ডানা ভাঙ্গা পাখির কথা part 1
ভালোবাসার অভিশাপ
মেহেক একসময় মুম্বাই ইউনিভার্সিটির মনস্তত্বের উজ্বল ছাত্রী আজ এক নামী দামী এসকর্ট কিন্তু , আজকের এই লোকটি, সবার থেকে আলাদা। ভাই চলে যাওয়ার পরে, মৌলালীতে নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে আসার জন্য হাঁটতে শুরু করে মেহেক রফিক কিদওয়াই রোড ধরে। তখনই ফোন আসে ওর কাছে। কোমল বলে ওঠে ,"আজ সাতটার সময়ে যেতে হবে সল্টলেক। বেশিক্ষণ নয় , মাত্র তিনঘন্টা। লোকটা তিরিশহাজার দেবে তিন ঘন্টার জন্য। কোনো আলাদা ডিমান্ড নেই , শুধু কিছুটা 'ভালো' সময় কাটাতে চায়।
মেহেক ভেবেই রেখেছিলো আজ আর সন্ধেতে কিছু করবে না , একটু ফ্ল্যাটে ফিরে গিয়ে সিনেমা দেখবে চুপ করে। কিন্তু টাকার অঙ্কটা শুনে ও রাজি হয়ে যায়। একটা মেডিসিন শপ থেকে এক বাক্স কন্ডোম কিনে ওঠে ট্যাক্সিতে। ট্যাক্সিতে বসে করে ফেলে হাল্কা মেকআপ , লাগিয়ে নেয় পারফিউম, চিরুনী বের করে ভালো করে বেঁধে নেয় চুল।
লোকটার ফ্ল্যাটে আসার পরে, কিরকম যেন সব গুলিয়ে যায় মেহেকের।
সল্টলেকে এই জায়গায় আসে পাশে ফ্ল্যাট বেশি নেই , সবার নিজস্ব একতলা - দোতলা বা তিনতলা বাড়ি। এই সব বাড়িগুলো এখন অধিকাংশই দাঁড়িয়ে আছে একা একা বা কেয়ারটেকার এর তত্ত্বাবধানে। যারা বাড়িগুলো তৈরী করেছিল থাকার জন্য, একসাথে সারা পরিবার মিলে মিশে থাকার স্বপ্ন দেখেছিলো, আজ তারা এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছে কোনো এক শূন্যস্থানে। তাদের ছেলে মেয়েরা ছড়িয়ে পড়েছে দেশে বিদেশে, বিভিন্ন প্রান্তে। কাজ ব্যবসা বা অন্য কাজে খুব একটা আসতে পারে না তারা এখানে। অধিকাংশ বাড়ির বাইরের দেওয়ালে পড়েছে ফাটল, একসময়ের উজ্জ্বল রং, রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে ঝুরঝুর করে পড়ে যাচ্ছে। যেসব বাড়িতে কেয়ারটেকার আছে, তারা তাদের পরিবার নিয়ে থাকে এখানে আর বাড়িঘর পরিষ্কার রাখে। অনেক বাড়িতে আবার, ভাড়ায় থাকে লোকজন। কিছু বাড়ি করে দেওয়া হয়েছে গেস্টহাউস যেখানে বিভিন্ন কোম্পানির লোকজন এসে থাকে। কিছু বাড়িতে আবার গেস্টহাউসের নাম করে 'বিনোদনের' ব্যবস্থা করা হয়। কলেজ এর মেয়েরা আসে বি এম ডব্লিউ বা মার্সিডিজে চড়ে ; চোখে কালো সানগ্লাস, হাই হিল পরে ঢুকে যায় ভেতরে গটগট করে , দুই থেকে তিন ঘন্টা কাটিয়ে আবার ফিরে চলে যায় 'ঘন্টা'র দাম নিয়ে । মেহেক আগেও এক দুবার এসেছিলো এইরকম জায়গাতে , কলে
বেশ কয়েকটা একতলা আর দোতলা বাড়ির মাঝে দাঁড়িয়ে আছে এই পাঁচ তলার ফ্ল্যাটটা। আগে হয়তো কারোর বাড়ি ছিল এই জমিতে , বিক্রি করে দিয়েছে প্রোমোটারকে। পাঁচতলা ফ্ল্যাটের চতুর্থ ফ্লোরে, দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় মেহেক। সাতটা বাজতে তখনও এক মিনিট বাকি। কোথাও কখনও মেহেক শুনেছিলো - কোনো কাজে যেন লেট না হয়, আগে পৌঁছে যাওয়া তবুও ভালো, কিন্তু লেট একদম নয় ! কলিং বেল বাজায় !
একজন এসে ফ্ল্যাটের দরজা খোলে , সামনে মেহেককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, হাতের ঘড়িতে সময় দেখে জিজ্ঞেস করে,"ও , আপনি চলে এসেছেন ? আসুন ভেতরে। ভালো লাগলো আপনি সময়ের আগেই চলে এসেছেন। "
মেহেক ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে জিজ্ঞেস করে ওঠে, "আপনি কি করে বুঝলেন যে আমিই কল এ এসেছি? অন্য কেউ ও তো আসতে পারতো !”
একটু থমকে দাঁড়িয়ে , ঘুরে দাঁড়ায় মেহেকের দিকে। বলে ওঠে,"আমি আর কারোর জন্য অপেক্ষা করি না ; আর আমার জন্য ও কেউ আর কোথাও অপেক্ষা করে নেই। তাই....যাক গে ! ফিল ফ্রি। আপনি যদি শাওয়ার ব্যবহার করতে চান, এইদিকে আছে। আমি আপনার জন্য কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা করি। "
ভীষণ অবাক হয় মেহেক। এইভাবে তো আগে কেউ কোনোদিন ওর সাথে ব্যবহার করে নি। এই লোকটাকে প্রথম দেখাতেই ভীষণ রহস্যময় মনে হয়েছিল। এখন তো দেখছি ইনি একজন পারফেক্ট জেন্টেলম্যান ও বটে। হ্যান্ডব্যাগটা লিভিং রুমের সোফার ওপরে রেখে, হ্যান্ডব্যাগ থেকে একটা প্লাস্টিক প্যাকেট নিয়ে বাথরুমের দিকে পা বাড়ায় মেহেক। পুরো ফ্ল্যাটটা অন্ধকারে ঢাকা , শুধু বাইরের ঘরে একটা হলুদ আলোর ছোঁয়া ভেসে আসছে ওপরের ফলস সিলিং এর ফাঁকে থাকা গুচ্ছখানেক লাইট থেকে। লোকটি প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন একটা কোণে বসে আছে চুপ করে , মনে হচ্ছে কিছু ভাবছে। ওর সামনে একটা টেবিল, টেবিলের ওপরে একটা ফটো ফ্রেম রয়েছে। মাথার অবস্থান দেখে মনে হচ্ছে ওর চোখ এখন ওই ফ্রেমের ওপরে। ফ্রেমে কি আছে দেখতে ভীষণ কৌতূহল হচ্ছে , তবুও চুপ করে ঢুকে যায় বাথরুমের ভেতরে মেহেক।
গিজার অন করে গরম জলে নিজেকে বাইরের সব ধূলো ধোঁয়া থেকে পরিষ্কার করে পরে থাকা সাধারণ সালোয়ার কামিজ চেঞ্জ করে 'বেবিডল' পোশাকে নিজেকে ঢেকে , একটু হাল্কা মেকআপ করে বাইরে বেরিয়ে আসে লাস্যময়ী মীনা !
আজ মেহেকের পরিচয় মীনা।
'বেবিডল' ড্রেস গুলো এমনই যে যত না শরীর ঢেকে রাখে, তার থেকে বেশি উন্মোচন করে শরীরের ভাষা - কথা - ইশারা। প্রথম প্রথম এগুলো পরতে ওর একটু অস্বস্তি হতো ঠিকই, এখন এগুলো সব জলভাত হয়ে গেছে।
মীনা বাইরে এসে হেসে বসতে যায় লোকটির পাশে। লোকটি হঠাৎ যেন চমকে, কোনো এক ঘোর থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে টেবিলের সামনে রাখা ফ্রেমটা উল্টো করে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, "আপনি রেডি হয়ে গেছেন ? আসুন, আমরা ভেতরে যাই। "
লোকটি হেঁটে সামনের দিকে এগোতে থাকে, পেছনে আসতে আসতে মীনা দেখলো হাতের আঙ্গুলগুলো দিয়ে চোখের জল মুছলো লোকটি। ভেতরে বেডরুমে এসে দাঁড়িয়ে থাকে চুপ করে দেওয়ালে ভর দিয়ে। দেখতে থাকে মেহেক কে। মেহেক বুঝতে পারে না কি করবে , আসলে আগে অন্য সব জায়গাতে ও আসার পরেই ক্লায়েন্টরা নিজে থেকেই ওর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়তো, বা নিজেরাই আগে এগিয়ে আসতো ওর দিকে। এ তো হাঁ করে চুপ করে দেখছে ওকে , মনে হচ্ছে কিছু যেন বলতে চাইছে কিন্তু পারছে না। মেহেক কিছু বলতে যায় , তার আগেই লোকটি বলে ওঠে ,"আপনার নাম মীনা, তাই তো ? ভালো, ভালো ! আচ্ছা আপনি বলুন কিভাবে আমরা শুরু করবো। মানে আপনি বিছানায় শুয়ে পড়বেন, না আমি আপনাকে কোলে তুলে শুইয়ে দেব, তারপরে আমরা...ওহ, সরি সরি। তার আগে আমাকে চেঞ্জ করতে হবে, তাই না ? লোকটি মেহেকের দিকে পেছন ফিরে জামা প্যান্ট খুলতে শুরু করে। মেহেক এগিয়ে আসে ধীরে ধীরে ওর দিকে , লোকটির হাত ধরে ওকে নিয়ে এসে বসিয়ে দেয় বিছানার ওপরে। নিজের হাতে ধীরে ধীরে লোকটির জামা খুলতে খুলতে বলে ওঠে,"আমার আসল নাম মেহেক। আপনি আমাকে মেহেক বলে ডাকতে পারেন। "
মেহেক বুঝতে পারে না, কেন হঠাৎ করে নিজের আসল নাম বলে দিলো লোকটিকে। লোকটি কিছু না বলে চোখ বন্ধ করে আছে। মেহেক হাসে নিজের মনে। সব পুরুষগুলোই এইরকম , একটু একটু ভয় পায় প্রথমে, তারপরে জেগে উঠবে, আর কয়েক মিনিটের মধ্যে শেষ। তাও ভালো মাত্র তিনঘন্টার জন্য ও আজ আছে এই লোকটার কাছে। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যেতে হবে এখান থেকে , কেন যে লোকটার ওপরে মায়া হচ্ছে !
ধীরে ধীরে জামা প্যান্টের ভেতরের আদিম নগ্নতা জেগে ওঠে মেহেকের সামনে। লোকটি এখন সম্পূর্ণ নগ্ন , বসে ওর সামনে। বয়স হয়ে গেলেও লোকটির শরীরে কোনো মেদ নেই, বুকের ওপরে রয়েছে অল্প কিছু লোম , ঊরুর ওপরে সুন্দর পেশী গুলো যেন খোদাই করে বসানো। বুঝতে পারে মেহেক, লোকটি নিয়মিত শরীর চর্চা করে, বা ভারী কোনো শারীরিক পরিশ্রমের কাজ করে প্রতিদিন। মেহেক লোকটির বুকের ওপরে হাত দেয়, এগিয়ে আসে লোকটির মুখের দিকে।
লোকটি হঠাৎ সজোরে জড়িয়ে ধরে মেহেক কে। ওকে ধরে তুলে নেয় কোলে , দাঁড়িয়ে পড়ে। চুপ করে দেখতে থাকে মেহেককে। ধীরে ধীরে পাগল হয়ে যাচ্ছে লোকটা। আর একটু সময়, তারপরেই....লোকটি শুইয়ে দেয় মেহেককে বিছানার ওপরে , ধীরে ধীরে শুয়ে পড়ে ওর পাশে। আধশোয়া অবস্থায়, মেহেকের দিকে ফিরে হাত দিয়ে স্পর্শ করে মেহেক কে।
মেহেক উত্তেজিত হওয়ার অভিনয় করে, মুখ দিয়ে আওয়াজ করতে শুরু করে। লোকটি মেহেক এর কানের কাছে এসে ধীরে ধীরে বলে, "অভিনয় করতে হবে না। যা হবে, যেটা হবে সেটা যেন সত্যিকারের হয় ! আমি আসল আর নকল বুঝতে পারি খুব ভালো করে। "
মেহেক চুপ করে যায়, হাঁ করে তাকায় লোকটির দিকে। লোকটি মেহেকের 'বেবিডল' ধীরে ধীরে খুলে দেয় নিজের আঙ্গুল দিয়ে। তিরতির করে কেঁপে ওঠে মেহেক , ঠিক যখন এক প্রেমিক তার প্রেমিকাকে প্রথমবার নিজের সামনে উন্মোচন করে, তখন যে অবস্থা হয়, আজ মেহেকের সেই অবস্থা। নিজেই নিজেকে বুঝতে পারছে না মেহেক। আগে তো কত শরীর ঘেঁটেছে ও, কারোর সাথে তো এরকম কোনো অনুভূতি হয় নি ! আজ সব কিছু উল্টো পাল্টা কেন হয়ে যাচ্ছে।
একটু পরে লোকটি ধীরে ধীরে উঠে আসে মেহেকের ওপরে। নামিয়ে আনে নিজের ঠোঁট মেহেকের ঠোঁটের ওপরে। মেহেক ধীরে ধীরে ফাঁক করে নিজের ঠোঁট, উত্তেজিত হয়ে উঠছে মেহেক।
হঠাৎ লোকটি চেঁচিয়ে ওঠে জোরে ,"না আআআ.......নাআআআ......" মেহেকের পাশে উঠে বসে লোকটি, বিছানার ওপরে ঘুঁষি মেরে উঠে দাঁড়ায় লোকটি। এক তীব্র হতাশায় নিজের মাথার চুল জোরে টেনে ধরেন নিজের দু হাত দিয়ে। মেঝেতে রাখা জামা প্যান্ট টেনে পরে নিয়ে মেহেক এর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, "আমাকে ক্ষমা করবেন মেহেক। আমি অক্ষম , আমি আমি কিছুই করতে পারবো না। সরি আপনার সময় নষ্ট করলাম বলে। তবে আপনি একদম চিন্তা করবেন না। আপনার ফুল পেমেন্ট রেডি আছে। আপনি জামা কাপড় পরে বাইরে আসুন, আমি বাইরেই আছি।
বাইরে বেরিয়ে যায় লোকটি। মেহেক চুপ করে উঠে বসে বিছানার ওপরে। এতো মাসের অভিজ্ঞতায়, এই প্রথমবার এই রকম অভিজ্ঞতা হলো ওর। কিন্তু লোকটি তো অক্ষম নয় , আমি আমি তো অনুভব করেছি লোকটিকে, আমার শরীরে স্পর্শ করেছে সেই উত্তেজনা।
কিছুই বুঝতে পারে না মেহেক। চুপ করে উঠে বাইরে রাখা সালোয়ার কামিজ টা ভেতরে নিয়ে এসে পরে নিয়ে বাইরে এসে বসে মেহেক। লোকটি মনে হয় বাথরুমে বা ব্যালকনিতে ! তাড়াতাড়ি মেহেক টেবিলের সামনে গিয়ে উল্টে রাখা ফ্রেমটা সোজা করে দেখে।
একটা সুখী পরিবারের ছবি ফ্রেমে বন্দী ! লোকটি জড়িয়ে ধরে আছে আরেকজন ভদ্রমহিলাকে, দুজনেই দুজনের দিকে তাকিয়ে হাসছে , লোকটির কাঁধে চড়ে বসে আছে একটি ছোট বাচ্চা ছেলে।লোকটি বেরিয়ে আসছে ভেতরের ঘরের বাথরুম থেকে। শব্দ পেয়ে তাড়াতাড়ি মেহেক ফিরে আসতে যায় , আর তখনই ঘটে যায় অঘটন। তাড়াহুড়োতে হাত লেগে পড়ে যায় ফ্রেমটা টাইলসের মেঝেতে , সশব্দে ভেঙে পড়ে, গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যায় ফ্রেমের সামনে থাকা কাঁচ। কাঁচের ভেঙে পড়ার আওয়াজে হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে লোকটি। জোরে চেঁচিয়ে ওঠে - ভয় পেয়ে, আতঙ্কে। মেঝেতে দু কানের ওপরে হাত দিয়ে চেপে বসে পড়ে উবু হয়ে। বেশ কিছুক্ষণ পরে মেঝেতে বসে বসেই সরে যায় দেওয়ালের দিকে , থরথর করে কাঁপতে থাকে কোনো অজানা এক কারণে। তাড়াতাড়ি মেহেক ছুটে যায় লোকটির কাছে। ওকে ধরে জিজ্ঞেস করে, "কি হয়েছে আপনার ? এরকম করছেন কেন ? "
লোকটি হাঁটুর মধ্যে গুঁজে থাকা মুখটা কোনোরকমে বের করে বাইরের ঘরে টেবিলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে ,"কিসের আওয়াজ হলো ? কি ভাঙলো ? কি ? কি ভাঙলো ? "
মেহেক লোকটির দু কাঁধে হাত দিয়ে উঠিয়ে আনে ওকে কোনোরকমে , সাহায্য করে ওকে সামনের দিকে নিয়ে গিয়ে সোফার ওপরে বসতে। ধীরে ধীরে বলে ওঠে,"সরি। আসলে আমার হাত লেগে, ওই টেবিলের ওপরের ফ্রেমটা মেঝেতে পড়ে.....আপনি চিন্তা করবেন না। আমি সব পরিষ্কার করে দিচ্ছি। আপনি একটু পা তুলে বসুন দেখি। "
দরজার কোণে রাখা ঝাড়ু নিয়ে এসে ভেঙে যাওয়া কাঁচের টুকরো গুলো পরিষ্কার করতে করতে শুনতে পেলো মেহেক , লোকটি নিজের মনে বলে যাচ্ছে - যা ভেঙে যায়, সেটা আর জোড়া লাগে না। জোর করে জোড়া লাগলেও, ভাঙার দাগ থেকেই যায় ! রেখা - আঁচড়, অপমানের - কষ্টের..... লোকটির অসংলগ্ন কথা শুনেও না শোনার ভান করে মেঝে পরিষ্কার করে এসে বসে ওর সামনে মেহেক। লোকটির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে , "আপনি, আপনি ভয় পেয়েছেন কেন ? কিছুই তো হয় নি। আমি সব পরিষ্কার করে দিয়েছি , দেখুন ! এতো বড়ো হয়েও আপনি সামান্য কাঁচের ভেঙে যাওয়ার শব্দে এতো ভয় পেয়ে গেলেন ? "
"সামান্য ? সামান্য নয় মেহেক। সামান্য নয় ! তিন তিনটে বছর হয়ে গেছে, আজ ও সেই রাত আমাকে রাতে ঘুমোতে দেয় না ! সেই অভিশপ্ত রাত, সেই ভেঙে যাওয়া ফুলদানী, টেবিলের ওপরে থাকা কাঁচের গ্লাসের ভেঙে যাওয়ার শব্দ - সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়ার রেশ, আজ ও আমার কানে বাজে। আমি ভয় পাই এই শব্দে , মনে হয় আরো কত সম্পর্ক, আরো কত প্রেম - ভালোবাসা এইসময়ে এইভাবেই ভেঙে যাচ্ছে ! আর তার জন্য আমিই দায়ী। আমি ভয় পাই মেহেক ! "
মেহেক কিছু না বুঝতে পেরে চুপ করে তাকিয়ে থাকে লোকটির দিকে। লোকটি একটু পরে একটা জলের বোতল টেনে নিয়ে ঢকঢক করে জল খেয়ে নিজেকে স্থির করে মেহেকের দিকে তাকায় ভালো করে। পকেটে হাত দিয়ে বের করে আনে অনেকগুলি টাকা। "কথা মতো এর মধ্যে পুরো তিরিশ হাজার আছে। " মেহেকের দিকে বাড়িয়ে দেয় টাকার বান্ডিলটা।
মেহেকের মনে পড়ে যায় , ও আসলে লোকটির কেউ নয় ! সময়ের বিনিময়ে টাকা দিয়ে কেনা কিছু সুন্দর সুখী মুহূর্ত মাত্র ! লোকটা আসলে ওর আরো অনেক ক্লায়েন্টের মতোই একজন ক্লায়েন্ট। হাত বাড়িয়ে টাকা নিয়ে উঠে আসে মেহেক। হ্যান্ডব্যাগ আর পার্স তুলতে গিয়ে হাতের ঘড়ির দিকে চোখ যায় ওর। মাত্র দেড় ঘন্টাই হয়েছে। কনট্র্যাক্ট অনুযায়ী, আরো দেড় ঘন্টা ওর সময়। ইচ্ছে করলে টাকা নিয়ে বেরিয়ে যেতেই পারে মেহেক। কিন্তু লোকটিকে এই অবস্থায়, একা ছেড়ে যেতে মন ও চাইছে না। বারবার নিজের মনকে বোঝাতে থাকে মেহেক , কে এই লোকটা? কি এর পরিচয় ? কেন আমাকে এভাবে টানছে ওর দিকে ? কেন এক প্রবল অক্ষমতায় নিজেকে শাস্তি দিচ্ছে লোকটি ? আরো একটু সময় তো কাটানোই যায় ওর সাথে। নাই বা করলো কিছু, শুধু চুপ করে বসে ওর কথাও তো শোনা যায় ! মেহেক টাকাটা পার্সে রেখে লোকটির একদম পাশে এসে বসে। ধীরে ধীরে কোনো কিছু না বলে, ভেবে, চিন্তা করে লোকটির বাঁ হাত নিয়ে নেয় নিজের হাতের মধ্যে। কেঁদে ওঠে লোকটি। মনে হয় অনেকদিন এইভাবে কেউ ওর পাশে এসে বসেনি, মমতার সাথে জড়িয়ে ধরেনি ওর হাত। লোকটির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে মেহেক , "আপনার সাথে আমার আরো দেড় ঘন্টা থাকার কথা ! আমি পুরো সময় শেষ না হলে তো যাবো না। আচ্ছা একটা কথা বলুন, আপনি কি কিছু খেয়েছেন ? আমার কিন্তু খুব খিদে পাচ্ছে। "
ফ্যালফ্যাল করে লোকটি তাকিয়ে ওঠে মেহেকের দিকে। "খাওয়া ? মানে , খেয়েছিলাম ! সেই সকালে। তারপরে আর...."
