হাম আপকে দিল মে রাহেতে হ্যাঁয় পর্ব -2
সেইদিনের পর প্রায় এক মাস কেটে গেছে | অনিন্দর দ্দজাল বৌয়ের স্ক্রিপ্ট লেখা এখন শেষের পর্যায়ে | আর কিছুদিন বাদেই সেটা ও তিলোত্তমার হাতে ধরিয়ে দেবে | তারপর ফাইনাল পারফর্মেন্স এই মেয়েটার ওপরই ডিপেন্ড করছে ! তবে ততদিন অব্দি তো ওর আসল আমিটাকে নিয়েই এই বাড়িতে থাকতে হবে | কিন্তু এই 'আসল' আমিটাকে অনিকেত এই কদিন খেয়াল করে নিজের প্রথম দিনের কল্পনার সাথে ঠিক মেলাতে পারেনি যেন ! মেয়েটা যতটুকু দরকার তার থেকে বেশি একটা শব্দও বলে না কখনো | মাঝে মাঝে তো এটাও বোঝা যায় না একই ঘরে আছে না নেই ! চুপচাপ নিজের মতন নিজের সাথে থাকে সারাদিন | তবে এর মধ্যে ওর মায়ের ওষুধ কখন কি খাওয়াতে হবে এইসব কেমন মুখস্ত হয়ে গেছে তিলোত্তমার | অনিকেত খেয়াল করেছে ও নিজে ভুলে গেলেও তিলোত্তমা চুপচাপ রাত্রিবেলা গিয়ে ঠিক ওষুধগুলো বুঝিয়ে শুনিয়ে হলেও খাইয়ে দেয় ওর মা কে | আর মা ও নিজের ছেলে কথা না শুনুক , এই বাইরের মেয়ের সব কিছুতেই ঘাড় দুলিয়ে হ্যাঁ বলে দেয় | আর আজকাল তো ওর মা অনিকেতকে মাঝে মাঝেই একটা কথা বলে , উনি না কি ভাবতে পারেনি অনিকেত এরকম একটা মেয়েকে পছন্দ করে নিয়ে আসবে ! তিলোত্তমা না কি খাঁটি মেয়ে | অনিকেতের মা নিজের সারা জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে চার সপ্তাহ দেখে এই ব্যাপারটা আবিষ্কার করেছে | কথাটা ভাবলেই যদিও ওর হাসি পায় মাঝে মাঝে | মায়ের মতন সরল মানুষ তো মনে হয় চোর , ডাকাত , ক্রিমিনালের মধ্যেও কিছু একটা ঠিক ভালো খুঁজে বার করবে ! এ তো তাও তিলোত্তমা ! আসলে সব সময় নিজের সাদা চোখ দিয়ে পৃথিবীটাকে দেখলে যা হয় | তবে অনিকেত এরকম না | ও চোখ কান সব সময় খোলা রেখে চলারই মানুষ | তো যাই হোক , এইভাবেই দিন গুলো এগোচ্ছিল | তবে সেদিন হঠাৎ অনিকেত রাত্রে অফিস থেকে ফিরে মায়ের ঘরের সামনে এসে একটু থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো | মা তিলোত্তমার সামনে নিজের গয়নার ঝাঁপি খুলে বসেছে | শাশুড়ির থেকে পাওয়া সীতা হার থেকে শুরু করে বংসের পর বংসে পায় গয়না , আবার এখনকার ডিজাইনের জুয়েলারিও , সব বসে বসে গল্প করে করে দেখাচ্ছে মেয়েটাকে | অনিকেত তো এই দৃশ্য দেখে হাঁ ! মানে মা কি কখনো , ফর এ চেঞ্জ একটু বুদ্ধি খাটিয়ে চলতে পারে না জীবনে ! একটা বাইরের মেয়ে যে দুদিন হলো এই বাড়িতে এসেছে , তাকে একেবারে সব উজাড় করে দেখাতেই হবে | যতই ওকে নিজের বৌমা ভাবুক , আসল কথা কিছু না জানুক , তা ও পৃথিবীর কোন শাশুড়ি নিজের বৌয়ের সাথে দুদিনেই এতো ফ্রেন্ডলি হয়ে যায় ভগবান জানে ! কিন্তু এখন কি বলেই বা মা কে থামাবে অনিকেত ! কিছুই বুঝতে পারছে না | এইসব আকাশ পাতাল চিন্তার মধ্যেই আবার কানে এলো ওর মায়ের আরো একটা বিখ্যাত ডায়ালগ ,
-- " তিলোত্তমা , তোর এইসব গয়নার মধ্যে যেটা পছন্দ হয় নিয়ে নে | ভাগ্যিস তুই এলি | নইলে এইসব গয়না তো আমার আলমারিতে পরেই থাকতো সব সময় ! আমার তো আর সাজার বয়স নেই | কিন্তু তোকে এতো মিষ্টি দেখতে , যে গয়নাই পড়বি দারুন সুন্দর লাগবে |"
না , অনিকেত এই কথাগুলো আর নিতে পারলো না | মা এবার সত্যি লিমিট ক্রস করে ফেলেছে | এবার চেন টানতেই হবে ট্রেনের | এইসব ভেবেই বেশ উত্তেজিত হয়ে দরজার আড়াল থেকে নিজেকে বের করে ঘরে ঢুকতে যাচ্ছিলো , কিন্তু তখনই আবার থমকে গেলো , তিলোত্তমার কথা শুনে | ও এর মধ্যেই অল্প হেসে মা কে উত্তর দিলো
- " আমার তো সব গয়নাই খুব পছন্দ তোমার | কিন্তু এইসব আমার কাছে রাখলে নিজেরই খুব ভয় লাগবে | আসলে কখনো এইসব সোনা টোনা সামলে রাখিনি তো আগে নিজে, তাই অভ্যাস নেই | এর থেকে এই ভালো | এইসব তোমার আলমারিতেই থাক | আমার যদি কখনো কোনো বিয়ে বাড়ি , অনুষ্ঠানবাড়ি পরে তখন নয় চেয়ে পরবো | "
