝরাতে ওদের বাড়ির দরজা খুলেছিল একটা গাড়ির হর্নএর আওয়াজ শুনে। নির্ঘুম রাতে শুনেছিল মা নামক ওই মহিলার জুতোর হিলের শব্দ। ততক্ষনে শ্রেয়র চোখের জল শুকিয়ে গিয়ে গালে একটা হালকা রেখা রেখে গিয়েছিল মাত্র। ওই মহিলার পায়ের আওয়াজ পেয়েই মধ্যরাতে গোটা বাড়ি কাঁপিয়ে নিজের ঘরের দরজা আটকে দিয়েছিল শ্রেয়। মহিলা একটু থমকে দাঁড়িয়ে বলেছিল, অসভ্যতামি করবে না। মাঝরাতে এত জোরে আওয়াজ করাটা বেয়াদপি! ঘরের ভিতরে বসেই ও শুনেছিল কথাটা। সেদিন থেকেই ঠিক করেছিল, মিসেস অরুন্ধতী সেনের অপছন্দের জিনিসগুলো ওকে খুঁজে বের করতে হবে। এবং নিখুঁত ভাবে করতে হবে সেগুলোকে। রুটিন করে বিরক্ত করতে হবে ওই মা নামধারী মহিলাকে।
খুব রেয়ার ছুটির দিনে যখন তিনজনে একসাথে ডিনারে বসত, তখন শ্রেয় ইচ্ছে করেই জলের গ্লাসটা ঠক করে টেবিলে রাখতো, বা উল্টে দিতো। খেতে খেতে পা দুটো তুলে দিতো চেয়ারে। অথবা চিকেনের বাটিতে এঁটো হাত দিয়ে তুলে নিতো লেগ পিসটা। মা নামক অহংকারী ব্যক্তিটি বিরক্ত মুখে তাকিয়ে বলতো, বড় হচ্ছ, মিনিমাম সভ্যতাটুকু আশা করি তোমার কাছে! বাবার দিকে তাকিয়ে মহিলা বলতো, ধ্রুব আমি সারাদিন ব্যস্ত থাকি। তুমি তো জানো আমার প্রেসারটা। তুমি অন্তত ওকে একটু এটিকেট শেখাও প্লিজ।
বাবা অসহায় গলায় বলতো, অন্য দিন এমন করেনা তো। শুধু তোমাকে দেখলেই এগুলো করতে দেখি।
অরুন্ধতী সেন রেগে গিয়ে নিজের টেবিল ছেড়ে দাঁড়িয়ে বলতো, যমুনা আমার খাবারটা আমার রুমে পাঠিয়ে দিও।
এই ভাবেই নিজের অবহেলার প্রতিশোধ তুলে চলেছে শ্রেয়। চূড়ান্ত প্রতিশোধটা নিয়েছিল মাধ্যমিকের রেজাল্টের পর। মায়ের পছন্দের নামি স্কুলে ভর্তি না হয়ে ভর্তি হয়েছিল একটা মিডিওকার স্কুলে। পড়াশোনায় ভালো হলেও অরুন্ধতী সেনের ছেলে ওই স্কুলে পড়বে এটা হয়তো ভাবতে পারেনি মহিলা। তাই বাড়িতে ঢুকেই বাবার দিকে তাকিয়ে বলতো, এগুলো তোমার প্রশ্রয়ে হচ্ছে ধ্রুব। আমরা যখন ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম, তখন শর্তই ছিল, যেহেতু আমার পেশা ডাক্তারি তাই তুমি সন্তান মানুষের কিছুটা দায়িত্ব অন্তত নেবে! এখন তো দেখছি তুমি ওকে একটাই জিনিস শেখাচ্ছ, ও কি করে আমাকে অমান্য করবে! আমার বলা কথাগুলো নস্যাৎ করে দিয়েই তো ওর সবচেয়ে বেশি আনন্দ। বাবা নরম গলায় বলেছিল, স্কুলটা হাইফাই নয় ঠিকই কিন্তু এই স্কুলে কি পড়াশোনা হয়না? শুনলাম রেজাল্ট বেশ ভালোই হয় এই স্কুলে।
মহিলা বেশ রাগী গলায় বলেছিল, আমি তবে দিনরাত খেটে ইনকাম করছি কার জন্য! ও ভালো স্কুলে পড়বে, ভালোভাবে মানুষ হবে সেই জন্যই না!
বাবা মুখটা নিচু করে বলতো, বড় হচ্ছে, ওর ইচ্ছে অনিচ্ছের মূল্যটাও তো দিতে হবে! মহিলা হিসহিসে গলায় বলতো, তোমরা আমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছো ধ্রুব। ধ্রুবজ্যোতি সেন উত্তেজনাহীন শান্ত গলায় বলতো, তাতে কি আমার কোনো প্রফিট হবে অরুন্ধতী? আগেই বলেছিলাম, ছেলেটা বড় হয়ে যাচ্ছে, তুমি যে ওর মা, সেটা ও বুঝতেই পারছে না। তখন তো আমার কথায় গুরুত্ব দাওনি।
মহিলা কান্না ভেজা গলায় বলেছে, তোমার কি মনে হয় ধ্রুব, একজন ডক্টরের জীবন তার নিজের মত পরিচালিত হয়? আমি নিরুপায়, তাই বলে তোমরা সুযোগ নেবে? আর পাঁচটা মায়ের মত সন্তানকে সময় দিতে আমি তো কোনোদিনই পারবো না। সেই জন্য শ্রেয় আমায় অস্বীকার করবে?
মারাত্মক আনন্দে ভিতরের জ্বালাটা কমে যেত শ্রেয়র। যাক ওই মহিলার একটা ইচ্ছেতে অন্তত ছাই দিতে পেরেছে শ্রেয়, এই আনন্দেই বদ্ধ ঘরের মধ্যে দুবার লাফিয়ে নিতো ও।
একই বাড়িতে থেকে একটা অঘোষিত যুদ্ধ শুরু করেছিল শ্রেয় ওই অহংকারী মহিলার সাথে।
মনে মনে ভেবেই নিয়েছিল, কিছুতেই অরুন্ধতী সেনকে জিততে দেবেনা ও। বাইরের মানুষের চোখে যে নিজেকে ভগবানের আসনে বসিয়েছে, তাকেই মাটিতে মিশিয়ে দেবে শ্রেয়। সেটা একদিন বেশ জোর গলায় বলেওছিলো শ্রেয়।
পরিষ্কার গলায় বলেছিল, তুমি আমার মা নও। শুধু গর্ভে ধারণ করলেই কেউ মা হয়না মিসেস সেন। আমি কোনদিন তোমায় মা বলে মনেই করিনা। তাই আমার ওপরে নিজের কোনোরকম শাসন চালাতে আসবে না। সেদিন থেকেই একই ছাদের নিচে থেকেও দুজনের মুখ দেখা দেখি প্রায় বন্ধ।
এই অবস্থায় শ্রেয়কে যখন ডোনার কাছ থেকে ওই মহিলার প্রশংসা শুনতে হয়, তখন আর মেজাজ ধরে রাখতে পারেনা ও। ডোনা ওর একটা নিশ্চিন্তের জায়গা। মনের মধ্যে যে কষ্টগুলো বরফ হয়ে দীর্ঘদিন ধরে জমে আছে, একমাত্র ডোনা ছুঁয়ে দিলেই ওখান থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে জল পড়তে শুরু করে। সেই জলের স্রোতে খানিকটা নোনতা জল মিশিয়ে দিয়ে অনেকটা কাঁদতে পারে শ্রেয়। তারপর আবার প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারে। ভারী হয়ে আসা নিঃশ্বাসটা আবার স্বাভাবিক হয়। সেই একমাত্র ভরসার জায়গাটাও এই মহিলা ইচ্ছে করে কেড়ে নিলো! শ্রেয়র অর্থের জোর নেই, নেই পরিচিতির জোর, তাই নিজের ইনফ্লুয়েন্স খাটিয়ে ডোনাকে ওর থেকে দূরে করে দিলো এই মহিলা।
যে ডোনা দুদিন আগেও বলতো, তুই ভাবিস না শ্রেয়, তোর মা যদি তোকে এতটা কষ্ট দিয়ে থাকে, তাহলে তাকেও একদিন কষ্ট পেতেই হবে। ভগবান অরুন্ধতী সেনকেও ক্ষমা করবে না কোনদিন। আমি তো তোর পাশেই আছি শ্রেয়। ডোনার এই কথাগুলো এতদিন ছিল ওর শক্তি। আজ সেই ডোনা বলে কিনা, তুই এতদিন আন্টিকে ভুল বুঝেছিস শ্রেয়! উনি মানুষটা ঠিক ওরকম নয় রে।
অদ্ভুত ব্যাপার! আজ ডোনার কাছ থেকে ওকে মিসেস সেনের পরিচয় জানতে হচ্ছে। ওনার দয়া মায়ার সার্টিফিকেট নিতে হচ্ছে!