ভীষণভাবে অবাক হয়ে উঠে দাঁড়ায় মেহেক। রান্নাঘরের দিকে পা বাড়িয়ে আদেশের সুরে বলে ওঠে ,"আমি দেখছি কি করা যায় ! আপনি চুপ করে বসে থাকুন, যেখানে বসে আছেন। "
একটু পরে খিচুড়ি বানিয়ে আনে মেহেক। এসে লোকটির সামনে প্লেট এগিয়ে দিয়ে বলে ওঠে, "দেখুন, কিচেনে তো কিছু ছিল না। আমি একটু চাল আর ডাল দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি করে বানিয়ে ফেললাম। আগে একটু খেয়ে নিন তো দেখি। খেয়ে দেখুন তো কেমন লাগছে ? অনেকদিন হলো আমি নিজের হাতে কিছু রান্না করি নি। "
চুপ করে প্লেটটা নিজের দিকে টেনে নিয়ে খেতে খেতে জিজ্ঞেস করে লোকটি ,"কেন ? নিজে রান্না করেন না কেন আপনি ? বেশ ভালোই তো...." চুপ করে যায় লোকটি নিজের থেকে , উত্তর খুঁজে পেয়ে ! হেসে ওঠে মেহেক, "ঠিকই ধরেছেন। আমি কবে কোথায়, কার সাথে থাকি , কোনো ঠিক নেই। আর রান্না। যাই হোক। আমার তো খাওয়া শেষ, আপনার ও তো শেষের দিকে। দেখে তো মনে হচ্ছে অনেকদিন কিছু খান নি ভালো করে। কেন বাইরে থেকে অর্ডার করে খাওয়ার নিয়ে আসেন রোজ ? ওগুলো খাওয়া কি ভালো ? নিজে কি কোনোদিন রান্না করেন নি ? শিখে নিন একটু ইউ টিউব দেখে। দেখবেন, ভালো লাগছে। "
লোকটি জিজ্ঞেস করে ,"আপনি, আপনি কি করে জানলেন ? " চুপ করে মেহেকের দিকে তাকিয়ে আবার হেসে ওঠে লোকটি ,"ওহ, কিচেনে সব প্যাকেট ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। তাই না ? "
লোকটির খালি প্লেট টেনে নিয়ে মেহেক আদেশ করে লোকটিকে ,"যান দেখি , হাত মুখ ভালো করে ধুয়ে আসুন। আমি সব ধুয়ে মুছে..." লোকটি মেহেককে কথা শেষ করতে না দিয়ে বলে ওঠে, "আপনি কেন ? সকালে আমার কাজের লোক আসবে , সেই করে দেবে। "
কিচেনের দিকে যেতে যেতে মেহেক বলে ওঠে ,"আমার এরকম ভাবে এঁঠো বাসন ফেলে রাখতে ভালো লাগে না। যেটা যখনকার, তখনই সাফ করে, ধুয়ে মুছে রাখতে ভালো লাগে। " কিচেনে ঢুকতে ঢুকতে মেহেক শুনতে পেলো লোকটি বলছে ," সেও এরকম ভাবে কথা বলতো। কেন চলে গেলে স্নিগ্ধা ? কেন ?
মিনিট দশেক পরে মেহেক কিচেন থেকে বেরিয়ে আসে বাইরে। এতক্ষণ বাসনপত্র ধুতে ধুতে বারবার ভাবছিলো, কেন করছি আমি এইসব ? কে এই লোকটি ? ওর জন্য কেন হঠাৎ একটা টান অনুভব করছি আমি ভেতরে ভেতরে ? কেন মনে হচ্ছে এই লোকটিকে সবরকম বিপদ থেকে রক্ষা করে , বুকে টেনে নিয়ে জড়িয়ে বসে থাকি সারারাত ? কেন বারবার ওই অসহায়, ভেঙে পড়া, জীবনের কাছে হেরে যাওয়া, বেঁচে থেকেও নিজেকে মেরে ফেলা মানুষটাকে আবার ফিরিয়ে আনতে ইচ্ছে করছে আমার ? আমি কি প্রেমে পড়ে গেলাম হঠাৎ করে ? এরকম তো হওয়ার কথা ছিল না , আমাকে তো কোনো ক্লায়েন্টের সাথে মন দেওয়া নেওয়া করতে নেই ! শরীর দিয়ে দাও, সব নির্যাস - রূপ - রস - গন্ধ উজাড় করে দাও ; কিন্তু নিজের আত্মা যেন অন্য কারোর কাছে বাধা না পড়ে ! এটাই তো আমাদের মূলমন্ত্র। আজ কি হচ্ছে আমার ? কেন মনে হচ্ছে সারাজীবন এই মানুষটার কাছে থেকে যেতে ?
নিজেই নিজেকে শাসন করে মেহেক। অনেক বুঝিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। এবার আর না , বেরোতেই হবে এই আমাকে এই অক্ষম ভালোবাসার কাছ থেকে , এই লোকটার থেকে সরে যেতে হবে অনেক দূরে।
কোনোদিকে না তাকিয়ে সোফায় রাখা হ্যান্ডব্যাগ আর পার্স তুলে নেয় মেহেক। হঠাৎ লোকটি জিজ্ঞেস করে ওঠে , "আপনার শরীরের ওপর দিয়ে যদি একটা বুলডোজার চলে যায়, কি হবে আপনার ? "
লোকটির গলার স্বরে কিছু একটা ছিল, দুর্বল হয়ে পড়ে মেহেক আবার। একটু পরে লোকটির সামনে বসে মেহেক বলে ওঠে ," শুনুন, আপনি আমাকে বলতে পারেন আপনার কথা। আমি সব শুনবো, আপনার যত সময়ই লাগুক না কেন ! আমাকে, আপনি অন্য কিছু না ভেবে - আপনার খুব ভালো বন্ধু ভাবতে পারেন। "
'বন্ধু' কথাটা শুনে জ্বলজ্বল করে ওঠে লোকটার চোখদুটো। "বন্ধু ? বন্ধু ? জানেন আমি ভুলেই গেছি এইরকম একটা শব্দ আছে জীবনে। আপনি, আপনি সত্যি শুনবেন আমার কথা ? " একটা আকুতি ঝরে পড়ে লোকটির গলার স্বরে।
"মেহেক, আপনাকে মনে হয় আমার নাম বলিনি আমি, তাই না ? আমার নাম হলো বিতান। “
"মানে ? কি বলতে চান আপনি ? " চমকে ওঠে মেহেক। কি বলে চাইছে কি লোকটা ? সন্ধে থেকেই এর আচার আচরণ দেখে একটু ঘাবড়েই আছে মেহেক এমনিতে। অন্যদের থেকে আলাদা এই লোকটার স্বভাব, ভাব ভঙ্গি। না - অন্যদের মতো ওকেই দেখে ওর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে নি লোকটা, খুলে নিতে চায় নি ওর জামা কাপড় জোরে করে টেনে টেনে , বা জোর করে বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে দেয় নি , তবুও যেন কেমন একটা করছে মনের ভেতরটা ! মাঝে মাঝে ভয় হচ্ছে, মাঝে মাঝে মায়া ! আবার এক দুবার , ভীষণ ভীষণ ভালবাসতে ইচ্ছে করছে লোকটাকে। অন্য কাউকে দেখে আগে এরকম মনে হয়নি মেহেকের। কাজ করেছে, কাজ শেষে টাকা নিয়ে চলে গেছে। কিন্তু এই লোকটার মধ্যে কিছু একটা আছে, একটা রহস্য - কোনো গোপন কথা ; সেটাই লোকটাকে করে তুলেছে ভীষণ মনোরম - চিত্তাকর্ষক - আকর্ষণীয় !
আলো আঁধারের মধ্যে জানালার পাশে বসা লোকটা হেসে ওঠে ধীরে ধীরে। "কিছুই বলতে চাই না আমি ; আমি শুধু জিজ্ঞেস করেছিলাম মেহেক - আপনাকে যে যদি একটা বুলডোজার আপনার ওপর দিয়ে চলে যায়, কি হবে আপনার ? আচ্ছা আমিই বলছি। ভয় পাবেন না আবার , প্লিজ। আপনি ভয় পেলে আমার খুব খারাপ লাগবে। এরকম কিছু হলে আপনার শরীর পুরো গুঁড়িয়ে মাটির সাথে মিশে যাবে, হাড় গোড় ভেঙে চুরচুর হবে ; আপনার শরীরের ভেতরের রক্ত বেরিয়ে আসবে গলগল করে , ভিজিয়ে দেবে রাস্তা। আপনার অস্তিত্বটাই আর থাকবে না। সব শেষে আপনার জায়গায় পড়ে থাকবে একটা দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া - মাংসপিন্ড। "
"উহহ , বন্ধ করুন আপনি , আমার একদম ভালো লাগছে না। " ঘেন্নায়, বিবমিষায় গা গুলিয়ে ওঠে মেহেকের। তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে টেবিলের ওপরে রাখা জলের বোতলের ঢাকনা খুলে ঢকঢক করে ঠান্ডা জল ঢালে গলার মধ্যে।
লোকটা বলতে থাকে, "তবুও এটাতো চোখে দেখা যায় ; কিন্তু যদি আপনার মনের ওপর দিয়ে - কয়েকশো বুলডোজার চলে যায় ? সেই রক্তক্ষরণ , সেই না বেরিয়ে আসা মনের গভীরে - গোপনে ফেলা চোখের জল , প্রতিদিন একটু একটু করে মরতে থাকা মানুষের কাহিনী , সেই গল্প সেই ব্যর্থতার আখ্যান, বিচ্ছেদের আঁচড় - সেটা কি কেউ দেখতে পায় ? " বলতে বলতে চোখ থেকে বেরিয়ে আসে জল, আবার ! মেহেক বুঝতে পারে না কি করবে ! ওর কি দাঁড়ানো উচিত, না কি চলে যাওয়া ? একসময় মনস্তত্বের উজ্বল ছাত্রী, বেরোতে গিয়েও বেরোতে পারে না। আটকে পড়ে লোকটার বাড়িতে। ওকে শুনতেই হবে, জানতে হবে - কেন এই লোকটা নিজেকে ঠেলে দিচ্ছে এইভাবে মৃত্যুর দিকে একটু একটু করে ? কেন ওর এই অক্ষমতা, ব্যর্থতা ? কার জন্য আজকের দিনেও লোকটা ঠেলে সরিয়ে দিলো মেহেক কে ? পারলো না কিছু করতে ? কার জন্য হঠাৎ বেরিয়ে আসে চোখের জল ? অনেক সময় ভেতরের কথা - দুঃখ - কষ্ট - যন্ত্রনা অন্য কাউকে বলতে না পেরে অনেকে ডুবে যায় কালো অন্ধকার কোনো এক জায়গায়, বেরোতে চায় তারা , ছটফট করে - কিন্তু বেরিয়ে আসতে পারে না !