অনিকেত তো অবাক হয়ে গেলো এসব শুনে | তিলোত্তমা কেমন বুদ্ধি করে কাটিয়ে দিলো তো বেশ ওর মা কে | আর চোখের সামনে এতো গয়না দেখেও কোনো কিছু নিলো না এই মেয়েটা ! অদ্ভুত তো ! কথাগুলো মনে নিয়েই সেইদিন রাত্রে বেশ নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছিলো ও | এতদিনে মনে হচ্ছে এই মেয়েটাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করা যায় হয়তো | নইলে এই এক মাস একটু হলেও টেনশন নিয়েই অফিস যেত রোজ |
আসলে এরকম একজন বার ডান্সার চব্বিশ ঘন্টা বাড়িতে , তা ও আবার ওরই ঘরে ! আলমারিতে তো মাঝে মাঝেই ক্যাশ রাখতে হয় | যদি কিছু এদিক সেদিক করে দেয় কখনো ! তাই রোজ নিয়ম করে অফিস থেকে ফিরে সব কিছু চেক করতো মন দিয়ে | তবে আজকের দৃশ্য দেখার পর রাতের ঘুমটা একটু শান্তিতে হলো অনিকেতের | কিন্তু রাতের স্বপ্ন ভেঙে সকাল হতেই সব শান্তি হঠাৎ উধাও হয়ে গেলো ওর | মায়ের ঘর থেকে একটা আংটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না না কি ! কাল গয়না দেখানোর পর সব কিছু তো দেখেই ঢুকিয়েছিল আলমারিতে ! তাহলে কি আংটিটা রাখতে ভুলে গেলো ! মনের ভুলে সেটা কি এদিক সেদিক রেখে দিয়েছে কোথাও ! কিছুতেই মনে করতে পারছে না এখন | তবে এতদিন ধরে এইসব গয়না ঘাঁটাঘাঁটি করছেন উনি | কখনো তো এরকম কোনো ভুল হয়নি আগে ! তাহলে কাল হঠাৎ কি করে আস্ত একটা আংটি হঠাৎ হারিয়ে ফেললো ! কথাটা যেন কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না ওনার | তবে অনিকেতের মাথায় সবটা পরিষ্কারভাবে ঢুকে গেছে এতক্ষনে | তার মানে এই জন্যই কাল মা কে ডিরেক্টলি গয়না নেয়ার জন্য না বলেছিলো তিলোত্তমা | কারণ জানতো , অনিকেতের মা যদি ওকে কোনো গয়না দিয়েও থাকে , তাহলে সেটা অনিকেতের কানে ঠিক যাবে | আর তারপর নিশ্চয়ই সেই গয়না ও আর লকারে সাজিয়ে রাখতে পারবে না ! অনিকেতকেই আবার ফেরত দিতে হবে | তাই অবশেষে চুরি | অসাধারণ বুদ্ধি বলতেই হবে | তবে চালে ওর একটাই ভুল হয়ে গেছে , যে অনিকেত দরজার আড়ালে থেকে কাল মায়ের গয়না দেখানোর পুরো পর্বটা নিজের চোখে দেখেছে , এটাই ও খেয়াল করেনি | সেই জন্য প্ল্যানটা সাকসেসফুল হলো না ! কথাটা ভেবেই মেয়েটার প্রতি এই এক মাসে যতটুকু রেসপেক্ট এসেছিলো মনে , সব চলে গেলো | ভেতরে ভেতরে একটা রাগ এসে জমা হলো ওর উল্টে | তবে আজ বেশ ঠান্ডা মাথায় অনিকেত তিলোত্তমার সামনে গেলো | যদিও আজকের ওর দৃষ্টিটার মধ্যে কেমন যেন একটা নোংরা নজর লুকিয়ে ছিল , যেটা তিলোত্তমাও খেয়াল করলো | তাই নিজে থেকেই ও প্রশ্ন করে উঠলো ,
- " কি হয়েছে ? আপনি কি কিছু বলতে চান আমাকে ?"
কথাটা শুনে অনিকেত কয়েক সেকেন্ড সময় নিলো | তারপর কিছু কথা সাজিয়ে আস্তে গলায় বেশ দৃঢ়ভাবে বললো,
--" আংটিটা চুরি করে কোনো লাভ হবে না | আমি সব জানি | কাল মা তোমাকে নিজের সব গয়না দেখাচ্ছিল সেই দৃশ্য আমি চোখ ভোরে দেখে নিয়েছিলাম অফিস থেকে ফিরেই | তবে তুমি চুরি করবে অনেস্টলি ভাবিনি এতটা ! যাই হোক , অবাকও হইনি কিছু | তোমাদের মতন মেয়েরা টাকার জন্য সব করতে পারে জানি | তবে আংটিটা আজ অফিস থেকে ফিরে আসার আগে নিজে থেকে গিয়ে মা কে দিয়ে এস | নইলে আমি কিন্তু আর ওয়েট করবো না | তারপর যা করার পুলিশ করবে | "
তিলোত্তমা এসব শুনে এই প্রথম নিজের হয়ে কিছু বললো অনিকেতকে | কারণ আর চুপ থাকা সম্ভব না | ও জোর দিয়েই তাই বললো , -------- " হ্যাঁ , টাকার জন্য আমি সত্যি অনেক কিছু করতে পারি , কিন্তু চুরি না | আমি কোনো আংটি নিইনি , তাই সেটা ফেরতও দিতে পারবো না |"
অনিকেতের এবার ঠান্ডা মাথায় রাগ এসে হাজির হলো | কতটা সাহস এই মেয়েটার ! প্রথমে চুরি করেছে , এখন আবার মিথ্যা কথা বলছে ! ও তাই এবার নিজের গলার ভলিউমটাকে বাড়িয়েই বললো , -------- " বুঝেছি , তুমি এতো সহজে ভাঙবে না | আমি এই কাজটা কিন্তু করতে চাইনি | বাট ইউ ফোর্সড মি টু ডু দিস ... " .