দুদিন ধরে ঘরের মধ্যেই গুমরে মরেছে শ্রেয়। টিভি দেখে গান শুনে, বই পড়ে অনেক চেষ্টা করেছে ডোনাকে ভুলতে।কিন্তু...
শ্রেয় বইটা বন্ধ করে দুমদাম পা ফেলে বাবার স্টাডিরুমে গেল। দূর থেকেই দেখলো বাবা বিজ্ঞানী মনি ভৌমিকের একটা বইয়ে মশগুল।
এই মানুষটার নির্লিপ্ততা দেখে অসহ্য রাগে ফেটে পড়তে ইচ্ছে করলো। সব কিছু চোখের সামনে দেখেও নিশ্চুপ।
বাবার তো উচিত ছিল ওই মহিলার এই স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। বাবা তা না করে, ওই মহিলার প্রচুর অর্থের ওপরে বসে আয়েশ করছে।
শ্রেয় বেশ জোরেই বললো, আমি তো তোমাদের বলেছিলাম, আমার জীবনের ত্রিসীমানায় তোমরা ঢুকবে না, তা না, তোমরা ইচ্ছে করে আমার জীবনটাকে নরক বানিয়ে দিচ্ছ। তোমার হাই প্রোফাইল ওয়াইফের টাকায় আমার কোনো লোভ নেই। তাই তুমি ওই মহিলা ফিরলেই বলে দেবে আমার ফ্রেন্ডের মাকে হেল্প করে উনি আমার কোনো উপকার করেননি! বরং ডোনার সাথে আমার দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বটা নষ্ট হয়েছে শুধু ওই মহিলার জন্য।
বাবা বই থেকে মুখটা সরিয়ে বললো, কেন ডোনার মায়ের অপারেশন তো তোমার মা করেছে শুনলাম। ওর মা তো ভালোই আছে, আমাকে অরুন্ধতী বলেছে। এতে তোমার প্রবলেমটা কোথায় হলো?
বাবার দিকে আগুন চোখে তাকিয়ে শ্রেয় বললো, ওহ, তার মানে তুমিও সব জানো। ওই মহিলা তোমাকেও সব বলেছে। তাহলে ঐ মহিলাকে একটা কথা বলে দিও, আমার লাইফের ত্রিসীমানায় যেন উনি না ঢোকেন।
ধ্রুবজ্যোতি সেন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো, তার আগেই দুমদাম পা ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো শ্রেয়। বেরোতেই দেখলো, সামনেই মিসেস সেন দাঁড়িয়ে আছে। মা নয়, এই নামেই ডাকে শ্রেয় ওকে। একটা কথাও না বলে শ্রেয় পাশ কাটিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে গেলো।
টিভিটা চালাতেই চোখে পড়লো একটা খবরের হেডলাইন। ডক্টর অরুন্ধতী সেনের গাফিলতির ফলে একজন রোগীর মৃত্যু ঘটেছে বলে জানা গেছে। ঘটনাটা ঘটেছে অপরেশন টেবিলেই। পুলিশি তদন্ত শুরু হয়েছে। মানুষের কাছে ভগবান হয়ে ওঠা মানুষটার কি সত্যিই গাফিলতি ছিল, নাকি...
শ্রেয়র ভিতরে আবার সেই অদ্ভুত আনন্দের বুদ্বুদ খেলে যাচ্ছিল। বেশ হয়েছে। পুলিশ এই মহিলাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিক। তাহলে শ্রেয়র আনন্দ হবে।
খুব ইচ্ছে করছিল ডোনাকে ফোন করে খবরটা দিতে। এতদিনে ভগবান ওর অবহেলার, অপমানের শাস্তি দিতে চলেছে ওই মহিলাকে। কিন্তু তিনিও তো এখন আন্টি বলতে অজ্ঞান তাই আর ফোন করার ইচ্ছে নেই। নিজেই সেলিব্রেট করবে নিজের মনে।
ঘর থেকেই জোরে ডাকলো, যমুনা মাসি...
যমুনা মাসি আজ একুশ বছর আছে ওদের বাড়িতে। বাবা,মায়ের বিয়ের দিন থেকেই এ বাড়ির বাসিন্দা সে।
শুধু রাতে বাড়ি যায়, ভোর হলেই আবার হাজির হয়ে যায়।
শ্রেয় বললো, বেশ ঝাল ঝাল করে চিকেন পকোড়া আর কফি করে দাও তো।আজ খুব আনন্দের দিন।
কথা না বাড়িয়ে যমুনা মাসি রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো। শ্রেয় উঠে ওয়াশরুমে ঢুকলো।
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে ঢুকেই দেখলো ওই মহিলা ওর জিনিসপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করছে। দেখেই মাথাটা গরম হয়ে গেল শ্রেয়র। ও এখন বড় হয়েছে। নূন্যতম প্রাইভেসি দরকার ওর! আর বিশেষ করে যে জীবনেও খোঁজ নিলো না, শ্রেয় কি করে বড় হয়ে উঠলো, সে এসেছে আজ নজরদাড়ি করতে! রাগে ফেটে পড়ার আগেই মহিলা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
শ্রেয়র আর ইচ্ছে করছিল না যমুনা মাসির হাতের পকোড়া খেতে, নিজেই জামা-প্যান্ট পরে বাইরে বেরিয়ে গিয়েই খাবে কোনো রেস্টুরেন্টে। রেডি হয়ে ওয়ালেটটা নিতে গিয়েই দেখলো, অনেকগুলো দুহাজারের নোট আর পাঁচশোর নোট ভরা আছে ওর ওয়ালেটে। এর আগেও অনেকবার এটা হয়েছে। হঠাৎ দেখেছে ফাঁকা ওয়ালেটে একটা পাঁচশোর নোট। এতদিন শ্রেয় ভাবতো, ও বড় হয়েছে, তাই হয়তো বাবা এভাবে রেখে যায় ওর পকেটমানি। কিন্তু আজ অতগুলো টাকা দেখে আপনা থেকেই ভ্রূটা কুঁচকে গেছে ওর। ওই মহিলা কি ওকে ঘুষ দিতে এসেছিল? ওয়ালেটটা নিয়ে অরুন্ধতী সেনের রুমের দিকে পা বাড়ালো শ্রেয়। ঘরের বাইরে থেকেই শুনতে পেল মহিলা কাউকে কিছু একটা রিকোয়েস্ট করছে। নিজের নামটা দুবার শুনতে পেল শ্রেয়। কিন্তু ঠিক কি বলছে বুঝতে পারলো না।
বাইরে থেকেই দরজায় নক করলো শ্রেয়।
ঘরে ঢোকার আগেই ওদের গেট কিপার রাজরামের ভয়ার্ত গলা শোনা গেল। ম্যাডাম, কারা যেন ঢিল ছুঁড়ছে।
অরুন্ধতী সেন আচমকা শ্রেয়র মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরে বললো, এখন একদম বাইরে বেরোবি না। তোর কোনো ক্ষতি আমি হতে দেবনা। শ্রেয় ঘটনার আকস্মিকতায় একটু অবাক হয়ে গেছে। বাবা ফোনে কাকে বলছে, আপনারাই তাহলে ডক্টর অরুন্ধতী সেনের বাড়িতে সিকিউরিটির ব্যবস্থা করুন। বেশ কয়েকজন মিলে বাড়ির বাইরে এসে ঢিল ছুঁড়ছে। ভাঙচুর করেছে...
শ্রেয় দেখলো, মহিলা ফিসফিস করে ওর কানের কাছে বলছে, তোর ওয়ালেটে বেশ কিছু টাকা রেখে দিয়েছি। তুই কয়েকটা দিনের জন্য ছোটপিসির ফ্ল্যাটে চলে যা। ওখান থেকেই টিউশনি কর।
শ্রেয় বিরক্ত মুখে বললো, কেন? তোমার পাপের জন্য আমাকে কেন বাড়ি ছাড়তে হবে?
ঠিক তখনই যমুনা মাসি উত্তেজিত হয়ে বলল, বৌদিমনি, কয়েকজন গেট ভেঙে ফেলার মত করছে। কি হবে?
অরুন্ধতী কোনো দিকে না তাকিয়ে শ্রেয়কে আচমকা নিজের রুমের দিকে ঠেলে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিলো।
এমনিতেই এই মহিলার বেডরুমে কোনোদিন ঢোকে না শ্রেয়। এমন কি ও এই ঘরে উঁকি অবধি দেয়নি বহু বছর। কোনো প্রয়োজন হলে ডাইনিংয়ে থাকাকালীন কথা বলতো। আজ সেই বেডরুমের ভিতরে ও বন্দী। অসহ্য রাগে নিজের মাথার চুলগুলো মুঠো করে ধরলো ও।
মহিলার বেড সাইডের কর্নার টেবিলে শ্রেয়র বিভিন্ন বয়সের ছবির একটা কোলাজ রয়েছে। আদিখ্যেতা আর কার নাম!