এগিয়ে আসে মেহেক লোকটার দিকে , ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলে ওঠে ," শুনুন, আপনি আমাকে বলতে পারেন আপনার কথা। আমি সব শুনবো, আপনার যত সময়ই লাগুক না কেন ! আমাকে, আপনি অন্য কিছু না ভেবে - আপনার খুব ভালো বন্ধু ভাবতে পারেন। "
'বন্ধু' কথাটা শুনে জ্বলজ্বল করে ওঠে লোকটার চোখদুটো। "বন্ধু ? বন্ধু ? জানেন আমি ভুলেই গেছি এইরকম একটা শব্দ আছে জীবনে। আপনি, আপনি সত্যি শুনবেন আমার কথা ? " একটা আকুতি ঝরে পড়ে লোকটির গলার স্বরে।
অনেক অনেক দিন আগে, যখন টাকা পয়সা রোজগারের কোনো চিন্তা ছিল না আমার, যখন আমি কলেজে পড়তাম, যখন দিনগুলো ছিল উজ্জ্বল, রাতগুলো ছিল আড্ডামুখর, ক্লাসগুলো ছিল মজা করার জায়গা আর ক্যান্টিনটা ছিল গানবাজনার মঞ্চ , সেই তখনকার কথা বলছি আমি। বাবা একটা ভালো চাকরি করতো , বেশ উঁচু পোস্টে ছিলো, কাজের জন্য মাঝে মাঝেই দেশের বাইরে কাটাতে হতো বাবাকে। মা ও একটা স্কুলে পড়াতো। তা বলে এটা ভাববেন না কিন্তু মেহেক, যে আমি একদম বখে যাওয়া ছেলে ছিলাম একটা। না ! না ! বাবা মা কে ভীষণ ভালোবাসতাম আমি, ওরাও আমাকে। যখনই আমরা সবাই একসাথে থাকতাম, তখন একসাথে রাতে খাওয়ার টেবিলে আড্ডা, একসাথে বসে টিভিতে সিনেমা দেখা, মাঝে মাঝে আবার তিনজনেই একসাথে বসে, হাতে ওয়াইন এর গ্লাস নিয়ে রাতের আকাশে তারা গুণে সময় কাটাতাম। আমি আমার লেখা কবিতা পড়ে শোনাতাম ওদের কে।
হ্যাঁ, তখন আমি কবিতা লিখতাম। জানি না কেমন লিখতাম, তবে কিছু কিছু লিটিল ম্যাগাজিনে বেরোতো সেই কবিতাগুলো। এক দু বার, রাজ্যের সবথেকে ভালো ম্যাগাজিনেও বেরিয়েছিল। এইভাবেই দিনগুলো বেশ কেটে যাচ্ছিলো আমার। কলেজ শেষে , একটা চাকরিও জোগাড় করে ফেলেছিলাম। মিথ্যে বলবো না আপনাকে, চাকরি পাওয়ার পেছনে, বাবার লম্বা হাত একটু কাজ করেছিলো। আমাকেও কাজের সূত্রে মাঝে মাঝে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হতো। আবার এইরকম কাজে, আমার পাহাড়ের টিমের সাথে দেখা করতে যেতে হয়েছিলো আমায়। ওখানে কাজ ছিলো দুদিনের। আমার প্রথমদিনেই কাজ শেষ হয়ে গিয়েছিলো। তখন পরের দিন ভাবলাম আরো একটু ওপর থেকে ঘুরে আসি, দেখে আসি পাহাড়ে বরফ দেখতে পাই কিনা। সেই তরুণ বয়সের শখ আর এডভেঞ্চার আর কি। আর সেখানেই, সেখানেই আমি প্রথম দেখলাম সেই মেয়েটিকে , স্নিগ্ধাকে।
স্নিগ্ধা তখন ওখানে একটা ক্যাফেতে গিটার নিয়ে গান করতো - খালি গলায়, মাথার ওপরে থাকা ঘন-সোজা-লম্বা একটু লাল আর নীলের ছোঁয়ায় রাঙানো চুলগুলো এসে পড়তো কপালের সামনে থেকে মুখের একদিকে , আরেকদিকে দেখা যেত ওর কোমল মুখ, তার ওপরে ভীষণ ভাবে জেগে থাকা সমুদ্রের ঘন নীলের মতো চোখটা। কত যে কথা বলতে চাইতো সেই চোখদুটো। আমার সাথে অফিসের যে দুজন ছিলো , আমাকে বলেছিলো , সারপ্রাইজ দেবে, শোনাবে লাইভ মিউজিক ! আর আমি তো প্রথম দর্শনেই ক্লিন বোল্ড হয়ে গিয়েছিলাম। আরো আশ্চর্যের ব্যাপার কি জানেন মেহেক, ও আমার লেখা কবিতা, নিজের মতো করে সুর দিয়ে গাইছিলো সেদিন। আমার লেখা কবিতা, আমার সৃষ্টি, সেটা অন্য একজনের মুখে ,এই সুদূর পাহাড়ে , আবার গানের আকারে শুনে কি ভালোই যে লাগছিলো সেদিন আমি আপনাকে বলে বোঝাতে পারবো না। তখন ও ওর নাম জানতাম না আমি। আমার সাথে বাকি যে দুজন ছিলো, আমি ওদেরকে বলি, আমি নিজে একটু একা একা ঘুরতে চাই। ওরা আমাকে ছেড়ে চলে গেলো, আমি ওই ক্যাফেতেই সন্ধেটা কাটিয়ে দিলাম, শুনছিলাম ওর গানগুলো। সব কটা গান শেষ হয়ে গেলে, যখন ও গিটার গুছিয়ে ব্যাগে রেখে বেরোতে যাবে , আমি ওর কাছে গিয়ে বললাম ,"হাই ! আমার নাম বিতান। "
আমার দিকে না তাকিয়ে কোনো কথা না বলে ক্যাফের দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো। বেশ কয়েক সেকেন্ড আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে, তারপরে আবার দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম, ওর পাশে দৌড়ে এসে দাঁড়িয়ে , আবার বললাম ,"আমি বিতান। "
আমার চোখে চোখ রেখে রাগের স্বরে বলে ওঠে ও ,"আর আমি এবার পুলিশ ডাকবো। রাস্তা ছাড়ুন। " আমি তখন কি বলবো বুঝতে না পেরে, হাঁ করে তাকিয়ে ছিলাম ওর দিকে। সন্ধের ঠান্ডা থেকে বাঁচতে, মাথায় একটা উলের টুপি পরেছিলো সেদিন ও, গায়ে গলা পর্যন্ত ঢাকা পুলওভার আর নিচে কালো রঙের জিন্স। ঠোঁটে টকটকে লাল লিপস্টিক, গালে কোনো কোল্ড ক্রিম ছিলো লাগানো, কিন্তু ঠান্ডায় সেটাও লাল হয়ে উঠেছে। কানে ছোট্ট দুটো ঝোলা দুল , গলায় বিভিন্ন রঙের পাথরের একটা মালা , পিঠে গিটারের ব্যাগ। দেখতে যে ভীষণ আহামরি সেরকম কিছুই নয় , উল্টে সাধারণ মেয়েদের থেকে একটু বেশি লম্বা ছিলো ও। কিন্তু ওর কথার মধ্যে যে কনফিডেন্স , কথা বলার স্টাইল আর তার ওপরে নিজে সুর করা , আমার কবিতাকে প্রাণ দেওয়া - সব নিয়ে আমি ভীষণ ভীষণ রকম উত্তেজনা অনুভব করছিলাম সেদিন। চেঁচিয়ে ওর হাত ধরে বলতে ইচ্ছে হচ্ছিলো, আমাকে আপনি নতুন জীবন দিয়েছেন।
কিন্তু আমি কিছু না বলে , হাঁ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেদিন রাস্তার মাঝে।
পরের দিন ফিরে আসার কথা , কিন্তু আমার বারবার মনে হচ্ছিলো ওর সাথে দেখা করতেই হবে , আর একবার। না হলে কিছু যেন একটা অসম্পূর্ন থেকে যাবে, হয়তো কোনো গল্প শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যাবে। আমি সেদিন ও - থেকে গেলাম ওই ছোট্ট ওই পাহাড়ী শহরে। ঠিক যখন বিকেল চারটে, আমি চলে আসি ক্যাফেতে। বসে যাই একটা জায়গায়। ক্যাফের ম্যানেজার কে ডেকে জিজ্ঞেস করি ,"গতকাল যে মেয়েটা গান করছিলো, ও আজ ও আসবে তো ? "
টেবিলের ওপরে রেজিস্টারে কিছু একটা করতে করতেই বলে ওঠে সেই ম্যানেজার ,"দেখুন, আমার এখানে আজেবাজে ঝামেলা চাই না। আপনি গতকাল রাতেও অনেকক্ষন বসেছিলেন, স্নিগ্ধার গান শুনছিলেন। কিছু কাজ থাকলে , ওর ডিউটি শেষ হয়ে গেলে ওর সাথে বাইরে কথা বলে নেবেন। "
"ঝামেলা ? কিসের ঝামেলা ? " একটু রেগেই বলে উঠলাম আমি।
"আপনারা এই সমতলের লোকজন ভাবেন এখানে পাহাড়ে এসে, আমাদের পাহাড়ী মেয়েদের সাথে যা খুশি করবেন ! তাই না ? একটু সাবধানে থাকবেন কিন্তু। আপনি যতই হোক , বাইরের লোক। আর বেশি কিছু করলে....." টেবিলের নিচ থেকে একটা কুকরি বের করে টেবিলের ওপরে রাখে ম্যানেজার। আড়চোখে দেখতে থাকে আমাকে।
আমিও কিছু একটা বলতে যাই, হঠাৎ পেছন থেকে শুনতে পাই ওর গলা , স্নিগ্ধার গলা। "চলে এসেছি আমি। একটু কফি খাওয়াবে ? বাইরে কি ঠান......" আমার দিকে তাকিয়ে শেষ করে বাকিটা , "ডা " !
সেদিন ও অনেক জনপ্রিয় কবিতা , ও নিজের মতো করে সুর বসিয়ে গেয়ে যায় পরপর। আমার আরো তিনটে কবিতা ছিলো ওর মধ্যে। সেদিন ওর প্রোগ্রাম শেষ হলে, বাইরে না বেরিয়ে আমার সামনে এসে বসে স্নিগ্ধা। সরাসরি আমাকে জিজ্ঞেস করে ওঠে ,"কি ব্যাপার বলুনতো ? আপনি কি চান ? "
"আমার নাম....বিতান। "
"হ্যাঁ, জানি তো। আপনি গতকাল ও বলে....." হঠাৎ চোখ ছোট হয়ে আসে স্নিগ্ধার, আর একটু আমার দিকে ঝুঁকে আসে ও। ভালো করে দেখতে থাকে আমাকে। বিস্ময়ের সাথে একটু পেছনে সরে গিয়ে বলে , "না না ! আমি যেটা ভাবছি....মানে, আমি, আমি আপনার কবিতা গুলোই....! আপনি, আপনি সত্যি , সেই বিতান ? মানে যে কবিতা লেখে ? বিভিন্ন ম্যাগাজিনে বেরোয় ? আমি জাস্ট বিলিভ করতে পারছি না। আমি তো , আমি তো ভেবেছিলাম কবিতাগুলো কোনো এমন মানুষের লেখা যার অনেক বয়স হয়ে গেছে , সাদা চুল মাথায়, খদ্দেরের পাঞ্জাবী পরে , কাঁধে শান্তিনিকেতনী ঝোলা ! "
আমি হাসতে হাসতে বললাম, "কেন ? কবি মানেই কি এরকম হতে হবে ? "
ধীরে ধীরে আমাদের মধ্যে কথা শুরু হলো, কোথাও যেন একটা প্রেমের অংকুর ও ধীরে ধীরে বড়ো হতে শুরু করে সেইসময় থেকে। ক্যাফে বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরেও, আমি আর স্নিগ্ধা অনেকক্ষণ রাস্তায় হেঁটেছিলাম সেই রাতে , পাশাপাশি - সামনে পেছনে - ভিড়ের মধ্যে - ফাঁকা - স্তব্ধ গলিতে - কথা বলতে বলতে - নিশ্চুপ ভাবে - হোঁচট খেতে খেতে - বুকের বাড়তে থাকা ধুকপুক শব্দকে চাপা দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টায় আড়চোখে তাকিয়ে দেখতে দেখতে। আমি আমার আরো কিছু কবিতা আবৃত্তি করেছিলাম ওর সামনে সেদিন। জেনেছিলাম, ওর বাবা কলকাতায় একজন মিউজিক ডিরেক্টরের সাথে কাজ করে , মাঝে মাঝেই যাওয়া আসার মধ্যে থাকে। আর বাবার উৎসাহেই, বাংলা সাহিত্য, কবিতা এসব পড়ে ও, আর সেখান থেকেই আমার কবিতার সাথে ওর পরিচয়।
প্রায় এগারোটা পর্যন্ত ঘোরাঘুরি করে ওকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আমি ফিরে আসি আমার হোটেলে। পরের দিন সকালে বেরিয়ে যেতে হবে , ফিরে যেতে হবে আমার কর্মক্ষেত্রে। মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো, বারবার মনে হচ্ছিলো, কেন সময়টা শেষ হয়ে গেলো এতো তাড়াতাড়ি ?
পরের দিন সকালে উঠে আমরা দশটার সময়ে শুরু করলাম আমাদের যাত্রা, পাহাড় থেকে সমতলে - নিচের দিকে নামার জন্য জীপে উঠলাম আমরা। পাহাড়ের আঁকা বাঁকা সরু পথ ধরে, সবুজ রডোডেনড্রন এর সাথে কথা বলতে বলতে বেশ কিছুটা আসার পরে হঠাৎ দেখি রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছে একটি অবয়ব, হুড দিয়ে মাথা ঢাকা, পিঠে ঝোলানো একটা গিটার। দূর থেকে দেখে মনে হলো , এটা কি স্নিগ্ধা ? এতোটাও ভালো কি আমার ভাগ্য ?
ওর পাশে যখন আমরা এলাম, আমাদের গাড়ি হাতের ইশারায় থামাতে বললো সেই অবয়ব। হুড খুলে সামনে এলো , দেখলাম , সামনে দাঁড়িয়ে স্নিগ্ধা ! মনটা যেন নেচে উঠলো এক অসম্ভব আনন্দে। অন্যদের বুঝতে না দিয়ে , আমি জীপটা দাঁড় করিয়ে নেমে এলাম। স্নিগ্ধা আমাদের দেখে খুব অবাক হলো ! ও জানালো, ওর গিটার এর কয়েকটা স্ট্রিং ছিঁড়ে গেছে , সেটা ঠিক করতে ওকে যেতে হবে নিচের শহরে। কিন্তু ও যে বাসে আসছিলো, সেটা খারাপ হয়ে পেছনে পড়ে আছে। ও হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে এসেছে রাস্তা ধরে, যদি কোনো হেল্প পাওয়া যায়।
আমি হেসে ওকে উঠে আসতে বললাম পেছনে। আমিও পেছনে গিয়ে ওর পাশে বসলাম। আবার জীপ চলতে শুরু করে।
একটু পরে আমরা একটা বাঁকে এসে হাজির হই , এই রাস্তার সবথেকে ভয়ঙ্কর জায়গা এটা ! তার ওপরে হঠাৎ করে কুয়াশায় ঢেকে গেছে রাস্তাটা। সামনে থেকে কি আসছে, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। আমাদের ড্রাইভার খুব সাবধানে গাড়িটা ঘোরাতে শুরু করে বাঁ দিকে, ডান দিকে নিচে গভীর খাদ ! ভয়ে তাকাতে পারছি না ওই খাদের দিকে। হঠাৎ কুয়াশা ভেদ করে একটা জোরালো আলো এগিয়ে আসে আমাদের জীপের দিকে, সাথে প্রচন্ড জোরে বাজতে থাকা হর্ন।
আমাদের গাড়ির ড্রাইভার কোনোরকমে জীপটাকে একটা সাইডে নিয়ে আসে তাড়াতাড়ি। গাড়ি থামায় , কিন্তু গাড়িটা পেছনে গড়াতে থাকে, খাদের দিকে। ভয়ে কেঁপে উঠি আমরা সবাই। ড্রাইভার প্রাণপনে চেষ্টা করছে গাড়িটা দাঁড় করাতে , সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে, কিন্তু কোনো এক অমোঘ শক্তি যেন সবাইকে পেছনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আমরা সবাই ঠান্ডার মধ্যেই ভয়ে ঘামতে শুরু করি, হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে। মৃত্যুকে একদম সামনে থেকে দেখছি আমরা, অথচ কিছুই করতে পারছি না। এর মধ্যেই হঠাৎ আমি আমার হাতের ভেতরে পেলাম আর একটা নরম হাতের ছোঁয়া ! পাশে তাকিয়ে দেখলাম স্নিগ্ধার ফ্যাকাসে সাদা হয়ে যাওয়া মুখ। ঠিক সেই মুহূর্তে আমার মনে হলো, এই মেয়েটার সাথে আমি কি আর একটু সময় থাকতে পারবো না ? কাটাতে পারবো না আমার সারাটা জীবন ওর সাথে? হে পরমেশ্বর, আমার - আমাদের যাত্রা কি তাহলে এইটুকুই ছিলো ? কেন তাহলে এই সুন্দর মুহূর্ত নিয়ে এলে আমাদের মাঝে ? " আমি চেপে ধরি ওর হাতটা আমার হাতের মধ্যে , চোখের ইশারায় আশ্বাস দিই স্নিগ্ধাকে !
হঠাৎ আমাদের জীপটা থেমে গেলো। ড্রাইভার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে ওঠে, "যাক ! এ যাত্রা আমরা বেঁচে গেলাম। রাস্তার একদম ধারের একটা মাইলস্টোনে লেগে আটকে গেছে আমাদের গাড়িটা। কিছুক্ষণ পরে , আমরা ধীরে ধীরে নেমে এলাম, ড্রাইভার ধীরে ধীরে জীপটা সামনে নিয়ে এগোনোর পরে, আবার আমরা উঠলাম জীপে।
বাকি মিনিট পনেরো ছিলো আমার কাছে স্বর্গের মতো। ওই টুকু রাস্তা স্নিগ্ধা আমার পাশে বসেছিলো চুপ করে , ওর হাত ছিলো আমার হাতের মুঠোর মধ্যে।
>>>>>>>>>><<<<<<<<<<
কলকাতায় ফিরে আসার পরে, কি যেন একটা হয়ে গেলো আমার মধ্যে। আমি জানি না , আসলে কলেজ লাইফে কখনও কারোর সাথে প্রেম করিনি তো, তাই হয়তো বুঝতে পারিনি সেই সময় আমার মনের অবস্থা। প্রথম প্রথম প্রেমে পড়লে , কি হয় মেহেক ? জানেন আপনি ? আমার মনে হয়, আপনি জানেন সেই অভিজ্ঞতার কথা। আপনি এই এসকর্ট হিসেবে কাজ করলেও, আমি বুঝতে পারছি আপনি এখনো কোথাও ভেতরে ভেতরে কারোর জন্য হয়তো অপেক্ষা করে আছেন। আমার সেই অবস্থা হয়েছিলো সেই সময়। অফিসে বসে কাজ করতে ইচ্ছে করতো না, সবসময় মনের গভীরে, চোখের সামনে ভেসে উঠতো সেই মুহূর্ত গুলো, সেই যখন স্নিগ্ধা জীপের মধ্যে আমার পাশে বসে, আমার হাতের মুঠোর মধ্যে ওর ঠান্ডা হাত ঢুকিয়ে পেতে চেয়েছিলো বেঁচে থাকার আশ্বাস - ভরসা ! আর ওর কথা ভাবলেই মনের ভেতরে একটা অদ্ভুত ভালোলাগা, একটা অন্যরকম পরশ, একঝাঁক খোলা মুক্ত হাওয়া চলে আসতো কোথাও থেকে। মনে হতো, কি হবে এইসব কাজ করে , ক্লায়েন্টের জন্য খেটে ? জীবনে যদি ভালোবাসাটাই না থাকে, কি হবে বেঁচে থেকে ?