কথাটা কমপ্লিট করেই ও সোজা তিলোত্তমার আলমারিটা খুললো | তারপর ওর শাড়ি গুলোকে এক এক করে টান মেরে মাটিতে ফেলে আলমারিটা হাঁতড়াতেতে শুরু করলো আংটিটার জন্য | কিন্তু প্রায় দশ মিনিট ধরে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কিছু পেলো না হাতে | তখন ওর সুটকেসটার দিকে চোখ গেলো অনিকেতের | সেটাও খুলে জিনিসপত্রগুলোকে সব মাটিতে ফেলে বেশ কিছুক্ষন ধরে আংটিটা খোঁজার চেষ্টা করলো | কিন্তু কিছুতেই আংটির একটা চিহ্নও হাতে এলো না ওর | এইসবের মধ্যে যেন মাথা কাজ করছে না এখন | বুঝতে পারছে না যে মেয়েটা ঠিক কোথায় লুকিয়ে রেখেছে ওই আংটি ! তাই রাগে নিজের সমস্ত ধৈর্য হারিয়ে ফেললো অনিকেত | ও এবার ঝটকা মেরে তিলোত্তমাকে নিজের কাছে টেনে নিলো , তারপর ওর হাত দুটোকে খুব শক্ত করে ধরে দাঁতে দাঁত পিষে জিজ্ঞাসা করলো , -
------ " আংটিটা কোথায় রেখেছো বলে দাও নিজে থেকে | নইলে আমি সিরিয়াসলি পুলিশ ডাকবো এবার | এন্ড আই ডোন্ট কেয়ার মা আমাদের ব্যাপারে সব জেনে গেলে কিভাবে রিয়্যাক্ট করবে ! কিন্তু ওই রিয়্যাকশনের ভয়ে আমি কখনো একটা চোরকে চব্বিশ ঘন্টা নিজের বাড়িতে রাখবো না |"
তিলোত্তমা এবার যেন ঠিক উত্তর দিতে পারলো না | এতক্ষন ধরে এতকিছু দেখে কেমন একটা থমকে গেছে ও ! তা ও দু সেকেন্ড সময় নিয়ে নিজেকে একটু সামলে দৃঢ় গলায় বললো ,
--------" আমি কোনো আংটি নিইনি | প্লিজ বিশ্বাস করুন |" .
কথাটা শেষ হতেই অনিকেতের রাগ আরো বেড়ে গেলো | ও তিলোত্তমার হাতটাকে ছেড়ে দিয়ে এবার পকেট থেকে মোবাইলটা বার করলো | পুলিশ এ ফোন না করলে এই মেয়ের মুখ থেকে কিছু বেড়োবে না | কথাটা ভাবতে ভাবতেই ও ওর একজন চেনা পুলিশ অফিসারের নাম্বারটা ডায়েল করলো , তবে কলটা কানেক্ট হওয়ার আগেই হঠাৎ নিচে বসার ঘর থেকে একটা চেঁচামিচির আওয়াজ কানে এলো | অনিকেত আওয়াজটা শুনে ফোনটা ডিসকনেক্ট করে নিচে যেতেই অবাক ! ওদের বাড়িতে অনেকদিন ধরে কাজ করে সুলগ্না মাসি , তার হাতে আংটিটা ধরা | আজ সকালে ওর মায়ের ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে মেঝে থেকে আংটিটা খুঁজে পায় | কিন্তু অতো দামি আংটি দেখে নিজেকে আর সামলাতে পারেনি | ছেলেটার অনেকদিন ধরেই জ্বর | ডাক্তার দেখানোর টাকা জোগাড় হয় না ! সেখানে আজ হঠাৎ এতো টাকার আংটি হঠাৎ হাতে পেয়ে কিছুক্ষনের জন্য টাকার স্বপ্নে হারিয়ে গেছিলো ও | তাই চুপচাপ বাড়ি চলে গেছিলো আংটিটা আঁচলে বেঁধে নিয়ে | কিন্তু গরিব হলেও চোর হতে মন সায় দিলো না কিছুতেই | তাই নিজের সাথে অনেক খারাপ ভালোর যুদ্ধ চালিয়ে ও অবশেষে আবার আংটিটা ফেরত দেয়ার জন্যই ছুটে এলো এই বাড়িতে |
ঘটনাটা শুনে অনিকেত সেই সময় একেবারে নিশ্চুপ ছিল | কিভাবে রিয়্যাক্ট করবে এখন ঠিক বুঝতে পারছে না যেন | তবে বাড়ির অন্য কাজের লোক , স্টাফেরা এখন সুলগ্না মাসিকে পুলিশে দেয়ার কথা বলেই চিৎকার করে যাচ্ছে | কিন্তু এই সময় হঠাৎ ওর মা সবাইকে চুপ করিয়ে দিয়ে সুলগ্নাকে জড়িয়ে ধরলো নিজে থেকে | তারপর আস্তে গলায় বললো ,
--------- " ভুল সবাই করে | কিন্তু নিজের ভুল বুঝে ঠিক কাজটা খুব কম লোকই করতে পারে | আর তোর ছেলের জ্বর হয়েছে সেটা এতদিন বলিসনি কেন ? আমাদের বাড়িতে এতদিন কাজ করিস , আমরা কি কেউ নোই ! আজই তোর ছেলেকে ডাক্তার দেখানোর ব্যবস্থা করে দিচ্ছি | তুই এইসব নিয়ে একদম চিন্তা করবি না | আর যখন যা দরকার লাগবে সোজা এসে আমাকে বলবি | বুঝলি | "
কথাটা শেষ করে উনি সুলগ্নাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে বেশ কিছু টাকাও ধরিয়ে দিলো জোড় করে | আসলে অভাব খুব ভয়ঙ্কর | সেটা ঠিক মানুষকে দিয়েও ভুল কাজ করিয়ে নিতে পারে ! কিন্তু তার মানে মানুষটা খারাপ হয়ে যায় না | এটা অনিকেতের মা জানে | তাই সুলগ্নার ওপর কোনো রাগই হয়নি ওনার |
তবে অনিকেতের এখন ভীষণ রাগ হচ্ছে হঠাৎ , নিজের ওপর | কিভাবে আবার নিজের ঘরে যাবে বুঝতে পারছে না ও ! আসলে আবার না বুঝে যেইভাবে ব্যবহার করলো আজ ওই মেয়েটার সাথে , এরপর সত্যি ওকে ফেস করা কঠিন | তাই কিছু না ভেবে পেয়ে চুপচাপ নিজের অফিসেই চলে গেলো সোজা এরপর | কিন্তু আজ সকালের ঘটনাটা যেন হাজার কাজের ভিড়েও ভুলতে পারলো না কিছুতেই | এতটা ইনসেন্সিটিভলি বিহেভ করেছে ও ! ভেবে নিজেরই লজ্জা লাগছে | এমন কি তিলোত্তমার আলমারি সুটকেস খুলে সমস্ত জামা কাপড় অব্দি ঘরে ছড়িয়ে দিলো ! এতটা রুড কি করে হলো ও একজনের সঙ্গে ! এরকম তো আগে ছিল না অনিকেত | কারোর ওপর রাগ হলেও কখনো