নেহাত কৌতূহলের বশেই মহিলার মুঠোফোনটা হাতে নিয়ে দেখতে শুরু করলো। স্ক্রিন সেভারে ওরই একটা বছর তিনেকের ছবি। একটা লাল রঙের গেঞ্জি পরে কোনো একটা পুজো প্যান্ডেলে দাঁড়িয়ে আছে শ্রেয়।
দেখতে দেখতেই চোখে পড়লো, রিসেন্ট কলের নম্বরটা ওর খুব পরিচিত। এটা তো ডোনার মোবাইল নম্বর। ওই মহিলা তারমানে ডোনাকে ফোন করে ওর নামে উলটো পাল্টা বলছিলো! যা ভেবেছিল ঠিক তাই। ওকে একা করে দেবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে মহিলা।
নিজের অজান্তেই ডোনার নম্বরটা ডায়াল করে ফেললো ও। ওপ্রান্তে ডোনার গলা...
হ্যাঁ আন্টি বলুন, আমি দুবার শ্রেয়কে কল করেছিলাম। ও রিসিভ করলো না। এখনও মনেহয় রেগে আছে। কিন্তু আন্টি, আপনি যেভাবে আমাদের পাশে দাঁড়ালেন তারপর আপনার কথা মত শ্রেয়র কাছে আপনার নামে নিন্দে করতে আমি পারবো না! ও কিছুতেই বুঝতে চাইছে না, আপনি সত্যিই প্রফেশনাল কারণে ভীষন ব্যস্ত থাকেন, কিন্তু আপনি ওকে অনেকেটা ভালোবাসেন!
আপনি চিন্তা করবেন না আন্টি আমি ওকে বলবো না, যে আপনার সাথে আমার কথা হয়েছে। আপনিই বলেছেন, ও ভীষণ একা, ওর পাশে থাকতে।
ফোনটা কট করে কেটে দিলো শ্রেয়।
তারমানে ওই মহিলা ডোনাকে ফোন করে বলেছে, যে শ্রেয়র কাছে ওর নামে ডোনা যেন নিন্দে করে!
কিন্তু কেন? শুধু শ্রেয় ভালো থাকবে বলে!
শ্রেয় তো ওর সবচেয়ে বড় শত্রু, তারপরেও কি করে...
কেনই বা বাড়িতে একটা বিপদের গন্ধ পেয়েই আগে শ্রেয়কে গার্ড করতে চাইছে মহিলা?
বেশ কিছু এলোমেলো প্রশ্ন ঘুরছিল শ্রেয়র মাথায়।
ঠিক সেই সময়েই বাইরের দরজাটা খুলে গেল। বাবা ঢুকে বললো, তোমার মা নিজেই থানায় যাচ্ছে। নাহলে ওই পেশেন্ট পার্টির লোক এসে বাড়িতে হামলা করেছে। আপাতত পুলিশ এসে সামলেছে ব্যাপারটাকে। তুমি কদিন বাড়ির বাইরে বেশি যেও না।
বাবা চলে গেল।
শ্রেয়র সব ওলটপালট হয়ে যাচ্ছিল।
মহিলার আলমারির একটা পাল্লা খোলা রয়েছে দেখেই নিষিদ্ধ জিনিস দেখার নেশার মতই সেদিকে এগোলো ও।
আলমারির গোটা তাক জুড়ে শ্রেয়র সেই ছোটবেলার বাতিল ছোট ছোট জামা প্যান্ট, ভাঙা খেলনা। এগুলো এই মহিলা জমিয়ে কেন রেখে দিয়েছে? অর্থের পাহাড়ে বসে এই মহিলা এসব ভাঙা খেলনা, শ্রেয়র পুরোনো ড্রয়িং বুক, নার্সারির রেজাল্ট এসব কেন জমিয়ে রেখেছেন? এত ব্যস্ততার মধ্যে এগুলো এত গোছানো রয়েছেই বা কি করে!
অদ্ভুত আগ্রহে গোটা আলমারিটা ঘেঁটে ফেললো শ্রেয়।
সবই ওর ছোটবেলার জিনিস। ওর প্রথম অক্ষর লেখার খাতাটা পর্যন্ত রয়েছে।
বাইরে পায়ের আওয়াজ পেয়েই দ্রুত হাতে বন্ধ করলো আলমারিটা।
অরুন্ধতী নিজের ঘরে ঢুকে ক্লান্ত গলায় বলল, বাইরে এ কদিন বেশি বেরোবে না। আমি আসছি।
শ্রেয়র গলার কাছে একটা অন্যরকম কষ্ট দলা পাক্কাচ্ছে। এই কষ্টের হদিস ও সতেরো বছর নয় মাসেও টের পায়নি। আজ হঠাৎ কেমন একটা অন্যরকম ফিলিংস হচ্ছে ওর। খুব ইচ্ছে করছে ওই কঠিন, অহংকারী মহিলাকে মা বলে ডাকতে। কিন্তু দীর্ঘদিনের অনভ্যাসে কিছুতেই ডাকতে পারছে না ও। জিভটা আড়ষ্ট হয়ে রয়েছে। বার দুই চেষ্টা করে ও বললো, তুমি কোথায় যাচ্ছ?
অরুন্ধতী বললো, আপাতত থানায় যাচ্ছি। এই মুহূর্তে পেশেন্ট পার্টি ক্ষেপে আছে। ওরা একটা লস্ট কেস এনেছিল। আমি চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারিনি। কিন্তু যেহেতু অপারেশন টেবিলে মারা গেছেন, তাই দোষ তো সার্জেনেরই হবে। আপাতত থানায় যাই, কালকে ওনার মেডিকেল রিপোর্টগুলো এলে সত্যিটা প্রমান হয়ে যাবে।
আমি খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো। আর যেটা বললাম মনে রাখবে, বাবার কথা শুনবে। বাবাকে তো তুমি ভালোবাসো। বাড়ির বাইরে বেরোবে না এই দুদিন।
মোবাইল, চার্জার এগুলো একটা হ্যান্ড ব্যাগে গোছাচ্ছিলো অরুন্ধতী।
শ্রেয় ধীর পায়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
ডাইনিং হলে দুজন পুলিশ অফিসার বসে বাবার সাথে কথা বলেছিলেন।
ওর হঠাৎই কেমন একটা কান্না পাচ্ছিলো। নিজের ঘরে ঢুকে পড়ল শ্রেয়।
ঠিক সেই সময় ওর ঘরের বিছানায় ফোনটা বাজছিলো।
ডোনার কল।
রিসিভ করতেই ডোনা বললো, নিউজটা দেখেছিস? আন্টির নামে কি সব বলছে রে?
তোকে বলেছিলাম না, দেখিস, তোকে যে কষ্ট দেবে ভগবান ঠিক তাকে শাস্তি দেবে...
ডোনার কথাটা শেষ হবার আগেই শ্রেয় চিৎকার করে বললো, জাস্ট শাট আপ। আমার মায়ের নামে আর একটা কথাও বলবি না তুই।
শুনে রাখ, আমার মায়ের কোনো দোষ নেই। ডক্টর অরুন্ধতী সেনের ছুরি-কাঁচি কথা বলে, ভুলটা পেশেন্ট পার্টির, বুঝেছিস!
ডোনা হাসতে হাসতে বললো, এই শ্রেয়, আমার একটা অদ্ভুত ফিলিং হচ্ছে। আমি একটা অ্যাংরি ইয়ংম্যানের প্রেমে পড়ে যাচ্ছি। ডোনার গলায় খুশির ছোঁয়া।
ফোনটা রেখেই নিজের ঘরের আলমারি খুললো শ্রেয়। আজ থেকে বছর পাঁচেক আগের একটা গ্রিটিংস কার্ড বের করলো। কাঁচা হাতের আঁকা। একজন মহিলার ছবি, যারা গলায় টেথোস্কোপ, ডান হাতে একটা ব্যাগ আর বাঁ হাত দিয়ে ধরে আছে একটা বাচ্চা ছেলের হাত। নিচে লেখা হ্যাপি মম'স ডে।
কার্ডটা ওদের স্কুলে একবার আঁকিয়ে ছিল। নিজের নিজের মায়ের ছবি এঁকেছিল সব ক্লাসের ছেলেরা। বলেছিল, বাড়ি ফিরে সবাই নিজের মাকে দেবে। শ্রেয় নিজের আলমারি বন্দী করে রেখেছিল।
হাতে একটা ছোট্ট ব্যাগ নিয়ে ধীর পায়ে দুজন পুলিশের সাথে হেঁটে যাচ্ছে ডক্টর অরুন্ধতী সেন।
ধ্রুবজ্যোতি সেনের চোখে দুশ্চিন্তার ছায়া। অরুন্ধতী ধ্রুবর হাতটা ধরে বলল, টেনশন করো না। তোমার এমনিতেই প্যানিক এট্যাক হয়। রাতে শোয়ার আগে প্রেশারের ওষুধটা খেও বুঝলে? আর ছেলেটাকে দেখো। বাইরে যেতে দিও না একদম।
পুলিশ অফিসার বললেন, মিস্টার সেন ডোন্ট ওয়ারি। আমরা জাস্ট ওনার প্রোটেকশনের ব্যবস্থা করছি। কাল,পরশুই ওনাকে বাড়িতে ফিরিয়ে দিয়ে যাবো।
পিছন থেকে শ্রেয় ডেকে উঠলো, মা...
থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে ডক্টর সেন।
ঠিক শুনলেন কি?
শ্রেয় পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, মা এটা তোমার জন্য।
হাতের কার্ডের দিকে তাকিয়ে অরুন্ধতী সেন কোনো কথা বলতে পারল না। ওর ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠলো। অস্ফুটে বললো, সরি। আমি তোকে সত্যিই একটুও টাইম দিয়ে উঠতে পারিনি।
শ্রেয় কান্নাভেজা গলায় বলল, তাড়াতাড়ি ফিরে এসো মা।মিস ইউ।
ধুর বোকা ছেলে , এত বড় ছেলে কখনো কাঁদে। ওড়নাটা দিয়ে শ্রেয়র চোখটা মুছে দিয়ে এগিয়ে চললেন ডক্টর অরুন্ধতী সেন। তখনও কানের মধ্যে অনুরণন হয়ে চলেছে একটাই শব্দ, মা....
- অর্পিতা সরকার
আরেকবার বললো, তুই ভাবতে পারছিস না শ্রেয়, আন্টি আমাদের বিপদে কিভাবে পাশে দাঁড়িয়েছেন। তুই তো জানিস, পাপা এখন আসামে পোস্টেড। আমি একা গত পরশু মাকে নিয়ে গ্রিনল্যান্ডে গিয়েছিলাম। যেতেই আন্টির মুখোমুখি। আন্টি আমায় দেখেই নিজের মেয়ের মতই বললেন, কি হয়েছে ডোনা? ততক্ষনে আমার ছোট মামা এসে পৌঁছেছে। আন্টি কিছুটা রিস্ক নিয়েই মায়ের ওই কন্ডিশনে হিস্টারেকটমি করেছেন। যে ডক্টর মাকে দেখছিলেন, তিনি তো কেয়ারলেসের মত অপারেট না করে বিদেশে চলে গেলেন। যাইহোক মা এখন ঠিক আছে। যাই বলিস না কেন, আন্টির হাতে ছুরি কাঁচি কথা বলে রে! এমনকি আমাকে ডেকে বলেছেন, ডোনা তুমি তো শ্রেয়র ফেন্ড, আমার মেয়ের মত। কোন রকম প্রবলেমে পড়লে কল করো। আজ বুঝতে পারছি, কেন লোকে ডক্টর অরুন্ধতী সেনের নাম শুনলে কপালে হাত ঠেকায়। জানিস শ্রেয়, আমি যখন আগে তোর বার্থ ডে তে তোদের বাড়ি যেতাম, তখন আমার আন্টিকে দেখে ভয় ভয় করতো। কিন্তু এই তিনদিন ওনাকে দেখে মনে হচ্ছে, আমার মায়ের সাথে ওনার কোনো তফাৎ নেই। তারপর জানিস, উনি আমাদের কাছ থেকে ফিজ নেন নি। বলেছেন, শ্রেয়র ফ্রেন্ডের মা এর অপারেশন করে ফিজ নিলে, আমার ছেলেটা রাগ করবে যে! আমরা শুধু নার্সিংহোমের টাকাটা দিয়েছি। মাকে আর তিনদিনের মধ্যে রিলিজও করে দেবে। আন্টি না থাকলে যে কি হতো...
শ্রেয় চিৎকার করে বললো, বুলশিট!
ডোনা, তোর মা তোকে ছোটবেলায় গল্প বলে খাইয়ে দিয়েছে, এখনো কষ্ট হলে তুই তোর মায়ের বুকে মুখ গুঁজে কাঁদতে পারিস। তাই এত বড় বড় লেকচার মারছিস। আর আমি তো অবাক হয়ে যাচ্ছি, তুই আমার নার্সারির ফ্রেন্ড হয়েও, সবটা জেনেও হঠাৎ অরুন্ধতী সেনের পক্ষ নিয়ে লড়তে এসেছিস?
কাকিমার অপারেশনের ফিজ দিতে গিয়েছিলিস, ব্যাস ল্যাটা চুকে গেল। নেয়নি সেটাতে তোদের কোনো দায়িত্বও নেই। এত গ্রেটফুল কেন হয়ে গেলি সেটাই তো বুঝতে পারলাম না।
ডোনা আরেকটা কি বলতে যাচ্ছিলো, তার আগেই শ্রেয় বললো, যদি অরুন্ধতী সেনের নামে প্রশংসা করার জন্য আমাকে ফোন করে থাকিস, তাহলে প্লিজ ফোনটা আমি কাটছি। আরেকটা কথা, আমার মনে হয় সব বন্ধুত্বেই কিছু বন্ডিং থাকাটা জরুরি। আমার ছোটবেলা থেকে সবটা জানার পর, যখন তুই একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে যেতে পারিস, তখন আমাদের ফ্রেন্ডশিপের ব্রেকআপ প্রয়োজন। ডোনা থমকে গিয়ে বলল, এত বড় কথাটা তুই বলতে পারলি শ্রেয়? মা এখনো নার্সিংহোমে, এখন তুই এভাবে... বেশ, তাহলে তাই হোক। তোর যদি আমাকে প্রয়োজন না হয়, তাহলে আমারও নেই। ফোনটা কট করে কেটে দিলো ডোনা।
সামনে খুলে রাখা ফিজিক্সের বইটা বন্ধ করে দিয়ে অরিজিৎ সিংয়ের স্যাড সং এ মন দিলো শ্রেয়।
আর মনে মনে বললো, অরিজিৎ বোধহয় ওর জন্যই এই গানগুলো গেয়েছে। ওর মত নিতান্ত অবহেলিত একাকী মানুষের জন্যই এই গানগুলোর সৃষ্টি। ইদানিং শ্রেয়র বন্ধুর সংখ্যা কমতে কমতে তলানিতে এসে ঠেকেছিলো। ডোনা তাও ঝগড়া ঝাঁটি করে টিকে ছিল। ওর কাছে অন্তত মনের কথা শেয়ার করা যেত। বন্ধুরা বলে ডোনার নাকি আলাদা সফ্ট কর্নার আছে শ্রেয়র প্রতি। যদিও শ্রেয় ডোনার ব্যবহারে নির্ভেজাল বন্ধুত্ব ছাড়া আর কিছু দেখেনি এতগুলো বছরে।
জেন্ডার আলাদা হলেই আজও লোকের চোখে বন্ধুত্বটা একটু ইঙ্গিতপূর্ণ হয়ে যায়, তবুও ডোনা আর ওর মধ্যে কখনো কোনো প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়নি। অথচ ওরা জানে ওদের দুজনের মধ্যে অনেক অমিল থাকা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখবে ওদের বন্ধুত্বটাকে। অবসরে ফোন, টিউশন থেকে ফেরার পথে একটু গল্প...কিন্তু অরুন্ধতী সেনের তো সেটাও সহ্য হলো না। যথারীতি নিজের ডাক্তারি ইমেজকে কাজে লাগিয়ে ডোনাদের ফ্যামিলির সবার চোখে পুরো মহীয়সী হয়ে গেলেন।
ডোনাদের বাড়িতে ছোট থেকেই শ্রেয়র যাতায়াত আছে। ডোনার মা ভালোমন্দ রান্না করলেই শ্রেয়র নিমন্ত্রণ থাকে। এখন সে জায়গাটাও দায়িত্ব নিয়ে শেষ করে দিলেন ওর গ্রেট মাদার। শ্রেয় বেশ বুঝতে পারছে, এর পিছনে মায়ের একটা গভীর চক্রান্ত আছে। মা চায় শ্রেয়কে সম্পূর্ণ একা করে দিতে! ও যাতে মনের কথা কোথাও না বলতে পেরে হেরে গিয়ে মায়ের কাছে আত্মসমর্পণ করে। নিজের ওপরেই ঘৃণা হচ্ছে শ্রেয়র, ও কেন এমন মায়ের সন্তান হলো? এর থেকে ও যেকোনো হাউজ ওয়াইফের ছেলে হলে, বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা তিলে তিলে মরে যেত না অন্তত। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে মায়ের হাসি মুখটা দেখতে পেত, বা স্কুল বাসের সামনে দাঁড়িয়ে মায়ের হাত নাড়া, অথবা বাসটা ছেড়ে যাওয়ার সময় চিৎকার করে মা বলতো, দুষ্টুমি করিস না! অন্যান্য মায়েদের মত বাড়ি ফিরলেই আঁচল দিয়ে মুখটা মুছিয়ে বলতো, সব পড়া পেরেছিলিস?