তখন তো আর এখনকার মতো সবার হাতের মুঠোয় মোবাইল ছিলো না , তাই সপ্তাহান্তে কিছুক্ষণ বুথে গিয়ে ওর সাথে কথা বলার সময়ের জন্য অপেক্ষা করে থাকতাম বাকি ছয়দিন ধরে। চাতক পাখীর থেকেও বেশি তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছিলাম আমি। আবার সপ্তাহান্তে যখন ঘড়ির কাঁটা ধীরে ধীরে এগোতো বিকেল পাঁচটার দিকে, তখন হাত পা ঠান্ডা হয়ে যেত, পেটের মধ্যে একটা গুড়গুড় ভাব , বুকের মধ্যে দুরুদুরু , মাথা যেন ফাঁকা হয়ে যেত, মনে হতো চোখের সামনে আর কিছুই নেই, শুধু আমি আর আমার সামনে ফোনের বুথ। মাঝে মাঝে ভয় হতো, স্নিগ্ধা আসবে তো ? কথা বলবে তো আমার সাথে ? হঠাৎ যদি কোনো কারণে না আসে ? বা যদি কিছু হয়ে যায় ? কোনো অঘটন ? পরে বুঝেছি, যাকে আপনি সবথেকে বেশি ভালোবাসেন, তাকে নিয়ে চিন্তা সবথেকে বেশি হয়, আর চিন্তা হলেই প্রথমে দুর্ঘটনার কথা মাথায় চলে আসে।
আবার মাঝে মাঝে আরো একটা ভয় চেপে বসতো আমার মাথায় সেই সময়। আসলে আমি স্নিগ্ধার থেকে বয়সে একটু বড়োই ছিলাম, আট বছরের। মনে হতো, ওর যদি সমবয়সী কাউকে পছন্দ হয়ে যায় ? যদি ওর বাবা ওকে অন্য কোথাও বিয়ে দিয়ে দেয় ? এইসব হাজারো রকম চিন্তা ভাবনা নিয়ে এগিয়ে গিয়ে ফোনে ডায়াল করার পরে , যখন ওর গলার আওয়াজ শুনতে পেতাম, শুনতাম ওর হাসি, ওর হাজারো আবদার আর কিছু প্রেম ভালোবাসার কথা , মনটা ভালো হয়ে যেত। প্রতি রবিবারের মিনিট দশেকের কথা আমাকে পরের ছয়দিন বাঁচার প্রয়োজনীয় অক্সিজেন দিয়ে যেত।
এইভাবেই কেটে গেলো বেশ কিছু সপ্তাহ। আজকাল যেমন ইন্টারনেটে, ছেলে মেয়েরা ঝপাঝপ প্রেমে পড়ে , আমাদের সময়ে তার সুযোগ কম ছিল, তবে ফোনে ফোনেও প্রেম হতো আমাদের সময়ে। যদিও সেটা অনেক কস্টলি ছিলো। আপনি হয়তো জানেন না, সেই সময় এক মিনিট কথা বলার চার্জ ছিল, প্রায় সাড়ে তিনটাকা ! আপনার মনে আছে মেহেক ? স্নিগ্ধা সেই সময় একটা ক্যাফেতে গান করতো ! সেই ক্যাফেতেই ও ফোন রিসিভ করতো, আর আমি আমার বাড়ির কাছের একটা বুথ থেকে। যদিও তখন আমার তিরিশ বছর বয়স, তবুও বাবা মায়ের একটা ভয়-না আসলে ভয় নয় ; বলতে পারেন সংস্কার বা অন্য কিছু , সেটার জন্য বাড়ি থেকে ফোন না করে বাইরে থেকে করতাম।
যাই হোক, অবশেষে একদিন অনেকটা সাহস বুকের মধ্যে এনে , স্নিগ্ধাকে আমি জিজ্ঞেস করেই ফেললাম ;"আমরা যে প্রতি সপ্তাহের শেষে এইভাবে কথা বলছি , কেন ? আমরা কি শুধুই বন্ধু, না কি আরো বেশি কিছু ? "
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে যায় স্নিগ্ধা। সেই কয়েকটা মুহূর্ত যে কষ্টের, কি যন্ত্রণার ছিলো, বোঝাতে পারবো না আপনাকে। মনে হচ্ছিলো, কখন শেষ হবে এই স্তব্ধতা? এই মৌনতা ? প্রায় তিরিশ সেকেন্ড পরে আমাকে লাজুক স্বরে উত্তর দেয় , "জানি না ! যাও ! " ওইটুকু কথার মধ্যেই , সব পরিষ্কার হয়ে যায় আমার সামনে। আমি হেসে ফেলি। মজা করে বলি ,"সত্যিই তো ? তুমি সত্যিই জানো না ? তাহলে আর কি, ফোনটা রেখে দিই। "
আর্তনার করে চেঁচিয়ে ওঠে স্নিগ্ধা ,"ভালো হবে না বলছি, বিতান। তোমাকে সামনে পেলে না , সামনে পেলে..." কথা হারিয়ে ফেলে স্নিগ্ধা। আমি ফিসফিস করে বলে উঠি , "কি ? সামনে পেলে কি ? আমাকে জড়িয়ে ধরবে ? আমার ঠোঁটে মিশে যাবে তোমার নরম গোলাপী কাঁপতে থাকা ঠোঁট দুটো ? "
স্নিগ্ধা নিজেও হেসে ওঠে আমার উত্তরে। আবার কিছুক্ষণ চুপ করে , তারপর বলে ,"শোনো , কি হবে, বা কি হতে পারে এসব কল্পনা আর করতে হবে না। দশদিন পরে জানতে পারবে। বাবা পুরোপুরি কলকাতায় চলে আসছে ! আমাদের এখানকার বাড়ি বিক্রি করে দিচ্ছে। আসলে বাবার কাজে অসুবিধে হচ্ছে, এখন মাঝে মাঝে মুম্বাইতেও যেতে হচ্ছে। তাই ! বুঝলে কবি মশায় ? তাহলে ঠিক দশদিন পরে আমাদের দেখা হবে। কিন্তু কোথায় দেখা হবে ? আমি তো কলকতার সেরকম কিছু জানি না , চিনিও না। " আরো কিছু টুকরো টুকরো কথার মধ্যে কেটে গেলো বাকি সময়।
দিন দশেক পরে আমাদের দেখা হওয়ার কথা ছিল কলেজ স্ট্রিটে , কফি হাউসের সামনে। কিন্তু সেদিন আমি একা আসিনি। আমার সঙ্গে এসেছিলো আমার মা বাবা দুজনেই। দুজনেরই খুব পছন্দ হয়েছিলো স্নিগ্ধাকে। আসলে আমি আর পারছিলাম না একা একা এইভাবে থাকতে। যাকে ভালোবাসি, যে নিজেও আমার কাছে আসতে চাইছে , তখন আর দেরী করে কি হবে ? মা বাবা অনেকক্ষণ স্নিগ্ধার সাথে কথা বলে কফি হাউসের ওপরে বসে , আর আমাকে নিচে পাঠিয়ে দেয়। প্রায় আধঘন্টা পরে ওরা তিনজনেই নেমে আসে , আর আমাকে কেন কিছু না বলে, প্রায় বগলদাবা করে, একটা ট্যাক্সি ডেকে সবাই চলে আসি স্নিগ্ধাদের বাড়িতে। সেদিন স্নিগ্ধার বাবা , মা দুজনেই ছিলেন বাড়িতে।
হঠাৎ করে সব যেন স্বপ্নের মতো হয়ে গেলো। সেদিনই দুই বাড়ির প্রায় একরকমভাবে কথা পাকা হয়ে গেলো ! বাকি ছিলো শুধু পাঁজি দেখে দিনক্ষণ ঠিক করা।
আগেই বলেছিলাম, স্নিগ্ধার বাবা মিউজিক ইন্ডাস্টির সাথে যুক্ত ছিলেন , আর স্নিগ্ধাও বেশ ভালোই গান করতো। সেই সময় হঠাৎ করেই ব্যান্ড কালচার ভীষণ পপুলার হয়ে ওঠে আমাদের দেশে। আর তখন ছিলো ইন্ডিপেন্ডেন্ট মিউজিক এর যুগ। ওদিকে হিন্দিতে আলিশা, লাকি আলি , সোনু নিগম; এদিকে বাংলায় চন্দ্রবিন্দু, শহর, ক্যাকটাস , লক্ষীছাড়া, ফসিলস , ভূমি আর আরো কতজন। এইরকম একটা ব্যান্ডের সাথে কাজ করছিলেন স্নিগ্ধার বাবা। ওই ব্যান্ডের একজন ফিমেল সিঙ্গার এর দরকার ছিলো, আর ওরা ও চাইছিলো একদম নতুন কোনো ভয়েস। তখন ওর বাবা স্নিগ্ধার কিছু গান ওদেরকে শোনায় , পরিচয় গোপন করেই। ওদের ভীষণ পছন্দ হয় স্নিগ্ধাকে। স্নিগ্ধা তখন ওদের হয়ে কাজ করে দুটি এলবামে। স্নিগ্ধার নিজেরও একটা পরিচিতি তৈরী হয়।
আমার খুব ভালো লাগতো যখন দেখতাম স্নিগ্ধা স্টেজে গান করছে, বা মিউজিক ওয়ার্ল্ডে এসে প্রোগ্রাম করছে, বা শুনতাম রেডিওতে এফ এম এ ওর গান হচ্ছে। ইচ্ছে হতো সবাইকে জোরে জোরে বলতে, এই দেখো, স্নিগ্ধা গান করছে , ওকে আমি ভালোবাসি, আর কয়েকদিন পরে আমাদের চার হাত এক হয়ে যাবে। ভীষণ গর্ববোধ হতো ওর জন্য।
ওদিকে বিয়ের ডেট ঠিক হয়ে গেছে আমাদের, আরো মাস চারেক পরে আমাদের বিয়ে। আমরা দুজনেই ভীষণ খুশি, এখন কোনো বাড়ি থেকেই কোনো বাধা নেই, আমরা নিজেরা স্বাধীন ভাবে, একসাথে ঘোরাঘুরি করি, হাতে হাত রেখে রাস্তা দিয়ে হাঁটি ! এইসময় একদিন আবার আমাকে অফিসের কাজে যেতে হয় গৌহাটিতে দিন দুইয়ের জন্য। পরে শনি আর রবিবার দুদিন ছুটি। আর সেই একইসময়ে স্নিগ্ধাকে ওর ব্যান্ডের সাথে একটি প্রোগ্রামে যেতে হয় গৌহাটিতে একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অ্যানুয়াল ফেস্টে, শুক্রবার রাতে।
আমরা ঠিক করি একসাথে আমরা ফিরে আসবো একসাথে রবিবার।
প্রোগ্রাম শেষ হয়ে গেলে, ওর ব্যান্ড মেম্বাররা শনিবার সকালেই ফিরে চলে যায় কলকাতায়। স্নিগ্ধা চলে আসে আমার হোটেলে। এই প্রথম, আমরা পুরোপুরি একা ! সামনাসামনি , আর কেউ কোথাও নেই। সারাদিন আমরা একসাথে ঘুরে বেড়িয়ে , কামাক্ষ্যা মন্দিরে গিয়ে আমাদের আগামী দিনগুলো যাতে ভীষণ ভালোভাবে কেটে যায় সেই প্রার্থনা করে , ফিরে আসি বিকেলে।
এতটা বলার পরে থামলো বিতান। সোফা থেকে উঠে, ফ্রিজ খুলে জলের বোতল বের করে টেবিলের ওপরে রাখা গ্লাসে জল ঢেলে মেহেকের দিকে বাড়িয়ে নিজে ঢকঢক করে জল ঢেলে নেয় গলায়। মেহেক চুপ করে হাত বাড়িয়ে গ্লাসটা টেনে নেয় নিজের কাছে। সত্যি ভীষণ জল তেষ্টা পেয়েছে। ঘড়ি বের করে সময় দেখে মেহেক। সময় প্রায় সাড়ে এগারোটা। ওর কন্ট্রাক্ট অনুযায়ী সাড়ে দশটাতেই ওর চলে যাওয়ার কথা। ওদেরকে শেখানো হয়েছিলো কোনো ক্লায়েন্টের সাথে যেন মানসিক ভাবে ওরা ঘনিষ্ঠ না হয়ে পড়ে। এতমাস ধরে সেটাই অক্ষরে অক্ষরে পালন করে এসেছে মেহেক। ও সার্ভিস দিয়েছে, কাজ শেষে টাকা নিয়ে বেরিয়ে গেছে। কিন্তু এবার ঘটনাপ্রবাহ যেন ওর নিজের ধরাবাঁধার বাইরে চলে গেছে। কিছুতেই জোর করে বেরিয়ে আসতে পারছে না ও। ভীষণ কৌতূহল হচ্ছে ওর জানতে - চিনতে - বুঝতে বিতান কে।
মেহেক জিজ্ঞেস করে ওঠে, " এতো প্রেম, এতো ভালোবাসা, তারপরে যেখানে আপনাদের বিয়ে হলো, এতো সুন্দর একটা ছোট ছেলে আপনাদের, তাহলে....তারপরেও কি হলো ? কেন ভেঙে গেলো সবকিছু ? কেন এই দুঃখের বোঝা বুকে চেপে আছেন আপনি ? কেন বেরিয়ে আসতে পারছেন না ? আর আপনার স্ত্রী ? মানে স্নিগ্ধাদি ? "
দীর্ঘ একটা শ্বাস নিয়ে মাথাটা দুদিকে নেড়ে , নিচের দিকে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে থাকে বিতান কিছুক্ষণ। একটু পরে হতাশ ভঙ্গীতে বসে পড়ে সোফার ওপরে। ধীরে ধীরে বলে ওঠে, "আসলে , ভুলটা হয়তো আমার। বা হয়তো ভুলটা স্নিগ্ধার। বা হয়তো ভুলটা দুজনেরই ! জানি না মেহেক। মাঝে মাঝে নিজেকে প্রশ্ন করি , যতই উত্তর খুঁজতে যাই, আরো গভীরে তলিয়ে যেতে থাকি। সম্পর্ক তৈরী করা যতটা সোজা, তার থেকে অনেক বেশি সোজা হয়তো সেটা থেকে বেরিয়ে আসা। বেরিয়ে আসতে শুধু একটা ছোট্ট কারণই যথেষ্ট , একজন আরেকজনের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে , অন্যকে অপরাধী প্রমাণ করে বেরিয়ে আসতে খুব একটা সময় লাগে না। কিন্তু সেটা তো,যেখানে ভালোবাসা থাকে না ! আমি তো তাই জানতাম। অথচ আমাদের দুজনের মধ্যে এতো টান - ভালোবাসা - প্রেম সবকিছুর পরেও কিকরে যে এরকম হয়ে গেলো ! আমি আজ আর ভাবি না , ভাবতে চাই না ! তবে কিছু জিনিস আছে, যেটা আমরা জেনেও না জানার ভান করে থাকি , বা অস্বীকার করি সবার সামনে। অথচ মনের গভীর গোপনে আমরা জানি কোনটা ঠিক বা কোনটা ভুল। যখন আমরা প্রেম করি, বা কাউকে ভালোবাসি, বা কারোর সামনে নিজেকে তুলে ধরি যাতে সামনের মানুষের ভালোবাসা পেতে পারি, তখন আমরা কি করি মেহেক ? আমরা আমাদের দোষ ত্রূটি গুলো দূরে সরিয়ে নিজেদের ভালো হওয়ার মুখোশটাই তাদের সামনে তুলে ধরি। আমাদের ভেতরে খারাপ দিক গুলো কিন্তু আমরা সযত্নে লুকিয়ে রাখি। যখন সেই দুটি মানুষ পরে একসাথে, এক ছাদের তলায় এসে বসবাস শুরু করে, প্রথম কয়েকটা প্রেমের রামধনুতে রাঙানো রঙিন মাসগুলোর পরে, একে অপরের অন্যদিকটা - নতুন করে আবার চিনতে শুরু করে। সেই মানিয়ে নেওয়ার ব্যাপারটা অনেকেই মেনে নেয় ; কিন্তু কিছু মানুষ থাকে, যারা মানতে পারে না ! তখন তারা বারেবারে তাদের প্রেম পর্যায়ের সেই মানুষটিকে খুঁজতে থাকে সম্পর্কের মধ্যে। আর তাকে না পেলেই শুরু হয়ে যায় অশান্তি। আবার এর আরো একটা দিক আছে - একটা মেয়ে বিয়ের পরে যখন তার মা-বাবা-ভাই-বোনের চেনা পরিচিত পরিসর ছেড়ে নতুন একটা পরিবারে চলে আসে ,তখন সেই নতুন পরিবারের সবকিছু মানিয়ে নিতে তারও কষ্ট হয়। নতুন পরিবারে সবাই মেয়েটিকে সাহায্য করলেও, সে কোথাও যেন সেই নিজের যে একটা স্বাধীনচেতা মন, নিজের অস্তিত্ত্বকে একটু হলেও বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়। আর আমাদের সমাজটাই এমন যে সেটা করতে বাধ্য করা হয় মেয়েদের। এটাই হয়ে এসেছে, হয়ে চলেছে, হয়তো ভবিষ্যতেও হবে। হয়তো এইসব কিছু নিয়েই আমাদের মধ্যেও একটা চিড় ধরে গিয়েছিলো , আর তার চূড়ান্ত পরিণাম আমাদের বিচ্ছেদে। তবে কিভাবে কি হয়েছিলো জানতে গেলে, আমাদের আরো পিছিয়ে যেতে হবে, সেই গৌহাটিতে , যেদিন আমরা , মানে বিয়ের মাস চারেক আগে আমি আর স্নিগ্ধা একসাথে ছিলাম প্রায় দেড়দিন। " একটু থেমে মেহেকের গোলগোল চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে বিতান , "সরি, আপনাকে আমি বোর করছি না তো ? আসলে আমি বকবক করতে শুরু করলে , যা মনের ভেতরে আসে, বকেই যাই ! "
হেসে মেহেক বলে, "না না ! আপনি ভাববেন না। আর আমি তো শুনতেই চাই আপনার কথা। তাই না ? আপনি বলুন। আপনার সব কষ্ট উজাড় করে দিন অপার সামনে। আপনি হয়তো জানেন না, কত মানুষ তাদের মনের কথা বলার সুযোগ পায় না , ভেতরে ভেতরে গুমরে মরতে থাকে।"
বিকেলে রুমে ফিরে আসার পরে, আমরা বারান্দায় বসি , হাতে হাত রেখে, পাশাপাশি, দুটো চেয়ারে। অনেকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করার জন্য দুজনেই ক্লান্ত ছিলাম ভীষণ, আমি তাই রুম সার্ভিসে ফোন করে দুটো কফি অর্ডার করবো বলে উঠতে যাই বারান্দার চেয়ার থেকে। স্নিগ্ধা আমার দিকে তাকায় গভীরভাবে - ওর সেই সমুদ্র ঘন নীল চোখদুটো দিয়ে। ধীরে ধীরে উঠে এসে বসে আমার কোলে, ঠিক যেমন একটা বাচ্চা তার বাবা বা মায়ের কোলে এসে বসে - সেইভাবে। আমার মুখের কাছে নিজের মুখটা এনে বলে ওঠে ,"এতো সুন্দর একটা পরিবেশ, পাহাড়ে ধীরে ধীরে সন্ধে নেমে আসছে , বাইরে এতো মনোরম হাওয়া, ধীরে ধীরে ঠান্ডার পরশ ছড়িয়ে পড়বে আমাদের ওপরে। এইসময় কি কফি ভালো লাগে ? তুমি বরং ওদের 'বিকিনি মার্টিনি' দিতে বলো ! আমি অনেকদিন আগে একবার খেয়েছিলাম, সেই কলেজের ফার্স্ট ইয়ার এ পড়ার সময়। ওটা ভোদকা , কোকোনাট রাম আর পাইনাপেল জুস দিয়ে তৈরী হয়। খুব ভালো লাগবে , তুমি দেখো। " হাত থেকে বার এর মেনুকার্ড নামিয়ে রাখে পাশে স্নিগ্ধা।
আমি কেমন যেন সম্মোহিত হয়ে গিয়েছিলাম সেই দিন, স্নিগ্ধার কথামতো অর্ডার করলাম 'বিকিনি মার্টিনি' । এর ফাঁকে স্নিগ্ধা বারান্দা থেকে চেয়ার দুটো সরিয়ে নিয়ে, ভেতরের রুম থেকে বের করে আনে দুটো ব্ল্যাঙ্কেট। একটা ব্ল্যাঙ্কেট বারান্দার মেঝেতে পেতে দিয়ে, আরেকটা পাশে রেখে বসে পড়ে ওর ওপরে।
আমাকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করে স্নিগ্ধা, "কি হলো ? কি দেখছো ?