এরকম লেভেল এর অপমান করেনি কাউকে | তাহলে কি দু বছর আগের ওই একটা ঘটনায় ওকে এতটা বদলে দিয়েছে ! ও কি সত্যি আজকাল কোনো কিছু সোজা চোখে দেখতেই পারে না ! সব মানুষের মধ্যেই কিছু খারাপ , কিছু নেগেটিভ খুঁজে বেড়ায় ! নিজের এই বদলে যাওয়া স্বভাবের কথা ভেবে নিজেকেই কেমন চিনতে অসুবিধা হচ্ছে আজকে ওর | যাই হোক , এইসব সাত পাঁচ ভাবনার ভিড়েই রাত নেমে এলো শহরে | অনিকেত তিলোত্তমাকে ফেস করতে চায় না বলেই ইচ্ছে করে রাত দশটার পর বাড়ি ফিরলো | তবে নিজের ঘরে গিয়ে হঠাৎ থমকে গেলো | ঘরটা এই মুহূর্তে খালি | তিলোত্তমা তো দশটা বাজতে না বাজতেই ঘুমিয়ে পরে ! তাহলে আজকে কি হলো ! কোথায় গেলো মেয়েটা ! কথাটা ভাবতেই খেয়াল হলো বাইরে এই সময়ে খুব জোড়ে বৃষ্টি শুরু হয়েছে | এটা দেখে হঠাৎ মনে হলো তিলোত্তমা তো মাঝে মাঝে একা গিয়ে ছাদে দাঁড়িয়ে থাকে | যেন কত আকাশ পাতাল ভাবে এক মনে | আজও সেরকম নয় তো ! কথাটা মনে হতেই অনিকেত সোজা ছাদে গিয়ে হাজির হলো | তবে এখানে এসে আবার একটু অবাক হয়ে গেলো ও | দূরে তিলোত্তমা দাঁড়িয়ে একা , এক মনে ভিজে ভিজে কি যেন ভেবে চলেছে ! অদ্ভুত তো ! বৃষ্টির মধ্যে এইভাবে দাঁড়িয়ে আছে কেন মেয়েটা ! কথাটা মনে হতেই ওর সকালের ব্যবহারটা মনে পড়লো এই মুহূর্তে | কাউকে চোর তকমা দেয়াটা সত্যি খুব অপমানের | হয়তো সেই ঘটনাটা ভুলতে পারেনি ও ! এইসব ভাবনার ভিড়ে অনিকেত নিজেও আর দাঁড়িয়ে রইলো না এক জায়গায় | ও বৃষ্টির মধ্যেই তিলোত্তমার কাছে গিয়ে খুব আস্তে গলায় বললো এবার , -
---------- " আই এম সরি .. আজ সকালের জন্য | আমার সত্যি সারাদিন খুব খারাপ লেগেছে নিজের বিহেবিয়ারের কথা ভেবে | আমি না বুঝে !" .... না , কথাটাকে ওর আর কমপ্লিট হতে না দিয়ে এবার তিলোত্তমা বলে উঠলো একটু শান্তভাবে , -
--------- " সরি বলার দরকার নেই | আমার অভ্যেস আছে | একজন বার ডান্সার তো ! সম্মান কেউ খুব একটা করে না আমাদের | আর এটা নতুন কিছু না |"
কথাটা শেষ করেই তিলোত্তমা আর দাঁড়ালো এখন অনিকেতের সামনে | ছাদটা খালি করে দিয়ে চলে গেলো নিচে | তবে অনিকেত বেশ কিছুক্ষন একভাবে থমকে রইলো যেন ! তিলোত্তমার কথার মধ্যে হয়তো নিজের এতদিনের চিন্তাধারার একটা আয়না দেখতে পেলো হঠাৎ | যেখানে নিজেকে কেমন কুৎসিত , স্টিরিয়োটাইপ মনে হলো ! যে হয়তো শুধু বাইরেটাই বিচার করে | ভেতরটা দেখতে জানে না একদম |
এরপর কয়েকটা দিন কেটে গেলো অদ্ভুত একটা নিঃস্তব্ধতায় | তিলোত্তমা আর অনিকেতের মাঝে মাঝে আগে দরকারে যে টুকটাক কথা হতো , আজকাল আর তাও হয় না | তিলোত্তমা যতটা সম্ভব এই ঘরে এলে অনিকেতকে এভয়েড করার চেষ্টা করে | আর অনিকেতেরও সেইদিনের পর নিজের ব্যবহারের জন্য নিজের মধ্যেই কেমন একটা লজ্জা তৈরী হয়েছে | তাই ও নিজেও আর তিলোত্তমাকে ঠিক ফেস করতে পারে না | তবে অনিকেত খেয়াল করেছে এসবের কোনো এফেক্ট কিন্তু তিলোত্তমা এই ঘরের চার দেয়ালের বাইরে কাউকে কখনো বুঝতে দেয় না | মায়ের সামনে সব সময় হাসি মুখেই ঘোরাফেরা করে | তখন অনিকেতের সাথেও সহজভাবে কথা বলে | তবে ঘরে এলেই এমনভাবে থাকে যেন দুজন পুরো অচেনা মানুষ | যাই হোক , এর মধ্যে অনিন্দ আবার একটা ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল এটেন্ড করতে জার্মানি চলে গেছে স্ক্রিপ্ট লেখা মাঝ পথে ছেড়ে | তাই দর্জাল বৌ এর ডায়লগ রেডি হতে এখনো কিছুদিন ওয়েট করতে হবে ওদের | সেদিন এইসব ভাবতে ভাবতেই অফিস থেকে বাড়ি ফিরছিলো অনিকেত | আজ রাত সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে ওর | অফিসে নতুন প্রজেক্টের জন্য এখন ভালো চাপ | এর মধ্যে পার্সোনাল লাইফেও এতো ঝামেলা ! এইসব রিয়্যাল লাইফ নাটক আর কতদিন কার পোষায় ! তার মধ্যে তিলোত্তমা আর ও একই ঘরে থেকেও দুটো শব্দ বলে না দুজনে দুজনকে | তবে এই নিঃস্তব্ধতা নেয়াটা আরো চাপের | এর থেকে অনিকেতকে যদি ওর সেইদিনের ব্যবহারের জন্য তিলোত্তমা দুটো উল্টো পাল্টা কথা শুনিয়ে দিতো , তাহলে ব্যাপারটা অনেক সহজ হতো ওর কাছে | এই মেয়েটা সত্যি অদ্ভুত ! ওর বোঝার বাইরে একদম | আজকাল মাঝে মাঝেই এইসব মনে হয় ওর | আসলে এতো অদ্ভুত একটা পার্সোনালিটি , কিছু না বলেও যেন অনেক কিছু বুঝিয়ে দিতে পারে তিলোত্তমা | অনিকেতের এইসবের জন্য এক এক সময় ইচ্ছে হয় , এই মেয়েটাকে একটু জানতে , ওর সঙ্গে কিছু কথা বলতে | তবে সেসব আর হয়ে ওঠে না কখনো | আসলে ওদের মধ্যে একটা অদ্ভুত কাঁচের দেয়াল আছে | যেটা ভেদ করা অনিকেতের পক্ষে সম্ভব