না, এসব কিছুই পায়নি শ্রেয় জন্মে থেকে। কারণ শ্রেয় একজন সেলিব্রিটি সাকসেসফুল ডক্টরের সন্তান কিনা! ও তো বছর তিনেক পর্যন্ত যমুনা মাসিকেই মা মনে করতো। কারণ ঘুম চোখে আর ঘুম ভাঙা চোখে ওর মুখটাই দেখতো। মাঝে মাঝে দেখতো, একটা খুব ব্যস্ত মহিলা কপালে হামি খেয়ে বলছে, গুড বয় হয়ে থেকো। যমুনা মাসিকে একদম বিরক্ত করো না। ভোরে ঘুম ভেঙেই দেখতো ওই মহিলা খুব ব্যস্ত হয়ে কাউকে একটা ফোনে বলছে, সে কি কাল যখন অপারেট করলাম তখন তো বি পি ঠিকই ছিল, তারপর হাই হলো কখন? ওকে, আই অ্যাম কামিং সুন।
মহিলা বেশ ব্যস্ত হয়ে রিস্ট ওয়াচটা পরে, বাবার দিকে তাকিয়ে বলতো, শ্রেয়কে একটু খেয়াল রেখো। আমার একটা ইমার্জেন্সি এসে গেছে। খুব ছোট থেকেই ইমার্জেন্সি কথাটার মানে বুঝে গিয়েছিল শ্রেয়। বুঝেছিল, ওই শব্দটার মানে এই মহিলা সারাদিনের জন্য গায়েব হয়ে যাওয়া। বাবাই ঘুম থেকে উঠিয়ে ব্রাশ করিয়ে দিতো ওকে। তারপর যমুনা মাসি এসে ওকে ব্রেকফাস্ট করিয়ে দিতো।
বাবাও মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতো, অরুন্ধতী, ছেলেটা তোমায় তো ভালো করে চিনছেই না। এবারে একটু কাজের প্রেসার কমাও তুমি। অরুন্ধতী সেন হালকা গলায় বলতো, যাদের মায়েরা বিজি থাকে, তাদের ছেলেরা কি মায়েদের চেনে না? অন্তরের টান, রক্তের টান বলেও তো একটা কথা আছে! শ্রেয় বড় হলেই বুঝতে পারবে তার মা কতটা নিরুপায় আর সেই জন্যই তাকে সাফিসিয়েন্ট টাইম দিতে পারেনা! কিন্তু তাই বলে ভালোবাসে না তা তো নয়?
শ্রেয় বুঝেছিল, মা একজন নামি ডক্টর। নামকরা সার্জেন। তার হাতে নাকি ছুরি-কাঁচি কথা বলে। ভগবানের পরেই রুগীরা তাকে স্থান দিয়েছেন। এত কিছু জানার পরও ওই মানুষটাকে নূন্যতম সম্মান করতে পারেনি ও নিজে। বরং স্কুল টিচার ধ্রুবজ্যোতি সেনকে ও অনেক রেসপেক্ট করে।
বাবা গম্ভীর মানুষ হলেও শ্রেয়র রেজাল্ট দেখেছে সময় মত। পেরেন্টস মিটিং অ্যাটেন্ড করেছে। তাই বাবার প্রতি শ্রেয়র একটা সূক্ষ্ম অনুভূতি কাজ করে। মানুষটা কম কথা বলা গম্ভীর মানুষ হলে কি হবে, কর্তব্যটুকু অন্তত করে। অরুন্ধতী সেনের মত স্বার্থপর নয়। শুধু নিজের নাম-যশ, রেপুটেশন নিয়ে ব্যস্ত নয়।
আই পি এল টা চালালো শ্রেয়। ও নিজে কে.কে.আর এর ভক্ত। কিন্ত ডোনা আবার দাদা পাগলা পাবলিক। যেদিন থেকে সৌরভ গাঙ্গুলি কে.কে.আর ছেড়েছে, সেদিন থেকে ডোনা মনে মনে চায় কে.কে.আর হারুক। নেহাত শ্রেয়র সামনে তেমন বলতে পারেনা সেটাই।
আজ দিল্লি জিতছে দেখে আরেকবার ডোনার মুখটা মনে পড়লো। এতক্ষনে বার দুয়েক ফোন করে বলতো, দেখলি দাদাকে দেখাচ্ছে। কি অ্যাটি দেখলি? শ্রেয় রেগে গিয়ে বলতো, থাম তো, তুই তো এমন বলছিস যেন ব্যাটটা দাদাই চালাচ্ছে। এই নিয়ে দুজনের বেশ কিছুক্ষণ খুনসুটি চলতো। আই পি এলের আসল ফ্লেভারটা আজ মিসিং। ডোনাকে লেগপুল করা হলো না গাঙ্গুলীকে নিয়ে। শ্রেয় নিজে সচিনের ফ্যান ছিল। দাদাকে ওর মন্দ লাগতো না। কিন্তু ডোনার মত অমন অন্ধ ভক্ত নয়।
বার দুয়েক ডোনার নম্বরে কল করেও রিং হবার আগেই কেটে দিলো।
সব থেকে বিরক্ত লেগেছে শ্রেয়র, আন্টির অপারেশনের সময় ডোনা ওকেও তো ডাকতে পারতো। আরে কলকাতা শহরে কি নার্সিংহোমের আকাল চলছে নাকি, যে অরুন্ধতী সেনের আন্ডারে ভর্তি করতে হবে! ডোনা শ্রেয়কে খবরটা দিলো কখন, ওর মায়ের অপারেশন হয়ে যাবার পরে! ওকে এতটা আন্ডারএস্টিমেট কেন করে ডোনা! এখন তো আবার ডক্টর অরুন্ধতী সেনের নামে প্রশংসা শুরু করেছে। শ্রেয়কে স্কুলেও সবাই বেশ হিংসার চোখে দেখতো। সাধারণের থেকে আলাদা ভাবতো বন্ধুরা। সেটাও শুধুমাত্র ওই বিখ্যাত মহিলার জন্য। আজ ওর একমাত্র কাছের বন্ধুর মনেও নিজের চিরস্থায়ী জায়গা করে নিলো মহিলা। আর সেটা করলো শ্রেয়কে জাস্ট ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে। সবাই বলে মা শব্দের মধ্যেই নাকি মায়া শব্দটা লুকিয়ে থাকে। কিন্তু শ্রেয়র অভিজ্ঞতা বলে, মা শব্দের মধ্যে লুকিয়ে আছে, স্বার্থপরতা, অহংকার, অবজ্ঞা।
অসহ্য একটা কষ্ট দলা পাকিয়ে আসছে ওর কণ্ঠনালীর কাছে। আই পি এলের উত্তেজনা ফিকে হয়ে যাচ্ছে সেখানে।
ওর স্কুলের বন্ধু রক্তিম একদিন বলেছিল, আমরা এক ক্লাসে বসি ঠিকই কথাই, হয়তো টিফিন ভাগ করেও খাই, কিন্তু আমার বাবা বলেছে, তোর মায়ের দুটো অপারেশনের টাকায় আমাদের গোটা মাসের সংসার খরচ চলে যায়। তাই বুঝলি শ্রেয়, তুই আমার বন্ধু হতে পারিস না। সেদিন ঘরে ফিরে বালিশ আঁকড়ে খুব কেঁদেছিল ক্লাস নাইনের ছেলেটা।
সেদিনও বাবা নিজের বইয়ের জগতে ব্যস্ত ছিল। মাঝরাতে ওদের বাড়ির দরজা খুলেছিল একটা গাড়ির হর্নএর আওয়াজ শুনে। নির্ঘুম রাতে শুনেছিল মা নামক ওই মহিলার জুতোর হিলের শব্দ। ততক্ষনে শ্রেয়র চোখের জল শুকিয়ে গিয়ে গালে একটা হালকা রেখা রেখে গিয়েছিল মাত্র। ওই মহিলার পায়ের আওয়াজ পেয়েই মধ্যরাতে গোটা বাড়ি কাঁপিয়ে নিজের ঘরের দরজা আটকে দিয়েছিল শ্রেয়। মহিলা একটু থমকে দাঁড়িয়ে বলেছিল, অসভ্যতামি করবে না। মাঝরাতে এত জোরে আওয়াজ করাটা বেয়াদপি! ঘরের ভিতরে বসেই ও শুনেছিল কথাটা। সেদিন থেকেই ঠিক করেছিল, মিসেস অরুন্ধতী সেনের অপছন্দের জিনিসগুলো ওকে খুঁজে বের করতে হবে। এবং নিখুঁত ভাবে করতে হবে সেগুলোকে। রুটিন করে বিরক্ত করতে হবে ওই মা নামধারী মহিলাকে।
খুব রেয়ার ছুটির দিনে যখন তিনজনে একসাথে ডিনারে বসত, তখন শ্রেয় ইচ্ছে করেই জলের গ্লাসটা ঠক করে টেবিলে রাখতো, বা উল্টে দিতো। খেতে খেতে পা দুটো তুলে দিতো চেয়ারে। অথবা চিকেনের বাটিতে এঁটো হাত দিয়ে তুলে নিতো লেগ পিসটা। মা নামক অহংকারী ব্যক্তিটি বিরক্ত মুখে তাকিয়ে বলতো, বড় হচ্ছ, মিনিমাম সভ্যতাটুকু আশা করি তোমার কাছে! বাবার দিকে তাকিয়ে মহিলা বলতো, ধ্রুব আমি সারাদিন ব্যস্ত থাকি। তুমি তো জানো আমার প্রেসারটা। তুমি অন্তত ওকে একটু এটিকেট শেখাও প্লিজ।