আমি কাব্য করে বলে উঠি ,
"দেখছি গোধূলি আলোতে ,
আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যেকে ;
এসেছে সে সাজিয়ে তুলতে,
আমাকে - আমার জীবনকে যতনে। "
লজ্জা পেয়ে স্নিগ্ধা ঘুরিয়ে নেয় ওর মুখ অন্য দিকে । আমি ধীরে ধীরে এসে পাশে বসি , ওর চিবুকের নিচে হাত রেখে - কনে দেখা আলোতে লাজুক মুখটাকে ধীরে ধীরে ঘুরিয়ে, টেনে আনি নিজের দিকে, নিজের কাছে। স্নিগ্ধার দু চোখের পাতা, স্পর্শ করে আমার ঠোঁট। আবেশে বন্ধ হয়ে আসে চোখের পাতা দুটি। ঠান্ডায় লাল হয়ে যাওয়া গালের ওপরে নেমে আসে উষ্ণ ঠোঁটের পরশ , তিরতির করে কেঁপে ওঠে স্নিগ্ধার দুটি ঠোঁট। কাঁপতে থাকা ঠোঁটদুটি ধীরে ধীরে খুলে যায় , অপেক্ষা করতে থাকে আমার স্পর্শের, ঠোঁটের। আমার নিজের চোখ দুটোও বন্ধ হয়ে যায়, একটা মধুর সম্ভাবনার আনন্দে মনটা ভরে ওঠে। স্নিগ্ধা হাতড়ে হাতড়ে খুঁজে নেয় আমার হাত , হাতের আঙ্গুল। নিজের নরম হাত ঢুকিয়ে দেয় আমার হাতের মুঠোতে। আমি অনুভব করি ওর গরম নিঃশ্বাস প্রশ্বাস , বাড়তে থাকা একটা চাপা উত্তেজনা ধীরে ধীরে পাগল করতে থাকে আমাদের। ধীরে ধীরে আমার ঠোঁট নেমে আসে ওর ঠোঁটের ওপরে।
ডিং ডং - ঠিক তখনই দরজায় এসে হানা দেয় - বেরসিক রুম সার্ভিসের ছেলেটি। মুখ শুকনো করে আমি উঠে আসি, পেছন থেকে ভেসে আসে স্নিগ্ধার খিলখিল করে হাসির আওয়াজ। আমি ফিরে আসি দু গ্লাস 'বিকিনি মার্টিনি' নিয়ে। আমার রাগী মুখ দেখে উঠে আসে স্নিগ্ধা, আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে ওঠে ,"রাগ হয়েছে তোমার ? এতো রাগ ? আচ্ছা আর রাগ করতে হবে না। আমি সব সুদে আসলে শোধ করে দেবো। এবার এসো তো, আমার পাশে এসে বসো , গ্লাসে অল্প চুমুক দাও, আর ধীরে ধীরে পাহাড়ের ওপরে নেমে আসা সন্ধেটা উপভোগ করো। "
আমি আর স্নিগ্ধা পাশাপাশি বসলাম নিচে , গায়ে জড়িয়ে নিলাম ব্ল্যাঙ্কেটটা ভালো করে। আমি বারান্দার দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসলাম আর স্নিগ্ধা আমার বুকে মাথা রেখে। ধীরে ধীরে গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে যখন সন্ধেটা হবো হবো করছে, স্নিগ্ধা শুরু করলো শহর ব্যান্ডের একটা জনপ্রিয় গান,
যখন.. নীরবে দূরে, দাঁড়াও এসে
যেখানে পথ বেঁকেছে।
তোমায় ছুঁতে চাওয়ার মুহূর্তরা
কে জানে কি আবেশে দিশাহারা
আমিও ছুটে যাই সে গভীরে
আমিও ধেয়ে যাই কি নিবিড়ে
তুমি কি মরীচিকা না ধ্রুবতারা। .......
গানের শেষে কখন যে ওর ঠোঁট এসে আমার ঠোঁটে মিশে গেলো, বুঝতে পারিনি। কতক্ষণ আমরা পরস্পরের ঠোঁটের মধ্যে ডুবে ছিলাম সেদিন, সাক্ষী ছিলো শুধু রাতের কালো আকাশ, অনেক ওপরে মিটমিট করতে থাকা কিছু তারা আর দূর আকাশের বাঁকা একফালি হাসতে থাকা চাঁদের টুকরো। ধীরে ধীরে গ্লাস দুটো পাশে সরিয়ে আমরা দুজনেই ঢুকে পড়লাম ব্ল্যাঙ্কেটের মধ্যে , শুয়ে পড়লাম বারান্দাতেই মেঝের ওপরে।
বিতানকে হঠাৎ থামিয়ে দেয় মেহেক। মেহেক বলে ওঠে ,"আর ডিটেলস এ প্লিজ বলবেন না। মানে এইসব মোমেন্টস, মুহূর্তগুলো আপনাদের ভীষণ একার, ব্যক্তিগত। এগুলো মনের ভেতরে গেঁথে যাওয়া মণি মুক্তো ! এগুলোকে খুঁড়ে আনছেন কেন আপনি ? কেন বিতান ?
বিতান হেসে ওঠে , মুখটা একটু বিকৃত করে বলে ওঠে, "ঠিক বলেছেন মেহেক। আপনি সত্যি কথাই বলেছেন। তবে এর মধ্যেই হয়তো সেই বিচ্ছেদের রেখা আঁকা হয়ে গিয়েছিলো, সেদিন যেটা বুঝতে পারিনি ভালো করে। ভেবেছিলাম দুজনেই, সব ঠিক হয়ে যাবে সময়ের সাথে। "
"মানে ? ঠিক বুঝলাম না। " অবাক হয়ে ওঠে মেহেক।
সেদিন আমরা কেউ আর নিজেদের মধ্যে ছিলাম না। স্বাভাবিক জৈবিক তাড়নায়, ভালোবাসায় বা প্রেমে নিজেদেরকে সমর্পণ করে দিয়েছিলাম একে অন্যের কাছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা আমাদের জামাকাপড় সব ছেড়ে, পাশে রেখে, ঠান্ডা আর আকাশ থেকে ড্যাবড্যাব করে আমাদের দেখতে থাকা চাঁদের কাছ থেকে নিজেদের লুকোতে, ব্ল্যাঙ্কেট ঢাকা দিয়ে লুকিয়েছিলাম দুজনের নগ্নতাকে। জীবনে প্রথমবার, নিজের জীবনসঙ্গীকে সম্পূর্ণ ভাবে নিজের করে পাওয়ার উত্তেজনা বা অন্য কোনো দুর্বলতার জন্য কিনা জানিনা , মাত্র দেড় মিনিটের মধ্যেই আমি তৃপ্ত হই, জড়িয়ে ধরি সজোরে অতৃপ্ত স্নিগ্ধাকে। স্নিগ্ধা তখনও আমাকে জড়িয়ে, আমাকে উল্টে দিয়ে আমার ওপরে বসে পেতে চাইছিলো চরম সুখ। সেদিন সেই সুখ আমি দিতে পারিনি ওকে। একটু পরে হতাশ, ব্যর্থ স্নিগ্ধা নেমে পড়ে আমার ওপর থেকে, কোনো কিছু না বলে চুপ করে শুয়ে থাকে অন্যদিকে ঘুরে। ওকে আমি পেছন থেকে জড়িয়ে ধরি, ও আমার হাত সরিয়ে দেয়। পরে ধীরে ধীরে আমার দিকে ঘুরে আমার বুকের মধ্যে মাথা গুঁজে দেয়। "
পরে আমাকে বলে স্নিগ্ধা , "বিতান প্লিজ রাগ কোরো না আমার আচরণের জন্য। আসলে আমি ভেবেছিলাম আমাদের প্রথম মিলন হবে একদম স্বপ্নের মতো, ঠিক যেরকম বিভিন্ন গল্প বা উপন্যাসে পড়ি। তবে এটা তোমার ও প্রথমবার, আমার ও তাই , তাই হয়তো সেরকম কিছু ঘটেনি , তবে তুমি দেখো, সব ঠিক হয়ে যাবে। বিয়ের পরে , যখন নিয়মিত আমরা একসাথে....সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। আর যাই হোক না কেন বিতান, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা করতে হবে না তোমাকে। তুমি আরো, আরো কবিতা লিখবে, আমি সেই কবিতায় সুর দিয়ে গানে গানে ভরিয়ে তুলবো আমাদের ভালোবাসার ছোট্ট নীড় !"