না | আর তিলোত্তমাকে এতদিনে যা বুঝেছে , সে নিজেও এই দেয়ালটা ভাঙতে দেবে না কোনোদিন | আর ঠিকই | অনিকেত প্রথম থেকে নিজের যেরকম রূপ দেখিয়েছে , তারপর ওর সামনে কখনোই সহজ হওয়া যায় না | আর হয়তো তিলোত্তমা ওকে খুব খারাপ , মেজাজি , রাগী , ইনসেন্সিটিভি একটা মানুষ ভাবে ! তাই এরকম অচেনা সেজে থাকে সারাক্ষণ | তবে এইসব ভাবনাগুলো ভেবে আজকাল অনিকেতের নিজের খুব অবাক লাগে নিজেকে নিয়ে ! কোনো মেয়ে ওকে চিনলো কি চিনলো না , এইসব নিয়ে ওর কখনো এতো চিন্তা আসবে মনে , এতো থিওরি সাজাবে নিজে নিজে , এটা এই দু বছরে আসলে কখনো মনে হয়নি ! এতদিন তো নিজেকে খুব হিসেবি করে রাখতো | তবে আজকাল এই মেয়েটাকে দেখে যেন একটু বেহিসেবিভাবে ভেবে ফেলে অনিকেত মাঝে মাঝে ! এইসব এলোমেলো ভাবনার ভিড়েই সেদিন গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরছিলো , তবে বাড়ির সামনের রোডটায় এসেই হঠাৎ খেয়াল করলো রাস্তার পাশ দিয়ে তিলোত্তমা চলে গেলো হঠাৎ | একটু যেন দৌড়েই রাস্তাটা ক্রস করলো ও | এই দৃশ্য দেখে অনিকেত গাড়িটা দাঁড় না করে পারলো না ! এতো রাতে এই মেয়েটা কোথায় যাচ্ছে এরকম হন্ত দন্ত হয়ে ! এর আগেও ও সপ্তাহে তিনদিন বেরোতো | তবে সেটা সন্ধ্যের সময় | এইসব চিন্তার ভিড়েই ও গাড়ি থেকে নেমে দেখলো ভিড় রাস্তার উল্টো দিকে তিলোত্তমা দাঁড়িয়ে | কেমন যেন এলোমেলো লাগছে ওকে | রাস্তা দিয়ে চলে যাওয়া হলুদ ট্যাক্সিগুলোকে হাত নেড়ে নেড়ে থামানোর চেষ্টা করছে প্রানপনে | এইসব দেখে অনিকেত আর দাঁড়িয়ে থাকল না | নিজেই গাড়ি ঘুরিয়ে রাস্তা ক্রস করে তিলোত্তমার সামনে গিয়ে হাজির হলো | তারপর গাড়ির কাঁচ নামিয়ে ওকে হঠাৎ দেখা দিয়ে বললো ,
---------- " কি হয়েছে তোমার ? কোথায় যাবে ? আমি নিয়ে যাচ্ছি | উঠে পরো গাড়িতে |"
কথাটা শুনে তিলোত্তমা যেন কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না ! এলোমেলোভাবে আবার রাস্তার এদিক ওদিক তাকিয়ে নিলো যে যদি কোনো খালি ট্যাক্সি পেয়ে যায় এখন ! অনিকেত বুঝতে পারলো কাঁচের দেয়ালটা তিলোত্তমাকে আটকে দিচ্ছে , অনিকেতের সাথে একই গাড়িতে উঠতে | কিন্তু অনিকেত আর সেটা হতে দেবে না | ও নিজেই এবার এই দেয়ালটা ভাঙার চেষ্টা করবে | তাই একটু জোড় দিয়ে এবার তিলোত্তমাকে বললো ,
---------- " আমি অতটাও খারাপ নোই যতটা বাইরে থেকে দেখে মনে হয় | আই রিকুয়েস্ট ইউ , প্লিজ গাড়িতে ওঠো | এইভাবে এতো রাতে তোমার একা যাওয়াটা সেফ না |"
কথাটা শুনে এবার তিলোত্তমা রাস্তা থেকে চোখ সরিয়ে অনিকেতের দিকে তাকালো | তারপর দু সেকেন্ড একটু ভেবে আর কোনো প্রশ্ন না করে উঠে পড়লো গাড়িতে | এখন সত্যি এই ছেলেটার হেল্প না নেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই | এই ভেবেই ও বলে উঠলো , -------- " বেলঘরিয়া চলুন | আমাকে এখন বাড়িতে পৌঁছতেই হবে | প্লিজ একটু তাড়াতাড়ি চলুন |"
এরপর সেদিন এক ঘন্টার রাস্তা প্রায় চল্লিশ মিনিটে পার করে অনিকেত তিলোত্তমাকে নিয়ে এসেছিলো ওর বেলঘরিয়ার বাড়িতে | এড্রেসটা ও নিজে আগে থেকেই জানতো | তিলোত্তমাকে টাকা দেয়ার আগে ওর ব্যাপারে এইসব ডিটেইলস খোঁজ লাগিয়ে জেনেছিলো প্রথমে | ওর বাড়ি কোথায় , কোন ডান্স বারে কাজ করে , এইসব | তবে ফ্যামিলির ব্যাপারে বেশি কিছু জানতে পারেনি ঠিক | এই টুকুই ইনফরমেশন ছিল যে তিলোত্তমার নিজের লোক বলতে একটা ভাই আছে শুধু ব্যাস | তবে এই ব্যাপারে অনিকেত তখন অতো ইন্টারেস্টও দেখায়নি | ওর বাড়ির সদস্য সংখ্যা জেনে কি লাভ অনিকেতের ! এটাই ভেবেছিলো | তবে আজ ব্যাপারটা উল্টো | আজ পুরো রাস্তা জুড়ে যেতে যেতে এটাই মনে হচ্ছিলো যে ঘটনাটা কি ঘটেছে ! কিছু কি প্রব্লেম হলো বাড়িতে ! নইলে এই শান্ত মেয়ে তো এতো উত্তেজনা আজ অব্দি কখনো দেখায়নি ওকে ! যাই হোক , এইসব ভাবনার ভিড়ে তিলোত্তমাদের একতলা বাড়িটার সামনে এসে গাড়িটা থামতেই তিলোত্তমা প্রায় দৌড়ে গাড়ি থেকে নেমে ওই বন্ধ দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো , তারপর জোরে জোরে দরজাটা ধাক্কা দিলো | ততক্ষনে অনিকেতও গাড়ি থেকে নেমে তিলোত্তমাদের বাড়ির দরজায় এসে হাজির | আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই একজন বয়স্ক মহিলা বন্ধ দরজার ওপার থেকে বেরিয়ে এলো ওদের সামনে | তিলোত্তমা এবার যেন খুব ঘাবড়ে গিয়েই জিজ্ঞেস করলো ,
--------- " কি হয়েছে ভাইয়ের ? আবার সেন্সলেস হয়ে গেছে না কি ? তুমি ডাক্তারকে কল করেছো দিদা ?"