বাবা অসহায় গলায় বলতো, অন্য দিন এমন করেনা তো। শুধু তোমাকে দেখলেই এগুলো করতে দেখি।
অরুন্ধতী সেন রেগে গিয়ে নিজের টেবিল ছেড়ে দাঁড়িয়ে বলতো, যমুনা আমার খাবারটা আমার রুমে পাঠিয়ে দিও।
এই ভাবেই নিজের অবহেলার প্রতিশোধ তুলে চলেছে শ্রেয়। চূড়ান্ত প্রতিশোধটা নিয়েছিল মাধ্যমিকের রেজাল্টের পর। মায়ের পছন্দের নামি স্কুলে ভর্তি না হয়ে ভর্তি হয়েছিল একটা মিডিওকার স্কুলে। পড়াশোনায় ভালো হলেও অরুন্ধতী সেনের ছেলে ওই স্কুলে পড়বে এটা হয়তো ভাবতে পারেনি মহিলা। তাই বাড়িতে ঢুকেই বাবার দিকে তাকিয়ে বলতো, এগুলো তোমার প্রশ্রয়ে হচ্ছে ধ্রুব। আমরা যখন ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম, তখন শর্তই ছিল, যেহেতু আমার পেশা ডাক্তারি তাই তুমি সন্তান মানুষের কিছুটা দায়িত্ব অন্তত নেবে! এখন তো দেখছি তুমি ওকে একটাই জিনিস শেখাচ্ছ, ও কি করে আমাকে অমান্য করবে! আমার বলা কথাগুলো নস্যাৎ করে দিয়েই তো ওর সবচেয়ে বেশি আনন্দ। বাবা নরম গলায় বলেছিল, স্কুলটা হাইফাই নয় ঠিকই কিন্তু এই স্কুলে কি পড়াশোনা হয়না? শুনলাম রেজাল্ট বেশ ভালোই হয় এই স্কুলে।
মহিলা বেশ রাগী গলায় বলেছিল, আমি তবে দিনরাত খেটে ইনকাম করছি কার জন্য! ও ভালো স্কুলে পড়বে, ভালোভাবে মানুষ হবে সেই জন্যই না!
বাবা মুখটা নিচু করে বলতো, বড় হচ্ছে, ওর ইচ্ছে অনিচ্ছের মূল্যটাও তো দিতে হবে! মহিলা হিসহিসে গলায় বলতো, তোমরা আমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছো ধ্রুব। ধ্রুবজ্যোতি সেন উত্তেজনাহীন শান্ত গলায় বলতো, তাতে কি আমার কোনো প্রফিট হবে অরুন্ধতী? আগেই বলেছিলাম, ছেলেটা বড় হয়ে যাচ্ছে, তুমি যে ওর মা, সেটা ও বুঝতেই পারছে না। তখন তো আমার কথায় গুরুত্ব দাওনি।
মহিলা কান্না ভেজা গলায় বলেছে, তোমার কি মনে হয় ধ্রুব, একজন ডক্টরের জীবন তার নিজের মত পরিচালিত হয়? আমি নিরুপায়, তাই বলে তোমরা সুযোগ নেবে? আর পাঁচটা মায়ের মত সন্তানকে সময় দিতে আমি তো কোনোদিনই পারবো না। সেই জন্য শ্রেয় আমায় অস্বীকার করবে?
মারাত্মক আনন্দে ভিতরের জ্বালাটা কমে যেত শ্রেয়র। যাক ওই মহিলার একটা ইচ্ছেতে অন্তত ছাই দিতে পেরেছে শ্রেয়, এই আনন্দেই বদ্ধ ঘরের মধ্যে দুবার লাফিয়ে নিতো ও।
একই বাড়িতে থেকে একটা অঘোষিত যুদ্ধ শুরু করেছিল শ্রেয় ওই অহংকারী মহিলার সাথে।
মনে মনে ভেবেই নিয়েছিল, কিছুতেই অরুন্ধতী সেনকে জিততে দেবেনা ও। বাইরের মানুষের চোখে যে নিজেকে ভগবানের আসনে বসিয়েছে, তাকেই মাটিতে মিশিয়ে দেবে শ্রেয়। সেটা একদিন বেশ জোর গলায় বলেওছিলো শ্রেয়।
পরিষ্কার গলায় বলেছিল, তুমি আমার মা নও। শুধু গর্ভে ধারণ করলেই কেউ মা হয়না মিসেস সেন। আমি কোনদিন তোমায় মা বলে মনেই করিনা। তাই আমার ওপরে নিজের কোনোরকম শাসন চালাতে আসবে না। সেদিন থেকেই একই ছাদের নিচে থেকেও দুজনের মুখ দেখা দেখি প্রায় বন্ধ।
এই অবস্থায় শ্রেয়কে যখন ডোনার কাছ থেকে ওই মহিলার প্রশংসা শুনতে হয়, তখন আর মেজাজ ধরে রাখতে পারেনা ও। ডোনা ওর একটা নিশ্চিন্তের জায়গা। মনের মধ্যে যে কষ্টগুলো বরফ হয়ে দীর্ঘদিন ধরে জমে আছে, একমাত্র ডোনা ছুঁয়ে দিলেই ওখান থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে জল পড়তে শুরু করে। সেই জলের স্রোতে খানিকটা নোনতা জল মিশিয়ে দিয়ে অনেকটা কাঁদতে পারে শ্রেয়। তারপর আবার প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারে। ভারী হয়ে আসা নিঃশ্বাসটা আবার স্বাভাবিক হয়। সেই একমাত্র ভরসার জায়গাটাও এই মহিলা ইচ্ছে করে কেড়ে নিলো! শ্রেয়র অর্থের জোর নেই, নেই পরিচিতির জোর, তাই নিজের ইনফ্লুয়েন্স খাটিয়ে ডোনাকে ওর থেকে দূরে করে দিলো এই মহিলা।
যে ডোনা দুদিন আগেও বলতো, তুই ভাবিস না শ্রেয়, তোর মা যদি তোকে এতটা কষ্ট দিয়ে থাকে, তাহলে তাকেও একদিন কষ্ট পেতেই হবে। ভগবান অরুন্ধতী সেনকেও ক্ষমা করবে না কোনদিন। আমি তো তোর পাশেই আছি শ্রেয়। ডোনার এই কথাগুলো এতদিন ছিল ওর শক্তি। আজ সেই ডোনা বলে কিনা, তুই এতদিন আন্টিকে ভুল বুঝেছিস শ্রেয়! উনি মানুষটা ঠিক ওরকম নয় রে।
অদ্ভুত ব্যাপার! আজ ডোনার কাছ থেকে ওকে মিসেস সেনের পরিচয় জানতে হচ্ছে। ওনার দয়া মায়ার সার্টিফিকেট নিতে হচ্ছে!
দুদিন ধরে ঘরের মধ্যেই গুমরে মরেছে শ্রেয়। টিভি দেখে গান শুনে, বই পড়ে অনেক চেষ্টা করেছে ডোনাকে ভুলতে।কিন্তু...
শ্রেয় বইটা বন্ধ করে দুমদাম পা ফেলে বাবার স্টাডিরুমে গেল। দূর থেকেই দেখলো বাবা বিজ্ঞানী মনি ভৌমিকের একটা বইয়ে মশগুল।
এই মানুষটার নির্লিপ্ততা দেখে অসহ্য রাগে ফেটে পড়তে ইচ্ছে করলো। সব কিছু চোখের সামনে দেখেও নিশ্চুপ।
বাবার তো উচিত ছিল ওই মহিলার এই স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। বাবা তা না করে, ওই মহিলার প্রচুর অর্থের ওপরে বসে আয়েশ করছে।
শ্রেয় বেশ জোরেই বললো, আমি তো তোমাদের বলেছিলাম, আমার জীবনের ত্রিসীমানায় তোমরা ঢুকবে না, তা না, তোমরা ইচ্ছে করে আমার জীবনটাকে নরক বানিয়ে দিচ্ছ। তোমার হাই প্রোফাইল ওয়াইফের টাকায় আমার কোনো লোভ নেই। তাই তুমি ওই মহিলা ফিরলেই বলে দেবে আমার ফ্রেন্ডের মাকে হেল্প করে উনি আমার কোনো উপকার করেননি! বরং ডোনার সাথে আমার দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বটা নষ্ট হয়েছে শুধু ওই মহিলার জন্য।
বাবা বই থেকে মুখটা সরিয়ে বললো, কেন ডোনার মায়ের অপারেশন তো তোমার মা করেছে শুনলাম। ওর মা তো ভালোই আছে, আমাকে অরুন্ধতী বলেছে। এতে তোমার প্রবলেমটা কোথায় হলো?