কিন্তু কোনো কিছুই আর ঠিক হয় নি কখনও।
মাস চারেক পরে ধুমধাম করে আমাদের বিয়েও হয়ে গেলো। বিয়েতে ইন্ডাস্ট্রির কিছু লোকজন এসেছিলো, যারা ওর বাবার সাথে কাজ করেছে বা ওর বাবাকে চিনতো। সেই প্রথমবার পর্দার আড়ালে থাকা তারকাদের দেখলাম চোখের সামনে। আর সেখানেই দেখা হলো পারভীনের সাথে।
"মেহেক, আপনি বুঝতে পেরেছেন তো ? আমি কোন পারভীনের কথা বলছি ? "
মেহেক জিজ্ঞেস করে, "পারভীন ? আপনি কোন পারভীনের কথা বলছেন ? ওই সিনেমা করে ? " বিতান উত্তর দেয় ,"ঠিক ধরেছেন। আমি ওর কথাই বলছি। "
"সরি, আমি ঠিক জানি না ! মানে আমি সিনেমা দেখি না একদম। আমার না টাকা করে সিনেমা দেখতে একদম ইচ্ছে করে না। কেন জানেন ? আমার মনে হয় এই সব এক্টর এক্ট্রেসরা সিনেমা করে যে এতো এতো টাকা পয়সা কামায়, ওরা কি, তার সত্যি যোগ্য ? এদিকে ওরা প্রোগ্রাম করছে, পূজোর সময় এসে ফিতে কাটছে , সিনেমা করছে , কোটি কোটি টাকা কামাচ্ছে , আর তারপরে বাইরে ঘুরতে যাচ্ছে , লাক্সারিয়াস লাইফ কাটাচ্ছে। কিন্তু সেটা কাদের টাকা পয়সার ওপরে ? আমাদের উপার্জিত , ঘাম ঝরানো টাকা পয়সায় ! অনেক কিছুই তো ওদের মেকি , ওদের পুরো জীবনটাই হয়তো এইরকম। আর আমরা ওদের কে নিয়ে উন্মাদনায় মেতে উঠি। এইটাই আমার কাছে আশ্চর্যের। তাই আমি ঠিক খুব একটা সিনেমা দেখতে পছন্দ করি না। " উত্তর দেয় মেহেক।
হেসে ওঠে বিতান হা হা করে। একটু পরে মেহেকের হাতের ওপরে হাত রেখে বলে , "ঠিক আছে। আপনার কথার পেছনেও ভালোই যুক্তি আছে। তবে আমাদের গল্পটা সেটা নয় ! স্নিগ্ধা আর পারভীন কাজ করতে করতে খুব কাছাকাছি চলে এসেছিলো। সেটা কবে, কিভাবে, আমি জানি না ! হয়তো পারভীনের একটা সিনেমায় গান করার সময়েই। ওই সিনেমায় একটা ভীষণ ইন্টিমেট ধরণের গান ছিলো ! সেই গানটা গেয়ে আমাকে যখন শুনিয়েছিল স্নিগ্ধা পরে, আমি ওর চোখে অন্যরকম একটা ভাষা দেখতে পাই। সেই ভাষা, যেটা দিয়ে যে কোনো পুরুষকে আহত করা যায় ! হয়তো সেটাতেই পারভীন ও.....সেদিনের পর থেকে মাঝে মাঝেই রাতে বেরিয়ে যেত স্নিগ্ধা। বলতো রেকর্ডিং আছে , গানের। আমিও প্রথমে কিছুই বলতাম না। হাজার হোক, ওটাই ওর কাজ, ভালোলাগা। আমি কেন বাধা দেবো ? এইভাবে কেটে যায় বেশ অনেকটা সময়। বেশ কিছু ভালো হিট গান ও গায় স্নিগ্ধা সেই সময়। ও মাঝে মাঝে প্রোগ্রাম ফাংশন করা শুরু করে আবার। আমার আজও মনে আছে সেই অভিশপ্ত দিনটা। সেই দিনের একসপ্তাহ পরেই ছিলো শৌনকের জন্মদিন। সেদিন আমাদের একসাথে রাতে বেরোনোর কথা ছিলো ! আমি আর শৌনক অপেক্ষা করছিলাম বাড়িতে। তখন প্রায় সন্ধে সাড়ে আটটা। হঠাৎ বাইরে গাড়ির আওয়াজ। আমি দেখি পারভীনের কাঁধ জড়িয়ে নামছে স্নিগ্ধা। আগেই কানাঘুষো একটা খবর শুনেছিলাম , কিন্তু কখনও পাত্তা দিই নি। কিন্তু সেদিন আমি দেখলাম, ওই অন্ধকারের মধ্যে দিয়েও। গাড়ি থেকে নেমে পারভীনকে জড়িয়ে দুজন দুজনকে চুমু খেলো অনেকক্ষণ ধরে। স্নিগ্ধার শাড়ির ওপরে, ব্লাউজের ওপরে উঠে আসে পারভীনের হাত। আমার মাথা যেন কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিলো সেদিন। মানছি, আমি হয়তো স্নিগ্ধাকে সেই সুখ দিতে পারি নি। কিন্তু তা বলে এতটা নিচে নেমে যাবে স্নিগ্ধা ? ও আমাকে ডিভোর্স দিয়ে যার সাথে খুশি থাকতে পারতো , ওকে তো আমি কতবার বলেছিলাম আগে ! স্নিগ্ধা একটু পরে ওপরে উঠে আসে। আমাকে আর শৌনককে দেখেই হেসে বলে ওঠে , 'সরি। আমার একটু লেট হয়ে গেলো। তোমরা রেডি ? আমাকে একটু সময় দাও, আমি ফ্রেশ হয়ে, ফিরে আসছি। ' আমি শৌনককে ডেকে বললাম 'তুমি একটু তোমার রুমে যাও তো , খেলা করো তোমার টেডি নিয়ে।' স্নিগ্ধা বোধয় বুঝতে পেরেছিলো যে আমি দেখেছি সব। ও আমার কাছে এসে বললো, শোনো, তুমি যা ভাবছো ওরকম কিছু নয় ! আমাদের এই ইন্ডাস্ট্রিতে এভাবেই লোকজন আরেকজনের সাথে মেলামেশা করে। এতে আমাদের কাজ পেতেও সুবিধে হয়। নাহলে আমাদের গানের লাইনে এতো কম্পিটিশন , বোঝোই তো। '
আমি শুধু ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম,'কিন্তু কেন স্নিগ্ধা ? আমার সাথেই কেন করলে এরকম ? ' শৌনক তখনও দাঁড়িয়ে ওখানেই। স্নিগ্ধা হঠাৎ করে রেগে ঘুরে আমার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,'কেন? কেন ? তুমি বুঝতে পারো না ? নিজেকে তুমি পুরুষ বলো ? লজ্জা করে না? পুরুষত্বহীন একটা প্রাণী , পৃথিবীর বোঝা বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছো ! আর তুমি আমাকে কি বলছো ? আমি কিছু জানি না ভেবেছো ? দিনের পর দিন, রাতের পর রাত এই যে অফিসে কাজ করার নামে নিজের সেক্রেটারির সাথে ঘুরে বেড়াও, তখন কিছু না ? ভালো করে শুনে রাখো বিতান , এই শরীর আমার , এর ওপরে সব অধিকার আমার আছে। সেটা আমি কাকে দেবো, কেন দেবো , সেটা নিয়ে কোনো কৈফিয়ত আমি তোমাকে দিতে বাধ্য নই !' আমার কাছে এগিয়ে এসে আমার জামার কলার ধরে চেঁচিয়ে ওঠে স্নিগ্ধা , 'তুমি, তুমি সারাজীবন আমাকে উপোসী করে রাখবে, সেটাতো হতে পারে না , তাই না ? তোমরা ছেলেরা বাইরে গিয়ে এর ওর সাথে শুয়ে আসবে, নিজেরা মজা করবে , ফ্লার্ট করবে তখন কিছু না ! আর আমরা মেয়েরা একটু রাত করে বাইরে থেকে এলে, তখন খুব অপরাধ হয়ে গেলো ? ' ও রাগে কাঁপছিলো সেদিন প্রচন্ড। আমি ধীর ধীরে বললাম,'তুমি যার কথা বলছো, সে কিন্তু আমার থেকে অনেকটাই বড়ো ! মারিয়া আমার সেক্রেটারি হলেও, ওকে আমি নিজের দিদির মতো শ্রদ্ধা করি। আমি কখনও এরকম কিছু ভাবিনি , শুধু মারিয়া কে নিয়ে কেন, অন্য কাউকে নিয়ে কখনও এরকম কোনো ভাবনাই আমার মাথায় আসে নি। আমার সারাটা জীবন জুড়ে শুধু তুমি আর আমাদের শৌনক ! ' আমার দিকে হেসে তাকিয়ে , কটাক্ষ করে স্নিগ্ধা বলে ওঠে ,'তাই ? শুধুই দিদির মতো; নিজের দিদি তো নয়! আর আমাকে শেখাতে এসো না কিছু। আর যদি কিছু না ও থাকে , সেটা তোমার প্রবলেম - আমার নয় ! কেন বুঝতে পারছো না বিতান, আমার তোমাকে নিয়ে কোনো সমস্যা নেই , আমি জানি তুমি আমাকে কত ভালোবাসো , আমার জন্য তুমি সব কিছু করতে পারবে। কিন্তু আমাকে তুমি সেই সুখ কখনোই দিতে পারবে না। আমি কি করবো বিতান ? কেন আমি সাফার করবো ? আমার কাছে শরীর নিয়ে কোনো লজ্জা ঢাকগুড়গুড় কিছুই নেই। আমার শরীর কতদিন উপোসী ছিলো জানো ? জানো তুমি ? তাহলে ? কেন আমাকে বাধা দিচ্ছ ? আমি, আমার তো অন্য কোনো সম্পর্ক নেই পারভীনের সাথে। আমার ওর সাথে শুধুই....কোনো মনের মিল নেই আমাদের, নেই কোনো প্রেম ভালোবাসা। আমি অস্বীকার করি সেই ভাবনাকে, যেখানে বলা হয়, নিজের স্বামী ছাড়া অন্য কেউ আমার শরীর স্পর্শ করলে আমি নষ্ট মেয়ে হয়ে যাবো ! আমাদের সমাজ একটা নারী পুরুষের মধ্যে কেন বিয়ে দেয় জানো ? যাতে একটা নারীর শরীর আর মন - কোনো পুরুষের সম্পত্তি হয়ে যায় ! তুমি কি আমাকে সেইরকম মনে করো ? তুমি কি মনে করো আমি তোমার সম্পত্তি? তুমিই তো বলো তোমার পাশে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে। তুমিই তো চাও যাতে আমি সবসময় ভালো থাকি, সব দিক থেকে। তাহলে কেন এখন আমার দিকে আঙ্গুল তুলছো ? আমি আমার জীবনের অসম্পূর্ণতাকে সম্পূর্ণ করেছি, করছি। খিদে পাওয়া, ঘুম আসার মতোই শরীরের ও চাহিদা থাকে। সেটাকে আমি কেন অস্বীকার করবো , বলতে পারো ? অনেকদিন তো বাচলাম আমি তোমাদের সবার কথা ভেবে। একটু নিজের কথাও ভাবি ! সেটা কি অন্যায় ? ' আমি কিছুই বলতে পারছিলাম না স্নিগ্ধার যুক্তির সামনে। ও যা বলেছে, তার মধ্যে আমি অন্যায় কিছু পাই নি। ও তো সব সত্যি কথাই বলেছে। ভীষণ রূঢ় বাস্তব। আর আমার নিজের ও তো সমস্যা ছিলো, আছে, থাকবেও। আমি তো এক রকম অপরাধী ওর জীবনে। তবুও আমি, এই অসম্পূর্ন আমি, এই অক্ষম আমি, ওকেই যে ভালোবাসি। আমি যে সহ্য করতে পারছি না অন্য কাউকে ওর জীবনে। আমি, আমি কিছু করতেও পারছি না। হয়তো অন্য কেউ থাকলে স্নিগ্ধাকে খুব মারতো, ঘর থেকে বের করে দিতো। কিন্তু আমি পারিনি, মেহেক। আমি সেসব কিছুই পারিনি। আমি শুধুই ওকে বলেছিলাম, 'স্নিগ্ধা, আমরা তো বিবাহিত। তুমি আমাদের বিয়ের সম্পর্কের মাঝে, আরেকজনকে কি করে নিয়ে এলে ? নাহয়, তুমি আমাকে ছেড়ে দিতে, ডিভোর্স দিয়ে দিতে। আমি সব মেনে নিতাম। কিন্তু এখন আমি এটা কিছুতেই মানতে পারছি না। '
আবার রেগে ওঠে স্নিগ্ধা। চিৎকার করে বলে ওঠে ,'এটাই, এটাই তোমাদের সমস্যা। পারভীন একদম ঠিক বলেছিলো। ইউ আর আ লুসার। আসলে তোমরা চাও না একটা মেয়ে নিজের মতো করে নিজের শর্তে বাঁচুক। তাকে কোনো না কোনো গন্ডীর মধ্যে, শেকল দিয়ে বেঁধে রাখতে চাও। কেন যে তোমাকে আমি বিয়ে করেছিলাম কে জানে। ' তখন, ঠিক সেই মুহূর্তে আমার মনে হলো, পারভীন ? পারভীন এখানে কেন এলো ? আমাকে নিয়ে কিছু বলার অধিকার কে দিয়েছে ওকে ? তার মানে, তার মানে কি স্নিগ্ধা আমাদের সম্পর্কের কথা ওর সাথে শেয়ার করেছে ? আমিও চেঁচিয়ে উঠলাম, 'তোমার, তোমার এতো বড়ো সাহস যে তুমি আমাদের কথা বাইরের লোকের সামনে বলেছো ? আমাদের মধ্যে যাই হোক না কেন, তুমি সেটার মধ্যে আরেকজনকে...' আমি কেঁদে উঠলাম, লজ্জায়, রাগে, অপমানে, স্নিগ্ধার নির্বুদ্ধিতায়। শৌনক দাঁড়িয়েছিলো পাশেই, ও নিজেও কাঁদতে শুরু করে সব দেখে। ওর হাত টেনে ধরে ভেতরে নিয়ে চলে যায় স্নিগ্ধা, বলতে থাকে, তোর বাপ একটা অমানুষ , নোংরা লোক, ওর সাথে থাকা যায় না ! তোকে নিয়ে আমি চলে যাবো অনেক দূরে, আমার সাথে। শৌনকের রুমের দরজা বন্ধ করে বাইরে বেরিয়ে এসে আমাকে কাঁদতে দেখে বলে ওঠে স্নিগ্ধা , 'শোনো, অনেক নাটক হয়েছে। তোমার সাথে আমি আর থাকতে পারবো না। আমার ডিভোর্স চাই তোমার থেকে। অনেকদিন তোমাকে সহ্য করেছি, আর পারছি না। ' আমি ধীরে ধীরে জিজ্ঞেস করলাম, ' তোমার এইসব কথা, এই সব যুক্তি, এগুলো আসলে পারভীনের , তাই না ? এগুলো, এগুলো তো আমার স্নিগ্ধার....'
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই দেওয়ালের ওপরে রাখা একটা বড়ো ফটো ফ্রেম ছুঁড়ে মেঝেতে মারে স্নিগ্ধা। হাতের সামনে একটা ফ্লাওয়ার ভাস ছিলো, সেটাকেও জোরে মেঝেতে ফেলে দেয়। তারপরে আমার কাছে এসে আমাকে প্রচন্ড ভাবে মারতে মারতে একসময় ক্লান্ত হয়ে ভেতরে চলে যায়। একটু পরে শৌনককে নিয়ে বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে। "
শৌনককে জোর করে হাত ধরে টেনে নিয়ে, বাইরে বেরোনোর দরজার দিকে যাচ্ছিলো স্নিগ্ধা ! আমি তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে ওদের সামনে দাঁড়াই গিয়ে। আমি শেষবারের মতো চেষ্টা করি , বলে উঠি , "স্নিগ্ধা , প্লিজ ! এরকম কোরো না। আমাদের মধ্যে যা হয়েছে, আমরা আলোচনা করি। এভাবে রাগারাগি করছো কেন ? আর, আমি, আমি তোমাকে ছেড়ে...কি করে ? কি করে থাকবো স্নিগ্ধা? আর শৌনক? ও কি দোষ করেছে ? ও তো আমাদের দুজনের সন্তান। আমাদের ছেলে ? ওর কথাটা ভাববে না তুমি? " আমাকে ঠেলে সরিয়ে দেয় স্নিগ্ধা ওর রাস্তা থেকে। চেঁচিয়ে ওঠে, "তোমার মতো একটা লোককে বিয়ে করেই আমার সবথেকে বড়ো ভুল হয়েছে। তখন বয়স কম ছিলো, তোমার মিষ্টি কথায় ভুলে গিয়েছিলাম সব কিছু। শৌনক শুধু আমার ছেলে। ওকে আমি জন্ম দিয়েছি, ওর সব দায়িত্ব আমার। " দরজা বন্ধ করে বাইরে বেরিয়ে যায় স্নিগ্ধা। আবার কয়েক সেকেন্ড পরে ভেতরে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে, আমার চোখে চোখ রেখে বলে ওঠে ,"আমাকে ছাড়া তুমি থাকতে পারবে না ? সত্যি ? না কি আমাকে ছাড়া, আমার এই শরীরটাকে না জড়িয়ে ঘুমোলে তোমার রাতে ঘুম আসবে না ? কিন্তু তোমার তো......যাই হোক। তুমি তো ফ্রি এখন। রাস্তায় পথে ঘাটে কত মেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নিয়ে এসো তাদের , রোজ রাতে ! যার সাথে ইচ্ছে হয় ঘুমোও , শুয়ে থাকো , যা খুশি করো। কেউ বাধা দেবে না তোমাকে। আর ওদের তো টাকার বিনিময়ে নিয়ে আসবে , তাই ওদের তোমার থেকে কোনো এক্সপেক্টশনস ও থাকবে না। সেটাই তো ভালো হবে, তাই না ?" আর কোনো কথা না বলে , বাইরের দরজাটা দড়াম করে বন্ধ করে বেরিয়ে গেলো স্নিগ্ধা।
আবার বিতানের চোখ ভরে উঠেছে জলে। মেহেক বিতানের পাশে বসে, জিজ্ঞেস করে,"কেন সেদিন তুমি চুপ করে ছিলে ? কেন কিছু বললে না? কেন সব সহ্য করলে সেদিন ? তোমার তো কোনো ভুল ছিলো না ? তুমি তো তোমার দিক থেকে একদম ঠিক ছিলে ! "
কাঁদতে কাঁদতেই, বিতান বলে ওঠে ,"আমি কি সত্যিই ঠিক ছিলাম ? আমি, আমি ও যে ভুল করেছিলাম, ওকে ভালোবেসে। কিন্তু আমি তো সুখী করতে পারিনি কখনও স্নিগ্ধাকে। সেদিন ও যা বলেছিলো, সেগুলো যে নির্মম সত্যি , সেটা আপনিও জানেন, মেহেক। "
দুজনেই চুপ করে বসে থাকে , কারোর মুখে কোনো কথা নেই। সময় রাত বারোটা।
হঠাৎ দেওয়ালের ঘড়িটার দিকে চোখ পড়ে যায় বিতানের। প্রায় আড়াইটে ! তাড়াতাড়ি মেহেকের দিকে দেখে অপ্রস্তুতের হাসি হেসে বলে ওঠে ,"দেখুন দেখি মেহেক, এতটা সময় ধরে আমরা শুধু গল্পই করে গেলাম ! আপনার তো সাড়ে দশটায় চলে যাওয়ার কথা ছিলো, আর এখন তো মাঝ রাত ! আমার নিজের ওপরেই লজ্জা হচ্ছে এখন। "
মেহেক তাড়াতাড়ি বলে ওঠে ,"আরে এভাবে বোলো না ! প্লিজ বিতান। একটা কথা বলবে ? স্নিগ্ধা চলে যাওয়ার পরে, কার ও সাথে এইভাবে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে কোনো কথা বলেছিলে ? আমি জানি, তুমি বলো নি। আর নিজেই নিজেকে দোষ দিয়ে এসেছো এতদিন ধরে। আরো আগে, কারোর কাছে খুলে বলতে পারলে, এতোটা অপরাধবোধ আসতো না তোমার মধ্যে। কিন্তু স্নিগ্ধা দিই বা কি ? এই তিন বছরে তোমার সাথে একবার ও দেখা করতে আসে নি ? আর তুমি শৌনকের সাথে প্রত্যেক তিন মাসে একবার দেখা করো ? এটা তো অন্যায় ! তুমি প্রতি মাসেই তো একবার করে দেখা করতে পারো। "
কখন কথা বলতে বলতে মেহেক যে বিতানকে 'নিজের', ভীষণ 'কাছের' করে নিয়েছে ও নিজেও জানে না।
বিতান বলে ওঠে, "আসলে, আমি শৌনকের সাথে থাকলেও স্নিগ্ধা অনেক ইস্যু করে। ওকে কিছু কিনে দিতে দেয় না, ওকে আলাদা করে আমাকে কিছু খাওয়াতে দেয় না। আমি নাকি ওর সাথে বেশিক্ষণ থাকলে , ওই একদিনে ওকে এতো আদর দিয়ে ফেলি, সেই আদরে ও নাকি বাঁদর হয়ে যায় , আরো কত কি ! এসব আমার আর ভালো লাগে না। এমনিতে তো জীবনের কাছে হেরেই গিয়েছি। থাকার মধ্যে আছে শুধু আমার নতুন ব্যবসা, সেটাকেই বড়ো করার চেষ্টা করছি। আপনি জানেন মেহেক ? আমি চাকরি ছেড়ে কেন ব্যবসা শুরু করেছি ? চাকরিতে থাকলে একটা নির্দিষ্ট সময় শেষে সেই তো ঘরে ফিরে আসতে হতো ! আর এই ফাঁকা শূন্য ঘর, আমাকে খেয়ে ফেলতো প্রতি রাতে। আমি যেন একটা হাহাকার শুনতে পেতাম সবসময়। মাঝে মাঝে এতো একা লাগতো, চেঁচাতে ইচ্ছে হতো। চেঁচিয়েছি জোরে , কিছু একটা বলে , ফাঁকা শূন্য ঘরে সেটাই আবার প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসতো। ভীষণ ভয় পেতাম আমি। ভীষণ। স্নিগ্ধা আর আমাদের সোনু, চলে যাওয়ার পরে, প্রথম কয়েক মাস, কত রাত আমি না ঘুমিয়ে কাটিয়েছি ! সে একটা সময় ছিলো। তারপরেই আমি চাকরি ছেড়ে ব্যবসা শুরু করি। ব্যবসা করতে গিয়ে সবকিছু নিজে সামলাতে চেষ্টা করি, মানে মার্কেটিং, ফাইন্যান্স, অপারেশন, এইচ আর , সব। আর সব কিছু দেখতে গিয়ে, কাজের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে, নিজের মনকে আমি শান্ত করি ধীরে ধীরে , তার পরে নিজেকে। এতটাই ব্যস্ত হয়ে থাকতাম মাঝে মাঝে, যে কারোর কথা মনেই আসতো না। তবুও, মাঝে মাঝে, কোনো ছুটির দিনে, অলস বিকেলে যখন ভীষণ ভাবে কারোর সঙ্গ পেতে ইচ্ছে করতো, মনে হতো কাউকে জড়িয়ে ধরি, তখন আমি কিছু এজেন্সিতে ফোন করে আপনার মতোই কাউকে হায়ার করতাম। এই তিনবছরে, আপনাকে নিয়ে পাঁচবার এরকম করেছি। কিন্তু আপনাকে বলতে সঙ্কোচ বা লজ্জা নেই এখন - কারোর সাথেই আমি মিলিত হতে পারিনি, কখনও। হয়তো এটাই আমার অভিশাপ , আমার স্নিগ্ধাকে প্রচন্ডভাবে ভালোবাসার পরিণাম ! " একটু চুপ করে যায় বিতান। একটু পরে উঠে দাঁড়িয়ে, এগিয়ে গিয়ে লিভিং রুমের পাশে একটা রুমের দরজা খুলে দিয়ে ইশারা করে মেহেককে ডাকে বিতান।
মেহেক উঠে দাঁড়িয়ে রুমের ভেতরে আসে। বিতান বলে ওঠে,"অনেক রাত হয়ে গেলো মেহেক। এখন আর বেরিয়ে কাজ নেই, গাড়িও পাবেন না! আপনি এই রুমে শুয়ে পড়ুন, একটু ঘুমিয়ে নিন। কাল সকালে , আমার সাথে একটু চা বা কফি খাওয়ার পরে, আমি আপনাকে সামনে ছেড়ে আসবো ! "
মেহেক বলে ওঠে,"আপনাকে অনেক ধন্যবাদ বিতান ! তবে এসবের কি কোনো দরকার আছে ? "
মেহেককে চুপ করিয়ে দিয়ে বিতান বলে ওঠে ,"ধন্যবাদ তো আপনার প্রাপ্তি। আপনি জানেন না , আপনি আমার কি উপকার করেছেন। এতদিন পরে , আপনাকে সব কিছু বলতে পেরে, আমি, আমি ভীষণ হাল্কা অনুভব করছি। অনেকদিন ধরে ভেতরে বিভিন্ন কথা - প্রশ্ন - ভাবনা - চিন্তা জমতে জমতে, একটা বিশাল বড়ো কোনো পাথর যেন চেপে বসে গিয়েছিলো ! আর ওর নিচে আমি, আমার আমিত্বটাকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। আজ অনেকদিন পরে , অনেক অনেক দিন পরে খুব ভালো লাগছে। আজ আমার আবার লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে। আপনি শুয়ে পড়ুন, ঘুমিয়ে নিন। আমি এখন একটু লিখবো।" বিতান রুমের দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে বেরিয়ে আসে ! " অনেকদিন কোনো কবিতা লেখা হয় নি, অনেকদিন ! " বলতে বলতে ওর তৈরী করা ছোট লাইব্রেরিতে এসে ঢোকে বিতান, টেনে নেয় খাতা কলম !