প্রশ্নগুলো একসঙ্গে শুনে এবার অনিকেত বুঝতে পারলো যে কেন এতো রাতে ঐরকম এলোমেলোভাবে রাস্তার মধ্যে ট্যাক্সি খুঁজছিলো তিলোত্তমা | তবে ওর এই ভাবনার ভিড়েই সামনের বয়স্ক মহিলাটা বলে উঠলো , -
------ " হ্যাঁ, ডাক্তার এসেছে | কিন্তু বলছে অবস্থা ভালো নয় | হসপিটালাইজ করতেই হবে এবার |"
কথাটা শুনে তিলোত্তমার যেন একটা ধাক্কা লাগলো হঠাৎ | ও ঠিক নিজের পায়ে টাল সামলাতে পারলো না ! দরজাটা ধরে দাঁড়িয়ে রইলো দু সেকেন্ড | তখন আবার উল্টো দিকের বয়স্ক মহিলাটা বলে উঠলো ,
-------- " এইভাবে ভেঙে পড়িস না | তাড়াতাড়ি ভেতরে চল | ভাইটাকে তো বাঁচাতে হবে |"
কথাটা শুনে তিলোত্তমা একটা দীর্ঘ্য নিঃশ্বাস ফেলে নিজের মনটাকে শক্ত করলো আবার | তারপর তাড়াতাড়ি বাড়ির ভেতরে পা বাড়ালো | অনিকেতও কিছু না বলে তিলোত্তমার সঙ্গে গেলো | তবে ঘরের ভেতরে এসে ও একটু থমকে গেলো হঠাৎ | সোফাটার মধ্যে একটা বছর আঠেরো ঊনিশের রোগা ছেলে সেন্সলেস হয়ে পরে আছে | মুখটা কেমন ফ্যাকাসে ! উল্টো দিকের চেয়ারটায় বয়স্ক করে একজন ডাক্তার বসে আছে | উনি তিলোত্তমাকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন , তারপর খুব টেনশনের গলায়ই বললেন .
------- " তোমার ভাইয়ের অবস্থা সত্যি খুব খারাপ | আমার মনে হয় অনেকক্ষন আগেই সেন্সলেস হয়ে পড়েছিল বাড়িতে | তোমার ওই পাশের বাড়ির দিদা রাতে খাবার দিতে এসে সাড়া না পেয়ে বুঝতে পেরেছে ব্যাপারটা | ভাগ্যিস ওনার কাছে একটা ডুব্লিকেট চাবি রেখে দিয়েছিলে তুমি ! যাই হোক , আর দেরি করা ঠিক হবে না | আমি এম্বুলেন্সকে ফোন করে দিয়েছি | চলে আসবে তাড়াতাড়ি | তুমি ওর জামা কাপড়টা গুছিয়ে দাও , আর কিছু টাকা পয়সা নিয়ে রেডি হয়ে নাও |" ..
তিলোত্তমা এইসব শুনে কিছু না বলে বসে পড়লো মাটিতে ওর ভাইয়ের হাতটা ধরে | আর এই প্রথম অনিকেত দেখলো তিলোত্তমার চোখে জল | ও হঠাৎ ডুকড়ে কেঁদে উঠলো যেন | দৃশ্যটা দেখে অনিকেতেরও ভেতর থেকে খারাপ লাগলো এখন | বুঝতে পারছে না ছেলেটার হয়েছেটা কি ! তাই আর নিজেকে আটকে রাখতে না পেরে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেই উঠলো এই মুহূর্তে ,
------------ " কি হয়েছে ওর ? কোনো বড়ো কিছু কি ?"
ডাক্তার এবার আস্তে গলায় উত্তর দিলো ,
------- " হ্যাঁ , বড়ো কিছুই | আসলে ওর হার্টে একটা ব্লকেজ আছে | অনেকদিন ধরেই | একটা অপারেশন এবার ইমিডিয়েটলি করতে হবে | নইলে হয়তো আর বাঁচানো যাবে না |"
অনিকেত কথাটা শুনে অবাক হয়ে গেলো ! এই টুকু ছেলের হার্টে প্রব্লেম ! কি করে সম্ভব ! ডাক্তার ওর এক্সপ্রেশনটা দেখে হয়তো বুঝতে পেরেছিলো ওর ভাবনাটা | তাই নিজে থেকেই আবার বলে উঠলো ,
---------- " এইসবের জন্য কোনো বয়সের দরকার হয় না | আর ওর এই হার্টে প্রব্লেমটা দু বছর আগেই ধরা পড়েছে | কিন্তু অপারেশনের খরচ অনেক | তাই প্রপার ট্রিটমেন্ট সম্ভব হয়নি | তারই মধ্যে আমি চেষ্টা করেছিলাম , যতটা মেডিসিন দিয়ে ব্যাপারটা থামিয়ে রাখা যায় | তবে এবার অপারেশন ছাড়া আর কিছু করার নেই |"
কথাটা শুনে অনিকেত থমকে গেলেও খেয়াল করলো তিলোত্তমা উঠে দাঁড়িয়েছে | তারপর বেশ দৃঢ় গলায়ই ও বলে উঠলো ,
-------- " আমি তো আছি | অপারেশন হবে ওর | আমি ব্যাগে কিছু জামা ভাইয়ের গুছিয়ে নিচ্ছি | আপনি আর একবার এম্বুলেন্সকে কল করে দেখুন কতদূর এলো !"