বাবার দিকে আগুন চোখে তাকিয়ে শ্রেয় বললো, ওহ, তার মানে তুমিও সব জানো। ওই মহিলা তোমাকেও সব বলেছে। তাহলে ঐ মহিলাকে একটা কথা বলে দিও, আমার লাইফের ত্রিসীমানায় যেন উনি না ঢোকেন।
ধ্রুবজ্যোতি সেন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো, তার আগেই দুমদাম পা ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো শ্রেয়। বেরোতেই দেখলো, সামনেই মিসেস সেন দাঁড়িয়ে আছে। মা নয়, এই নামেই ডাকে শ্রেয় ওকে। একটা কথাও না বলে শ্রেয় পাশ কাটিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে গেলো।
টিভিটা চালাতেই চোখে পড়লো একটা খবরের হেডলাইন। ডক্টর অরুন্ধতী সেনের গাফিলতির ফলে একজন রোগীর মৃত্যু ঘটেছে বলে জানা গেছে। ঘটনাটা ঘটেছে অপরেশন টেবিলেই। পুলিশি তদন্ত শুরু হয়েছে। মানুষের কাছে ভগবান হয়ে ওঠা মানুষটার কি সত্যিই গাফিলতি ছিল, নাকি...
শ্রেয়র ভিতরে আবার সেই অদ্ভুত আনন্দের বুদ্বুদ খেলে যাচ্ছিল। বেশ হয়েছে। পুলিশ এই মহিলাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিক। তাহলে শ্রেয়র আনন্দ হবে।
খুব ইচ্ছে করছিল ডোনাকে ফোন করে খবরটা দিতে। এতদিনে ভগবান ওর অবহেলার, অপমানের শাস্তি দিতে চলেছে ওই মহিলাকে। কিন্তু তিনিও তো এখন আন্টি বলতে অজ্ঞান তাই আর ফোন করার ইচ্ছে নেই। নিজেই সেলিব্রেট করবে নিজের মনে।
ঘর থেকেই জোরে ডাকলো, যমুনা মাসি...
যমুনা মাসি আজ একুশ বছর আছে ওদের বাড়িতে। বাবা,মায়ের বিয়ের দিন থেকেই এ বাড়ির বাসিন্দা সে।
শুধু রাতে বাড়ি যায়, ভোর হলেই আবার হাজির হয়ে যায়।
শ্রেয় বললো, বেশ ঝাল ঝাল করে চিকেন পকোড়া আর কফি করে দাও তো।আজ খুব আনন্দের দিন।
কথা না বাড়িয়ে যমুনা মাসি রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো। শ্রেয় উঠে ওয়াশরুমে ঢুকলো।
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে ঢুকেই দেখলো ওই মহিলা ওর জিনিসপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করছে। দেখেই মাথাটা গরম হয়ে গেল শ্রেয়র। ও এখন বড় হয়েছে। নূন্যতম প্রাইভেসি দরকার ওর! আর বিশেষ করে যে জীবনেও খোঁজ নিলো না, শ্রেয় কি করে বড় হয়ে উঠলো, সে এসেছে আজ নজরদাড়ি করতে! রাগে ফেটে পড়ার আগেই মহিলা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
শ্রেয়র আর ইচ্ছে করছিল না যমুনা মাসির হাতের পকোড়া খেতে, নিজেই জামা-প্যান্ট পরে বাইরে বেরিয়ে গিয়েই খাবে কোনো রেস্টুরেন্টে। রেডি হয়ে ওয়ালেটটা নিতে গিয়েই দেখলো, অনেকগুলো দুহাজারের নোট আর পাঁচশোর নোট ভরা আছে ওর ওয়ালেটে। এর আগেও অনেকবার এটা হয়েছে। হঠাৎ দেখেছে ফাঁকা ওয়ালেটে একটা পাঁচশোর নোট। এতদিন শ্রেয় ভাবতো, ও বড় হয়েছে, তাই হয়তো বাবা এভাবে রেখে যায় ওর পকেটমানি। কিন্তু আজ অতগুলো টাকা দেখে আপনা থেকেই ভ্রূটা কুঁচকে গেছে ওর। ওই মহিলা কি ওকে ঘুষ দিতে এসেছিল? ওয়ালেটটা নিয়ে অরুন্ধতী সেনের রুমের দিকে পা বাড়ালো শ্রেয়। ঘরের বাইরে থেকেই শুনতে পেল মহিলা কাউকে কিছু একটা রিকোয়েস্ট করছে। নিজের নামটা দুবার শুনতে পেল শ্রেয়। কিন্তু ঠিক কি বলছে বুঝতে পারলো না।
বাইরে থেকেই দরজায় নক করলো শ্রেয়।
ঘরে ঢোকার আগেই ওদের গেট কিপার রাজরামের ভয়ার্ত গলা শোনা গেল। ম্যাডাম, কারা যেন ঢিল ছুঁড়ছে।
অরুন্ধতী সেন আচমকা শ্রেয়র মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরে বললো, এখন একদম বাইরে বেরোবি না। তোর কোনো ক্ষতি আমি হতে দেবনা। শ্রেয় ঘটনার আকস্মিকতায় একটু অবাক হয়ে গেছে। বাবা ফোনে কাকে বলছে, আপনারাই তাহলে ডক্টর অরুন্ধতী সেনের বাড়িতে সিকিউরিটির ব্যবস্থা করুন। বেশ কয়েকজন মিলে বাড়ির বাইরে এসে ঢিল ছুঁড়ছে। ভাঙচুর করেছে...
শ্রেয় দেখলো, মহিলা ফিসফিস করে ওর কানের কাছে বলছে, তোর ওয়ালেটে বেশ কিছু টাকা রেখে দিয়েছি। তুই কয়েকটা দিনের জন্য ছোটপিসির ফ্ল্যাটে চলে যা। ওখান থেকেই টিউশনি কর।
শ্রেয় বিরক্ত মুখে বললো, কেন? তোমার পাপের জন্য আমাকে কেন বাড়ি ছাড়তে হবে?
ঠিক তখনই যমুনা মাসি উত্তেজিত হয়ে বলল, বৌদিমনি, কয়েকজন গেট ভেঙে ফেলার মত করছে। কি হবে?
অরুন্ধতী কোনো দিকে না তাকিয়ে শ্রেয়কে আচমকা নিজের রুমের দিকে ঠেলে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিলো।
এমনিতেই এই মহিলার বেডরুমে কোনোদিন ঢোকে না শ্রেয়। এমন কি ও এই ঘরে উঁকি অবধি দেয়নি বহু বছর। কোনো প্রয়োজন হলে ডাইনিংয়ে থাকাকালীন কথা বলতো। আজ সেই বেডরুমের ভিতরে ও বন্দী। অসহ্য রাগে নিজের মাথার চুলগুলো মুঠো করে ধরলো ও।
মহিলার বেড সাইডের কর্নার টেবিলে শ্রেয়র বিভিন্ন বয়সের ছবির একটা কোলাজ রয়েছে। আদিখ্যেতা আর কার নাম!
নেহাত কৌতূহলের বশেই মহিলার মুঠোফোনটা হাতে নিয়ে দেখতে শুরু করলো। স্ক্রিন সেভারে ওরই একটা বছর তিনেকের ছবি। একটা লাল রঙের গেঞ্জি পরে কোনো একটা পুজো প্যান্ডেলে দাঁড়িয়ে আছে শ্রেয়।
দেখতে দেখতেই চোখে পড়লো, রিসেন্ট কলের নম্বরটা ওর খুব পরিচিত। এটা তো ডোনার মোবাইল নম্বর। ওই মহিলা তারমানে ডোনাকে ফোন করে ওর নামে উলটো পাল্টা বলছিলো! যা ভেবেছিল ঠিক তাই। ওকে একা করে দেবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে মহিলা।
নিজের অজান্তেই ডোনার নম্বরটা ডায়াল করে ফেললো ও। ওপ্রান্তে ডোনার গলা...
হ্যাঁ আন্টি বলুন, আমি দুবার শ্রেয়কে কল করেছিলাম। ও রিসিভ করলো না। এখনও মনেহয় রেগে আছে। কিন্তু আন্টি, আপনি যেভাবে আমাদের পাশে দাঁড়ালেন তারপর আপনার কথা মত শ্রেয়র কাছে আপনার নামে নিন্দে করতে আমি পারবো না! ও কিছুতেই বুঝতে চাইছে না, আপনি সত্যিই প্রফেশনাল কারণে ভীষন ব্যস্ত থাকেন, কিন্তু আপনি ওকে অনেকেটা ভালোবাসেন!