স্নিগ্ধার কথা
"মা, ও মা ! শোনো না , দুদিন পরে আমার জন্মদিনে, আমাকে একটা বাইসাইকেল কিনে দেবে ? একদম টুকটুকে লাল রঙের ? ওই যে স্ট্রেট হ্যান্ডেল, গীয়ার দেওয়া ? জানো ওই রূপান এর ও একটা স্ট্রেট হ্যান্ডেল সাইকেল আছে , আর মাতঙ্গ এর ও আছে। তবে ওদের কারোরটায় না গীয়ার নেই। আর, আর ওই যে সাইকেলের হ্যান্ডেলের নিচে বোতল রাখার জায়গা থাকে , সেরকম ও একটা থাকতে হবে ! কি গো ? বলো না, কিনে দেবে ? " স্নিগ্ধাকে ধরে হাত ধরে টানতে টানতে জিজ্ঞেস করে ওঠে আট বছরের শৌনক।
স্নিগ্ধার এখন কোনো সময় নেই কোনো দিকে তাকানোর। যদিও এখন ঘড়ির কাঁটা দৌড়োচ্ছে নটার দিকে, তবুও কাজ যেন শেষ হয়েই চাইছে না। আর তার মাঝে এই ছেলের একঘেয়ে ঘ্যানঘ্যান, বিরক্ত হয়ে ওঠে স্নিগ্ধা। সুপর্ণা গেলো কোথায় ? কান থেকে হেডফোনটা খুলে জোরে ডাক ছাড়ে স্নিগ্ধা ,"সুপর্ণা ? এই সুপর্ণা ! একটু এসে সোনু কে নিয়ে যা তো , টিভিটা ছেড়ে দে। আর ওকে খাইয়ে দে। " আমার কানে হেডফোন লাগিয়ে নেয় সুপর্ণা। রাতে একটার সময়ে কল টাইম দিয়েছে স্টুডিও থেকে।
শৌনক মুখটা শুকনো করে ছেড়ে দেয় মা কে। ধীরে ধীরে সরে আসে মায়ের কাছ থেকে। মা যেন কিরকম হয়ে যাচ্ছে এখন। ঘরে থাকতেই চায় না , আর ঘরে থাকলেও সারাক্ষণ এই হেডফোন কানে লাগিয়ে শুনতে থাকে গান।শৌনক তাকায় মাম্পিদের ফ্ল্যাটের দিকে। মাম্পিরা থাকে দশতলার ওপরের একটা ফ্ল্যাটে। একই স্কুলে পড়ে দুজনেই , শুধু সেকশন আলাদা। মাম্পি বারান্দায় বাবার সাথে বসে কিছু একটা খেলছে , পাশে কাকীমা ও বসে কি একটা যেন বলে উঠলো। সবাই হেসে ওঠে ওরা , মাম্পিকে দুজনে জড়িয়ে ধরে দুদিক দিয়ে। মনে পড়ে যায় শৌনকের , বাবাও ওকে কাঁধের ওপরে নিয়ে ঘুরে বেড়াতো , ওপরে ছুঁড়ে দিতো আকাশে, তারপর আবার লুফে নিতো নিজের কোলে। মা ভয় পেতো , বাবা বলতো ,"আমি আছি না ? আমি ঠিক ধরে নেবো আমার সোনুকে। " জলে ভেজা চোখদুটো ঘুরতে থাকে এই ফ্ল্যাট থেকে অন্য ফ্ল্যাটের দিকে। অনেক ফ্ল্যাটেই অন্ধকার হয়ে আছে , আবার কিছু ফ্ল্যাটে শৌনক দেখতে পাচ্ছে বাবার সাথে বসে কেউ টিভি দেখছে, কাউকে বাবা পড়াচ্ছে ! কেউ আবার নিজে পড়ছে , পাশে মা বসে কিছু করছে, বাবা পাশে বসে পেপার নিয়ে পড়ছে। নিচের বাগানে কেউ কেউ বাবা মায়ের সাথে ব্যাডমিন্টন খেলছে। কি যেন হয়ে যায় শৌনকের বুকের ভেতরে , অভিমানে, রাগে গলায় যেন কিছু একটা দলা পাকিয়ে ওঠে ওর। তাড়াতাড়ি ছুটে উঠে যায় ওপরে, নিজের রুমে। ঝাঁপিয়ে পড়ে বিছানার ওপরে।
কান্নায় ভিজে যেতে থাকে বালিশ, বিছানা। বারবার জিজ্ঞেস করতে থাকে নিজেকে, বাবা কেন আসছে না ? কেন মা বাবাকে মেরেছিলো ? কেন আড়ি করে আছে ওরা দুজনে ? এই তো সেদিন আমার পুপুনের সাথে আড়ি হয়ে গেলো, দুদিন আমরা কারোর সাথে কথা বলিনি। এখন তো ওই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ? তাহলে মা বাবা কেন বেস্ট ফ্রেন্ড হতে পারছে না ? কেন ভাব করে নিচ্ছে না ?
শৌনকের দুড়দাড় করে ওপরে ছুটে যাওয়া দেখেও কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে স্নিগ্ধা। গানটা পুরোটা আরেকবার শুনে নিয়ে, হেডফোনটা রেখে ধীরে ধীরে উঠে আসে ওপরে। শৌনকের রুমের ভেজিয়ে রাখা দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকে আসে। ছোট্ট শরীরটাকে কান্নার দমকে ফুলে ফুলে উঠতে দেখে নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে স্নিগ্ধা। নিজেকেই প্রশ্ন করে, - তাহলে কি সব ভুল হয়ে যাচ্ছে ? শৌনক এর কি এখনও এতো অভিমান আমাদের দুজনকে নিয়ে ? আমাদের দুজনের ইগো কোথাও ওকে দুর্বল করে দিচ্ছে না তো ?
নিজেকে শক্ত করে শৌনকের কাছে এসে বসে স্নিগ্ধা , ওকে কোলে তুলে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে ,"কি হয়েছে আমার সোনুর ? কান্না কেন ? ও সাইকেল ? সেতো আরো দুদিন দেরি আছে, তাই না ? আমি দেবো তো তোকে। " আরো জোরে কেঁদে ওঠে শৌনক , ছোট দুটো হাত দিয়ে জোরে চেপে ধরে মাকে ! স্নিগ্ধা হাসতে হাসতে বলে ওঠে,"পাগল ছেলে আমার ! কি হয়েছে, বলবি তো আমাকে ? আজ পিজ্জা খাবি ? অর্ডার করবো ? "
কান্না থামিয়ে, ফোঁপাতে ফোঁপাতে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে শৌনক ,"বাবা কি আসবে আমার জন্মদিনে ? তুমি আর বাবা ভাব করে নাও না মা ! "
শৌনককে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ায় স্নিগ্ধা , হিসহিস করে বলে ওঠে ,"তুমি বড়ো হচ্ছ শৌনক। তোমার বোঝা উচিত, সবকিছু ভাব করে মেটানো যায় না ! চলো, বাথরুমে যাও , চোখে মুখে জল দিয়ে নিচে এসো। খেতে হবে। আজ আমি তোমাকে খাইয়ে দেব। আর আমাকে বেরোতে হবে তারপরে। সুপর্ণা কে আমি বলে যাবো , ও সোফাতে শোবে তোমার কাছে আজ রাতে। আর একদম আজে বাজে উল্টোপাল্টা বায়না করবে না ! " রুম থেকে বেরিয়ে আসে স্নিগ্ধা।
কিচেনে গিয়ে সুপর্ণা কে সব বুঝিয়ে নিজে এসে ভালো করে স্নান করে স্নিগ্ধা। আজ একটা ভালো শাড়ি পরতে হবে , আর অনেকটা গভীর ক্লিভেজ দেখানো ব্লাউজ তার সাথে। রেকর্ডিংয়ের আগে সুপারস্টার পারভীন এর সাথে দেখা করতে হবে। ও অনেকদিন থেকে বলে রেখেছে। আজ নিজের ও কিরকম একটা হচ্ছে সেই সকাল থেকে , খুব কাউকে কাছে পেতে ইচ্ছে করছে , কারোর স্পর্শ মাখতে ইচ্ছে করছে নিজের শরীরে।
স্নান সেরে, ভালো করে সুগন্ধী মেখে, একটু মেকআপ করে নিচে এসে সুপর্ণা কে ডেকে বলে স্নিগ্ধা , "শোন, তুই সোনু কে খাইয়ে দে। আর আমি বেরোচ্ছি এখন। ফিরতে রাত হবে , একটা রেকর্ডিং... " কথা শেষ না করতে করতেই সুপর্ণা বলে ওঠে,"দিদি, সবে তো দশটা বাজে। তোমার রেকর্ডিং তো একটার সময়ে। আর একটু সময় থাকো না সোনুবাবার সাথে। তুমি তো ওকে খাইয়ে দেবে বলেছিলে ! "
"আহঃ , সুপর্ণা। তুই যেটা বুঝিস না সেটা নিয়ে কথা বলিস কেন ? জানিস ওখানে গিয়ে এখন আমাকে মিউজিসিয়ানদের সাথে প্র্যাক্টিস করতে হবে এখন একটু ? সেটার জন্য সময় লাগবে না ? " গটগট করে বেরিয়ে চলে আসে স্নিগ্ধা।
ওপর থেকে শৌনক নেমে আসে , "মা কোথায় ? সুপর্ণা দি, মা কোথায় ? "
শৌনক তাকায় মাম্পিদের ফ্ল্যাটের দিকে। মাম্পিরা থাকে দশতলার ওপরের একটা ফ্ল্যাটে। একই স্কুলে পড়ে দুজনেই , শুধু সেকশন আলাদা। মাম্পি বারান্দায় বাবার সাথে বসে কিছু একটা খেলছে , পাশে কাকীমা ও বসে কি একটা যেন বলে উঠলো। সবাই হেসে ওঠে ওরা , মাম্পিকে দুজনে জড়িয়ে ধরে দুদিক দিয়ে। মনে পড়ে যায় শৌনকের , বাবাও ওকে কাঁধের ওপরে নিয়ে ঘুরে বেড়াতো , ওপরে ছুঁড়ে দিতো আকাশে, তারপর আবার লুফে নিতো নিজের কোলে। মা ভয় পেতো , বাবা বলতো ,"আমি আছি না ? আমি ঠিক ধরে নেবো আমার সোনুকে। " জলে ভেজা চোখদুটো ঘুরতে থাকে এই ফ্ল্যাট থেকে অন্য ফ্ল্যাটের দিকে। অনেক ফ্ল্যাটেই অন্ধকার হয়ে আছে , আবার কিছু ফ্ল্যাটে শৌনক দেখতে পাচ্ছে বাবার সাথে বসে কেউ টিভি দেখছে, কাউকে বাবা পড়াচ্ছে ! কেউ আবার নিজে পড়ছে , পাশে মা বসে কিছু করছে, বাবা পাশে বসে পেপার নিয়ে পড়ছে। নিচের বাগানে কেউ কেউ বাবা মায়ের সাথে ব্যাডমিন্টন খেলছে। কি যেন হয়ে যায় শৌনকের বুকের ভেতরে , অভিমানে, রাগে গলায় যেন কিছু একটা দলা পাকিয়ে ওঠে ওর। তাড়াতাড়ি ছুটে উঠে যায় ওপরে, নিজের রুমে। ঝাঁপিয়ে পড়ে বিছানার ওপরে।
কান্নায় ভিজে যেতে থাকে বালিশ, বিছানা। বারবার জিজ্ঞেস করতে থাকে নিজেকে, বাবা কেন আসছে না ? কেন মা বাবাকে মেরেছিলো ? কেন আড়ি করে আছে ওরা দুজনে ? এই তো সেদিন আমার পুপুনের সাথে আড়ি হয়ে গেলো, দুদিন আমরা কারোর সাথে কথা বলিনি। এখন তো ওই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ? তাহলে মা বাবা কেন বেস্ট ফ্রেন্ড হতে পারছে না ? কেন ভাব করে নিচ্ছে না ?
শৌনকের দুড়দাড় করে ওপরে ছুটে যাওয়া দেখেও কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে স্নিগ্ধা। গানটা পুরোটা আরেকবার শুনে নিয়ে, হেডফোনটা রেখে ধীরে ধীরে উঠে আসে ওপরে। শৌনকের রুমের ভেজিয়ে রাখা দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকে আসে। ছোট্ট শরীরটাকে কান্নার দমকে ফুলে ফুলে উঠতে দেখে নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে স্নিগ্ধা। নিজেকেই প্রশ্ন করে, - তাহলে কি সব ভুল হয়ে যাচ্ছে ? শৌনক এর কি এখনও এতো অভিমান আমাদের দুজনকে নিয়ে ? আমাদের দুজনের ইগো কোথাও ওকে দুর্বল করে দিচ্ছে না তো ?