সেদিন এরপর আর দশ মিনিটের মধ্যে এম্বুলেন্স চলে এসেছিলো তিলোত্তমাদের বাড়িতে | তবে ভাইয়ের সঙ্গে এম্বুলেন্সে ওঠার আগে ও অনিকেতকে দেখে আস্তে গলায় বলেছিলো ,
-----" থ্যাঙ্কস আমাকে আজ বাড়ি অব্দি পৌঁছে দেয়ার জন্য | কিন্তু সরি , আমি এখন আপনার সাথে ফিরতে পারবো না | ওর অপারেশনটা মিটুক | আমি তারপর কাল চলে যাবো | আপনি আপনার মা কে কিছু একটা বলে প্লিজ একটু বুঝিয়ে দেবেন | আসছি |"
কথাটা শুনে অনিকেতের খুব অদ্ভুত লেগেছিলো এবার ! ঠিক কতটা অমানুষ ভাবলে কেউ কাউকে এই পরিস্থিতিতে এইরকম কথা বলে ! অনিকেত কি তাহলে এতটাই খারাপ ! কথাটা মনে আসতেই ও এবার একটু জোড় দিয়ে বলেছিলো ,
--------- " আসছি মানে ! আমিও তো যাচ্ছি হসপিটালে | এইভাবে এতো রাতে তোমাকে একা ছেড়ে দেব না কি ! আর কাল আমরা একসঙ্গে বাড়ি ফিরবো | মা কে যা বলার আমি বলে দেব | এখন তাড়াতাড়ি এম্বুলেন্সে যাও ভাইয়ের কাছে | আমি গাড়ি নিয়ে আসছি |"
অনিকেতের মুখে এইসব শুনে এই প্রথম আজ তিলোত্তমা অবাক হলো | নিস্পলকভাবে ওর দিকে দু সেকেন্ড না তাকিয়ে পারলো না !
যাই হোক , এরপর এম্বুলেন্স আধ ঘন্টার মধ্যেই হসপিটালে পৌঁছে গেছিলো সেইদিন | তিলোত্তমা সারাটা রাস্তা ওর ভাইয়ের হাতটা শক্ত করে আগলে রেখেছিলো আজ কেমন | মনে হচ্ছিলো ও ছেড়ে দিলেই হয়তো ভাই আর ফিরবে না | অনেকদূরে চলে যাবে কিছু না বলেই ! আসলে ছোটবেলায় ভাই হওয়ার সময়ই তো মা মারা যায় | তখন ওর কত বয়স হবে ! আট বছর | তখন থেকেই ও এইভাবে আগলে রাখতো ভাইকে | আর ভাইও তো একই কাজ করতো সারাক্ষন | বাবা যখন মদ খেয়ে এসে ঝামেলা করতো , মারতে আসতো তিলোত্তমাকে , গালিগালাচ করতো , তখন তো এই এক ভাইই ওর সামনে কেমন দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো রোজ | নিজের ছোট্ট রোগা শরীরটা দিয়ে বাবাকে আটকানোর চেষ্টা করতো প্রাণপনে | এর জন্য তো ভাইকেও কম মার্ খেতে হয়নি | ওই রাতটা আজও স্পষ্ট মনে আছে তিলোত্তমার | সেইদিন বাবার সাথে মনে হয় কারোর ঝামেলা হয়েছিল সন্ধ্যেবেলা | তাই মেজাজ আরো খারাপ ছিল | তার ওপরে মদের নেশা | তিলোত্তমার কাছে রাতে বাড়ি ফিরে জল চেয়েছিলো লোকটা | আর সেটা দিতে পাঁচ মিনিট দেরি হয়েছিল বলেই কোমরের বেল্টটা খুলে মারতে শুরু করেছিল ওকে | একবার , দুবার , বার বার মেরে মেরে ওর সারা শরীরটা লাল করে দিচ্ছিলো বাবা | সেইদিন যদি না ভাই মাঝখানে থাকতো তাহলে হয়তো নেশার ঘোরে তিলোত্তমাকে শেষই করে দিতো লোকটা ! ও আসলে নিজে অনেক চেষ্টা করেও যখন বাবাকে থামাতে পারেনি, তখন চিৎকার করে পাড়ার লোকজনকে জড়ো করে বাবাকে আটকেছিলো | যদিও ততক্ষনে তিলোত্তমা নেতিয়ে পড়েছিল পুরো | অতো মার্ খেয়ে রাতে প্রচন্ড জ্বর এসে গিয়েছিলো ওর | যন্ত্রণায় ছটফট করছিলো সারাক্ষন বিছানায় | তখন তো সারা রাত জেগে ভাই ওর পাশে বসেছিল , আর ঠিক এইভাবেই আগলে রেখেছিলো ওকে | আজ যতবার ভাইয়ের দিকে তাকাচ্ছে , ততবার শুধু ওই পুরোনো দিনগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছে ওর | ইশ , এতো শরীর খারাপ নিয়েও ছেলেটাকে এতদিন একা একা থাকতে হয়েছে বাড়িতে | ভাগ্যিস পাশের বাড়ির দিদা ছিল | ছোটবেলা থেকে দেখেছে ওদের বলেই এতো ভালোবাসে | সকাল সন্ধ্যে খোঁজ নেয় , খাবার দিয়ে যায় ভাইকে | সেই জন্যই তো তিলোত্তমা এই কাজটা নেয়ার সাহস পেয়েছিলো | তবে ওর শরীরটা যেখানেই থাক , মনটা ওর ভাইয়ের কাছেই পরে থাকতো সারাক্ষণ | আজ এইসব ভাবনার ভিড়ে কিছুতেই যেন হাত পা কাজ করছে না আর | আসলে এক এক সময় আর লড়ার শক্তি থাকে না মনে ! নিজের সব থেকে কাছের মানুষটা যখন হসপিটালের বেডে স্যালাইন , অক্সিজেন , ওষুধের ভিড়ে একটু একটু করে শেষ হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হয় , তখন হাত পা অবশ হয়ে আসে | তবে এই মুহূর্তে তিলোত্তমা খেয়াল করেছে অনিকেতকে | ওই রুড , অভদ্র লোকটা হঠাৎ কারোর