আপনি চিন্তা করবেন না আন্টি আমি ওকে বলবো না, যে আপনার সাথে আমার কথা হয়েছে। আপনিই বলেছেন, ও ভীষণ একা, ওর পাশে থাকতে।
ফোনটা কট করে কেটে দিলো শ্রেয়।
তারমানে ওই মহিলা ডোনাকে ফোন করে বলেছে, যে শ্রেয়র কাছে ওর নামে ডোনা যেন নিন্দে করে!
কিন্তু কেন? শুধু শ্রেয় ভালো থাকবে বলে!
শ্রেয় তো ওর সবচেয়ে বড় শত্রু, তারপরেও কি করে...
কেনই বা বাড়িতে একটা বিপদের গন্ধ পেয়েই আগে শ্রেয়কে গার্ড করতে চাইছে মহিলা?
বেশ কিছু এলোমেলো প্রশ্ন ঘুরছিল শ্রেয়র মাথায়।
ঠিক সেই সময়েই বাইরের দরজাটা খুলে গেল। বাবা ঢুকে বললো, তোমার মা নিজেই থানায় যাচ্ছে। নাহলে ওই পেশেন্ট পার্টির লোক এসে বাড়িতে হামলা করেছে। আপাতত পুলিশ এসে সামলেছে ব্যাপারটাকে। তুমি কদিন বাড়ির বাইরে বেশি যেও না।
বাবা চলে গেল।
শ্রেয়র সব ওলটপালট হয়ে যাচ্ছিল।
মহিলার আলমারির একটা পাল্লা খোলা রয়েছে দেখেই নিষিদ্ধ জিনিস দেখার নেশার মতই সেদিকে এগোলো ও।
আলমারির গোটা তাক জুড়ে শ্রেয়র সেই ছোটবেলার বাতিল ছোট ছোট জামা প্যান্ট, ভাঙা খেলনা। এগুলো এই মহিলা জমিয়ে কেন রেখে দিয়েছে? অর্থের পাহাড়ে বসে এই মহিলা এসব ভাঙা খেলনা, শ্রেয়র পুরোনো ড্রয়িং বুক, নার্সারির রেজাল্ট এসব কেন জমিয়ে রেখেছেন? এত ব্যস্ততার মধ্যে এগুলো এত গোছানো রয়েছেই বা কি করে!
অদ্ভুত আগ্রহে গোটা আলমারিটা ঘেঁটে ফেললো শ্রেয়।
সবই ওর ছোটবেলার জিনিস। ওর প্রথম অক্ষর লেখার খাতাটা পর্যন্ত রয়েছে।
বাইরে পায়ের আওয়াজ পেয়েই দ্রুত হাতে বন্ধ করলো আলমারিটা।
অরুন্ধতী নিজের ঘরে ঢুকে ক্লান্ত গলায় বলল, বাইরে এ কদিন বেশি বেরোবে না। আমি আসছি।
শ্রেয়র গলার কাছে একটা অন্যরকম কষ্ট দলা পাক্কাচ্ছে। এই কষ্টের হদিস ও সতেরো বছর নয় মাসেও টের পায়নি। আজ হঠাৎ কেমন একটা অন্যরকম ফিলিংস হচ্ছে ওর। খুব ইচ্ছে করছে ওই কঠিন, অহংকারী মহিলাকে মা বলে ডাকতে। কিন্তু দীর্ঘদিনের অনভ্যাসে কিছুতেই ডাকতে পারছে না ও। জিভটা আড়ষ্ট হয়ে রয়েছে। বার দুই চেষ্টা করে ও বললো, তুমি কোথায় যাচ্ছ?
অরুন্ধতী বললো, আপাতত থানায় যাচ্ছি। এই মুহূর্তে পেশেন্ট পার্টি ক্ষেপে আছে। ওরা একটা লস্ট কেস এনেছিল। আমি চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারিনি। কিন্তু যেহেতু অপারেশন টেবিলে মারা গেছেন, তাই দোষ তো সার্জেনেরই হবে। আপাতত থানায় যাই, কালকে ওনার মেডিকেল রিপোর্টগুলো এলে সত্যিটা প্রমান হয়ে যাবে।
আমি খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো। আর যেটা বললাম মনে রাখবে, বাবার কথা শুনবে। বাবাকে তো তুমি ভালোবাসো। বাড়ির বাইরে বেরোবে না এই দুদিন।
মোবাইল, চার্জার এগুলো একটা হ্যান্ড ব্যাগে গোছাচ্ছিলো অরুন্ধতী।
শ্রেয় ধীর পায়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
ডাইনিং হলে দুজন পুলিশ অফিসার বসে বাবার সাথে কথা বলেছিলেন।
ওর হঠাৎই কেমন একটা কান্না পাচ্ছিলো। নিজের ঘরে ঢুকে পড়ল শ্রেয়।
ঠিক সেই সময় ওর ঘরের বিছানায় ফোনটা বাজছিলো।
ডোনার কল।
রিসিভ করতেই ডোনা বললো, নিউজটা দেখেছিস? আন্টির নামে কি সব বলছে রে?
তোকে বলেছিলাম না, দেখিস, তোকে যে কষ্ট দেবে ভগবান ঠিক তাকে শাস্তি দেবে...
ডোনার কথাটা শেষ হবার আগেই শ্রেয় চিৎকার করে বললো, জাস্ট শাট আপ। আমার মায়ের নামে আর একটা কথাও বলবি না তুই।
শুনে রাখ, আমার মায়ের কোনো দোষ নেই। ডক্টর অরুন্ধতী সেনের ছুরি-কাঁচি কথা বলে, ভুলটা পেশেন্ট পার্টির, বুঝেছিস!
ডোনা হাসতে হাসতে বললো, এই শ্রেয়, আমার একটা অদ্ভুত ফিলিং হচ্ছে। আমি একটা অ্যাংরি ইয়ংম্যানের প্রেমে পড়ে যাচ্ছি। ডোনার গলায় খুশির ছোঁয়া।
ফোনটা রেখেই নিজের ঘরের আলমারি খুললো শ্রেয়। আজ থেকে বছর পাঁচেক আগের একটা গ্রিটিংস কার্ড বের করলো। কাঁচা হাতের আঁকা। একজন মহিলার ছবি, যারা গলায় টেথোস্কোপ, ডান হাতে একটা ব্যাগ আর বাঁ হাত দিয়ে ধরে আছে একটা বাচ্চা ছেলের হাত। নিচে লেখা হ্যাপি মম'স ডে।
কার্ডটা ওদের স্কুলে একবার আঁকিয়ে ছিল। নিজের নিজের মায়ের ছবি এঁকেছিল সব ক্লাসের ছেলেরা। বলেছিল, বাড়ি ফিরে সবাই নিজের মাকে দেবে। শ্রেয় নিজের আলমারি বন্দী করে রেখেছিল।
হাতে একটা ছোট্ট ব্যাগ নিয়ে ধীর পায়ে দুজন পুলিশের সাথে হেঁটে যাচ্ছে ডক্টর অরুন্ধতী সেন।
ধ্রুবজ্যোতি সেনের চোখে দুশ্চিন্তার ছায়া। অরুন্ধতী ধ্রুবর হাতটা ধরে বলল, টেনশন করো না। তোমার এমনিতেই প্যানিক এট্যাক হয়। রাতে শোয়ার আগে প্রেশারের ওষুধটা খেও বুঝলে? আর ছেলেটাকে দেখো। বাইরে যেতে দিও না একদম।
পুলিশ অফিসার বললেন, মিস্টার সেন ডোন্ট ওয়ারি। আমরা জাস্ট ওনার প্রোটেকশনের ব্যবস্থা করছি। কাল,পরশুই ওনাকে বাড়িতে ফিরিয়ে দিয়ে যাবো।
পিছন থেকে শ্রেয় ডেকে উঠলো, মা...
থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে ডক্টর সেন।
ঠিক শুনলেন কি?
শ্রেয় পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, মা এটা তোমার জন্য।
হাতের কার্ডের দিকে তাকিয়ে অরুন্ধতী সেন কোনো কথা বলতে পারল না। ওর ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠলো। অস্ফুটে বললো, সরি। আমি তোকে সত্যিই একটুও টাইম দিয়ে উঠতে পারিনি।
শ্রেয় কান্নাভেজা গলায় বলল, তাড়াতাড়ি ফিরে এসো মা।মিস ইউ।
ধুর বোকা ছেলে , এত বড় ছেলে কখনো কাঁদে। ওড়নাটা দিয়ে শ্রেয়র চোখটা মুছে দিয়ে এগিয়ে চললেন ডক্টর অরুন্ধতী সেন। তখনও কানের মধ্যে অনুরণন হয়ে চলেছে একটাই শব্দ, মা....
- অর্পিতা সরকার
Comments
Post a Comment