বিপদ হলে কেমন ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে নিজে থেকে ! সেটা তিলোত্তমা আজ দেখলো | ব্লাড এরেঞ্জ করা থেকে শুরু করে ওষুধ কিনে আনা , অপারেশন হওয়ার আগে সমস্ত অফিসিয়াল কাগজ সাইন করা , সব কিছুই অনিকেতই করেছিল ওর হয়ে | তাই আজ হঠাৎ এই খারাপ সময় তিলোত্তমার মনে হলো কেমন , এতদিনের অচেনা লোকটা আজ হয়তো একটু চেনা হলো ওর কাছে | বার ডান্সার বলে ওকে বিশ্বাস করে না ঠিকই ! কিন্তু আজ যদি এভাবে এসে পাশে না দাঁড়াতো , তাহলে সব কিছু একা সামলাতে গিয়ে শেষ হয়ে যেতে হতো তিলোত্তমাকে |
যাই হোক , এইসব চিন্তার আড়ালেই প্রায় চার ঘন্টা কেটে গেছে হসপিটালে | এতক্ষনে অপারেশন কমপ্লিট হয়েছে ওর ভাইয়ের | আই.সি.ইউ তে শিফ্ট করার পর ডাক্তার এসে বললো যে অপারেশনটা নিতে পারলেও সেন্স আসতে এখন টাইম লাগবে | তবে সব ঠিক হলে আর প্রব্লেম হওয়ার কথা নয় | কিন্তু এরপরও রেগুলার চেকআপের মধ্যে থাকতে হবে | এইসব শুনে সেই মুহূর্তে তিলোত্তমার বুক থেকে একটা পাথর নেমেছিল যেন এতক্ষন | চোখটা ভিজে এসেছিলো জলে | ভাইটাকে এবার সুস্থভাবে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারলে শান্তি | এসবই ভাবছিলো আই.সি.ইউর বাইরে দাঁড়িয়ে , তখনই অনিকেত পাশ থেকে হঠাৎ বলে উঠলো , -
-------- " ডোন্ট ওরি , ঠিক হয়ে যাবে তোমার ভাই | কিন্তু এবার তোমার কিছু খাওয়া উচিত আই থিঙ্ক | দশ মিনিটের জন্য ক্যান্টিনে চলো | তারপর আবার এখানে চলে আসবে |" .
কথাটা শুনে তিলোত্তমার এবার খেয়াল হলো , অনিকেতও কি না খেয়ে আছে তার মানে সারা রাত ! প্রশ্নটা মনে আসতেই ও জিজ্ঞেস করে উঠলো ,
--------- " আপনি কি রাত থেকে কিছু খাননি ? ঠিকই তো | আপনি তো সারাক্ষন আমার সঙ্গেই ছিলেন ! আমি আসলে টেনশনে এই ব্যাপারটা খেয়ালই করিনি |"
অনিকেত এবার ওকে শান্ত গলায় বললো ,
---------- " খেয়াল করার পরিস্থিতি তো ছিল না | আর আমি জানি তুমি আমাকে খুবই ইনসেন্সিটিভি মনে করো | আর সেটা ভাবা স্বাভাবিক | তবে এরকম সিচুয়েশনে আমিও খাবার কথা ভাবতে পারি না |"
তিলোত্তমা এখন ঠিক কি বলবে বুঝতে পারলো না ! তা ও কয়েক সেকেন্ড ভেবে বললো ,
---------- " আপনাকে ইনসেন্সিটিভ ভাবার মতন কিছু নেই | আপনি আজ যেভাবে হেল্প করলেন ! আর সব থেকে বড়ো কথা আজ তো আমার ভাইয়ের অপারেশন আপনার দেয়া টাকার জন্যই হলো | "
কথাটা শুনে এই মুহূর্তে অনিকেত একটু অবাক হয়ে গেলো | কিছু না ভেবেই জিজ্ঞেস করে ফেললো -
--------- " এর মানে তুমি এই অপারেশনটার জন্যই এই এগ্রিমেন্টটা সাইন করেছিলে ?"
প্রশ্নটা শুনে তিলোত্তমা এবার চুপ করে রইলো কিছুক্ষন | আসলে নিজের কথা বলার অভ্যাস অনেকদিন হলো চলে গেছে ওর | কারণ কেউ কখনো শোনার জন্য , জিজ্ঞেস করার জন্য ছিলই না ! আর অনিকেতেরও ওর ব্যাপারে জানার কোনো দরকার নেই | তাই কথা ঘোরানোর জন্য বললো ,
-------- " আমাদের মনে হয় ক্যান্টিনে যাওয়া উচিত | এবার কিছু খাওয়া দরকার | চলুন |"
না , এরপর আর কোনো প্রশ্ন করেনি অনিকেত | বুঝেছিলো যে হয়তো নিজের ব্যাপারে কিছু বলতে চায় না তিলোত্তমা | আর ওর জোড় করেও লাভ নেই | আসলে এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে অনিন্দর কথাটা ঠিক | সব মেয়েরা এক হয় না | তিলোত্তমাকে আজ দেখে মনে হলো আবার সেটা | ওর বাড়িতে এরকম অসুস্থ একটা ভাই , মাথায় এতটা টেনশন নিয়ে থাকতো মেয়েটা রোজ ! কিন্তু তা ও একদিনের জন্যও নিজের এই প্রব্লেম , টেনশন , কষ্টের ব্যাপারে একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি অনিকেতের সামনে | এই মেয়েটা যেন নিজেকে আড়াল করে রাখতে পারলেই ভালো থাকে | কোনো বেশি এটেনশন , স্বান্তনা কিছুই চায় না ও | শুধু নিজের সঙ্গে নিজে থাকে | আর এই স্বভাবের জন্যই অনিকেতের মনে একটা দাগ কেটে ফেলেছে তিলোত্তমা, নিজের অজান্তেই |
- ipstita
Comments
Post a Comment