নিজেকে শক্ত করে শৌনকের কাছে এসে বসে স্নিগ্ধা , ওকে কোলে তুলে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে ,"কি হয়েছে আমার সোনুর ? কান্না কেন ? ও সাইকেল ? সেতো আরো দুদিন দেরি আছে, তাই না ? আমি দেবো তো তোকে। " আরো জোরে কেঁদে ওঠে শৌনক , ছোট দুটো হাত দিয়ে জোরে চেপে ধরে মাকে ! স্নিগ্ধা হাসতে হাসতে বলে ওঠে,"পাগল ছেলে আমার ! কি হয়েছে, বলবি তো আমাকে ? আজ পিজ্জা খাবি ? অর্ডার করবো ? "
কান্না থামিয়ে, ফোঁপাতে ফোঁপাতে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে শৌনক ,"বাবা কি আসবে আমার জন্মদিনে ? তুমি আর বাবা ভাব করে নাও না মা ! "
শৌনককে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ায় স্নিগ্ধা , হিসহিস করে বলে ওঠে ,"তুমি বড়ো হচ্ছ শৌনক। তোমার বোঝা উচিত, সবকিছু ভাব করে মেটানো যায় না ! চলো, বাথরুমে যাও , চোখে মুখে জল দিয়ে নিচে এসো। খেতে হবে। আজ আমি তোমাকে খাইয়ে দেব। আর আমাকে বেরোতে হবে তারপরে। সুপর্ণা কে আমি বলে যাবো , ও সোফাতে শোবে তোমার কাছে আজ রাতে। আর একদম আজে বাজে উল্টোপাল্টা বায়না করবে না ! " রুম থেকে বেরিয়ে আসে স্নিগ্ধা।
কিচেনে গিয়ে সুপর্ণা কে সব বুঝিয়ে নিজে এসে ভালো করে স্নান করে স্নিগ্ধা। আজ একটা ভালো শাড়ি পরতে হবে , আর অনেকটা গভীর ক্লিভেজ দেখানো ব্লাউজ তার সাথে। রেকর্ডিংয়ের আগে সুপারস্টার পারভীন এর সাথে দেখা করতে হবে। ও অনেকদিন থেকে বলে রেখেছে। আজ নিজের ও কিরকম একটা হচ্ছে সেই সকাল থেকে , খুব কাউকে কাছে পেতে ইচ্ছে করছে , কারোর স্পর্শ মাখতে ইচ্ছে করছে নিজের শরীরে।
স্নান সেরে, ভালো করে সুগন্ধী মেখে, একটু মেকআপ করে নিচে এসে সুপর্ণা কে ডেকে বলে স্নিগ্ধা , "শোন, তুই সোনু কে খাইয়ে দে। আর আমি বেরোচ্ছি এখন। ফিরতে রাত হবে , একটা রেকর্ডিং... " কথা শেষ না করতে করতেই সুপর্ণা বলে ওঠে,"দিদি, সবে তো দশটা বাজে। তোমার রেকর্ডিং তো একটার সময়ে। আর একটু সময় থাকো না সোনুবাবার সাথে। তুমি তো ওকে খাইয়ে দেবে বলেছিলে ! "
"আহঃ , সুপর্ণা। তুই যেটা বুঝিস না সেটা নিয়ে কথা বলিস কেন ? জানিস ওখানে গিয়ে এখন আমাকে মিউজিসিয়ানদের সাথে প্র্যাক্টিস করতে হবে এখন একটু ? সেটার জন্য সময় লাগবে না ? " গটগট করে বেরিয়ে চলে আসে স্নিগ্ধা।
ওপর থেকে শৌনক নেমে আসে , "মা কোথায় ? সুপর্ণা দি, মা কোথায় ? "
ঘড়ির কাঁটা এখন দৌড়োচ্ছে ধীরে ধীরে এগারোটার দিকে। ঘড়ির কাঁটার সাথেই কালো রাজপথ দিয়ে ছুটে চলেছে একটি গাড়ি। পাশ দিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছে রাতের কলকাতা! সেই কলকাতা - যে একদিকে মধ্যবিত্ত আর দারিদ্র্যের সাথে প্রতিদিনের সংগ্রামে রণক্লান্ত-বিদ্ধস্ত; আবার অন্যদিকে বিত্তবানদের কাছে মায়াবী, মোহময়ী, অলীক, অশ্লীল অবৈধ সুখের হাতছানি নিয়ে হাজির হয় প্রতিদিন। সেই কলকাতার চেহারা যেন পরিবর্তিত হয়ে যায় গভীর রাতে, মুহূর্তে মুহূর্তে। সবাই সেটা জানে না, উপভোগ করতে পারে না বা ভয় পায় - চেনা গন্ডীর বাইরে পা ফেলে সেই কলকাতাকে জানতে, চিনতে, মেতে উঠতে সেই মত্ততায়।
গাড়ির ভেতরে বসে স্নিগ্ধা, নিজেই ড্রাইভ করে চলেছে পারভীনের কাছে। আজ আবার শরীর জেগে উঠেছে প্রচন্ড ভাবে , একটা বলিষ্ঠ স্পর্শ চাইছে উপোসী শরীর। গত কয়েকমাস অনেক করে নিজেকে বুঝিয়ে, নিজেকে শাস্তি দিয়ে, কখনও বা আকন্ঠ তরল গরলে ডুবে ভুলে থাকতে চেয়েছে নিজেকে, নিজের শরীরের কামনা বাসনাকে। কিন্তু যে গানটা রেকর্ডিং করতে হবে, সেটার কথা আর সুর শুনে , নিজেকে আর স্থির রাখতে পারছে না স্নিগ্ধা।
কয়েকবছর আগেও বিতানের লেখা সুন্দর নিষ্পাপ প্রেমের কবিতাগুলোতে নিজে সুর করে গান গাইতো স্নিগ্ধা। ধীরে ধীরে সেই জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে। বাজার চাইছে এখন শরীরী গান, চাইছে গানের মধ্যে যৌনতা - শীৎকারের শব্দ। সেই গান গাইছে বাচ্চা থেকে বুড়ো সবাই। মাঝে মাঝে কষ্ট হয়, একা থাকার সময়ে ভাবে স্নিগ্ধা ! মানুষের রুচি কি এতটাই নিম্নগামী হয়ে গেছে ? কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে বোঝায় স্নিগ্ধা , ও একজন শিল্পী। আর মানুষ যা চাইছে, সেটাই ওকে দিতে হবে, নাহলে মানুষ ওকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে। যেভাবে বিয়ের পরে বিতান ধীরে ধীরে ওকে ছুঁড়ে ফেলে দেয় নিজের জীবন থেকে।
মনের গভীরে, তবুও একটা অপরাধবোধে নিজেকে ক্ষত বিক্ষত করতে থাকে স্নিগ্ধা প্রায় প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত। বিতান কি সত্যিই দোষী ? সবটুকু দোষ কি শুধু বিতানের ? আর আমি ? আমি তো বিতানকে ভরসা দিয়েছিলাম, বুঝিয়েছিলাম সব ঠিক হয়ে যাবে সময়ের সাথে সাথে। আসলে কি হয়েছিলো আমাদের মধ্যে ? কেন হঠাৎ সব শেষ করে দিলাম আমি ? নিজেই নিজেকে জিজ্ঞেস করে ওঠে স্নিগ্ধা।
ভীষণ জোরে গাড়িতে ব্রেক দিয়ে রাস্তার এক কোণে এসে গাড়ি দাঁড় করায় স্নিগ্ধা। একটা সিগারেট ধরিয়ে তাকিয়ে থাকে বাইরের দিকে। একের পর এক গাড়ি সরে যাচ্ছে সামনে থেকে , উধাও হয়ে যাচ্ছে কালো পিচের রাস্তা, সামনে এগিয়ে আসছে বিতান ধীরে ধীরে , হাতে ওর কবিতার বই , কিছু একটা আবৃত্তি করছে, মুখে সেই হাসি।
বিয়ের পরেও সুখ - শরীরের; মনের; কোনোদিন আসে নি স্নিগ্ধার জীবনে। বিতান এক থেকে দেড় মিনিটের মধ্যেই নিঃশেষ হয়ে যেতো, পাশে শুয়ে ছটফট করতো স্নিগ্ধা , চেপে ধরতো বিতানের নগ্ন ঊরু নিজের দুই ঊরুর মাঝে, কখনও বিতানের হাত জোরে করে ধরে টেনে নিয়ে আসতো নিজের তলপেটে - গোপন সন্ধিস্থলে। তবুও তৃপ্তি পেতো না স্নিগ্ধা। বিতান ঘুমিয়ে পড়লে, চেপে ধরতো পাশবালিশ। শেষে ব্যর্থতা, অপমানে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়তো কখন, নিজেও জানতো না, বা জানতে চায় নি কখনও।
সকাল হলে, সব কাজের মাঝে বোঝাতো নিজেকে, মুখপুড়ি তোর এতো জ্বালা কিসের ? কত মেয়ে প্রতিদিন ভালোবাসা না পেয়েও যাপন করছে তাদের জীবন, স্বামী - সন্তান - পরিবার নিয়ে। আর বিতান তো কত ভালোবাসে তোকে , তোর কথায় কি না করতে পারে ও ! কত মেয়ে তো জানেও না শরীরের সুখ কি জিনিস, স্বামীর সুখেই তাদের সুখ। তোর এতো, সবকিছু নিয়ে বাড়াবাড়ি কেন? আবার রাত হলে সেই অন্ধকূপ, গুহার মধ্যে নিজেকে ঠেলে দেওয়া রোজ - স্নিগ্ধা কিছুতেই যেন পারছিলো না নিজেকে সামলাতে।
পাহাড়ে বড়ো হওয়ার জন্য, কনভেন্টে পড়াশোনা করা স্নিগ্ধা, ছোট থেকেই ছিলো প্রচন্ড স্বাধীনচেতা। এই শেকল পরে থাকতে পারছিলো না আর। প্রায় মাস ছয়েক কেটে যাওয়ার পরে, একদিন বিতানকে বলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে। ডাক্তার দেখানোর পরে, বেশ কিছু টেস্ট হওয়ার পরে, জানতে পারে, বিতানের নার্ভের একটা অংশ ঠিক ভাবে কাজ করে না ছোট থেকেই। আর তাই বিতান কোনোদিনই ওকে সেই সুখ দিতে পারবে না।
সব জেনে ভেঙে পড়েছিলো বিতান। বারবার নিজেকে দোষ দিচ্ছিলো সেদিন। বলেছিলো স্নিগ্ধাকে, ওকে ছেড়ে এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে যেতে। কিন্তু স্নিগ্ধা সেদিন পারে নি বিতানের ভালোবাসা - প্রেম অস্বীকার করে বেরিয়ে যেতে। সব জেনে ভেঙে পড়েছিলো বিতান। বারবার নিজেকে দোষ দিচ্ছিলো সেদিন। বলেছিলো স্নিগ্ধাকে, ওকে ছেড়ে এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে যেতে। কিন্তু স্নিগ্ধা সেদিন পারে নি বিতানের ভালোবাসা - প্রেম অস্বীকার করে বেরিয়ে যেতে।
তখনও স্নিগ্ধা ব্যান্ডের সাথে কাজ করতো, তবে অনেক কমিয়ে দিয়েছিলো রাত করে দূরে কোথাও গিয়ে প্রোগ্রাম করা। এই টিভিতে কোনো অনুষ্ঠান, বা পাড়ার ক্লাবে , বা সামনে , আসে পাশে , এগুলোতেই ব্যস্ত রেখেছিলো নিজেকে। বিতান নিজেও কবিতা লেখা বন্ধ করে দিয়েছিলো ধীরে ধীরে। বিতান বারবার বলতো, ও আর পারছে না নতুন কিছু লিখতে , যখনই কিছু লিখতে বসে , তখনই অপরাধবোধ, গ্লানি, নিজের অক্ষমতা বারবার ওকে পোড়াতো। কাজের মধ্যে ডুবিয়ে দিতে থাকে নিজেকে বিতান। স্নিগ্ধা ও সংসারের হাজার একটা কাজে নিজেকে নিমজ্জিত করে ফেলে। বিতান বারবার বলতো ওকে, "কেন তুমি এসব করছো ? এসবের জন্য তো দুজন কাজের লোক আছে ! তুমি গান করো , গান গাও। কত ভালো গান করো তুমি। আমি তো তোমার পাশে আছি। "
ঠোঁট উল্টে স্নিগ্ধা বারেবারে অপমান করতো বিতানকে তখন, "তুমি ? তুমি আমার পাশে আছো ? কিভাবে বিতান ? একটা অসুস্থ মানুষ তুমি, অক্ষম , ক্লীব , দুর্বল। আমাকে পেরেছো কোনোদিন ভালোবাসতে ? শুধু নিজেরটুকু বোঝো , নিজের সুখ খোঁজো ! কোনোদিন জানতে চেয়েছো আমি সুখী কিনা ? আমাকে পেরেছো সুখী করতে ? ভালোবাসা ? ভালোবাসা ? তোমার মতো লোককে যে কি করে ভালোবেসেছিলাম আমি , আমার কপাল ! কে জানে, কি পাপ করেছিলাম আমি আগের জন্মে ! আমার কথা ভাবতে হবে না তোমাকে , থাকো নিজেকে নিয়ে। আমি যেটা নিয়ে, যেভাবে ভালো আছি, ভালো থাকতে চেষ্টা করছি, সেটা আমাকে বুঝে নিতে দাও। "
বিতান অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতো স্নিগ্ধার মুখের দিকে , ধীরে ধীরে মাথা নিচু করে বেরিয়ে চলে আসতো। বিতানকে এইভাবে কষ্ট দিয়ে , মনে মনে বেশ খুশি হয়ে উঠতো স্নিগ্ধা। নিজেকে সান্ত্বনা দিতো, এটাই তো ওর পাওনা। এইরকম মানুষ জীবনে থাকার চেয়ে, না থাকা অনেক ভালো। ঘন্টাখানেক পরে বাথরুমে গিয়ে জল ছেড়ে অঝোর ধারায় কাঁদতো স্নিগ্ধা। বিতানকে কষ্ট দিতে গিয়ে, কোথাও যেন নিজেই নিজেকে কষ্ট দিয়ে ফেলতো ও !
তখন বিতানের মা বাবা দুজনেই বেঁচে ছিলেন - স্নিগ্ধাকে নিজের মেয়ের মতো করে, টেনে নিয়েছিলেন বুকে। ওদের সাথে সারাদিন গল্প করে, আড্ডা দিয়ে, ওষুধ খাওয়ানো, দুপুরে একসাথে বসে খাওয়া, বাগানের পরিচর্যা - এইসব করে, দিব্যি কেটে যেতো সারাদিন। তবুও মনের অসুখের কথা বোধহয় বুঝতে পেরেছিলেন বিতানের মা। এক দুপুরে, বাবা ঘুমিয়ে যাওয়ার পরে স্নিগ্ধার বিছানার পাশে এসে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন পরম স্নেহে , মমতায় উনি। স্নিগ্ধা ঘুমোচ্ছিলো তখন, একটু পরে ঘুম ভেঙে যায়। পাশে মা কে দেখে, তাড়াতাড়ি উঠে বসে। জিজ্ঞেস করে ,"মা, তুমি এখানে ? কিছু চাই তোমার ? "
"তোর কি হয়েছে স্নিগ্ধা ? তোদের মধ্যে কি কিছু সমস্যা হয়েছে ? তোদের মধ্যে প্রথম দিকে যেরকম ভাব ভালোবাসা ছিলো, আমি যেন দেখতে পাই, সেই সুর - তাল এখন কেটে গেছে। দুজনেই পাশে থেকেও কিরকম যেন দূরে দূরে থাকিস তোরা। কি হয়েছে রে মা ? " বিতানের মায়ের স্নেহ মেশানো প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারে না স্নিগ্ধা। মাকে জড়িয়ে হাউহাউ করে কাঁদতে শুরু করে।
মা ও ওকে জড়িয়ে ধরে, মাথায় হাত দিয়ে ধীরে ধীরে বলে ওঠেন ,"তোরা আজকালের ছেলে মেয়ে। কথা বল নিজেদের সাথে। বিতান আমার ছেলে বলে বলছি না, তবে ও খুব চুপচাপ থাকে। ওর মনের ভেতরে কি চলছে আমরাও অনেক সময় আগে বুঝতে পারতাম না। কিন্তু আমি জানি মা, তুই ওকে আমাদের থেকেও ভালো বুঝিস। তাই তো যে ছেলের এতো বছরে অন্য কাউকে দেখে কখনও ভালো লাগে নি, তোকে সেবার পাহাড়ে কাজে গিয়ে কয়েক মুহূর্তেই এতো পছন্দ হয়ে যায় ! জানিস, ও না প্রথমে আমাদের বলতেই চায় নি। ওকে কত জিজ্ঞেস করেছিলাম , পরে তো ধীরে ধীরে বললো। কিন্তু, কিন্তু এখন হঠাৎ কি হলো তোদের ? ওর কি কাজের চাপ বেড়ে গেছে খুব ? তোকে সময় দিচ্ছে না ? না কি অন্য কিছু। আমাকে তো তুই মা বলিস, তাই না ? বল না , আমাকে বল। "
স্নিগ্ধা আরো জোরে কেঁদে ওঠে , একটু পরে ধীরে ধীরে মায়ের কাঁধ ছেড়ে, বিছানার চাদরের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে বলে ওঠে ধীরে ধীরে , "বিতান, বিতান...মা , আসলে বিতান এর একটা সমস্যা আছে। আর ওটার জন্য , আমি, আমাকে.....আমি কখনো তৃপ্ত হতে.....! "
চমকে ওঠেন মা , তাড়াতাড়ি কোনোরকমে নিজেকে সামলে বলে ওঠেন ,"কি বলছো তুমি? আমি, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। তবে একটা কথা বলবো স্নিগ্ধা ? সেভাবে দেখতে গেলে, আমি তো জানি না তুমি তৃপ্ত হওয়া মানে কি বলছো ? আমার কাছে তো বাবা , স্বামী, তারপরে বিতান ওদেরকে ভালো রাখা, সুস্থ রাখাই সংসারের আসল মন্ত্র। আর আমাদের সময় এতো কাজ করতে হতো সংসারের, নিজেকে নিয়ে কিছু ভাবার সময়ই পাই নি। তবে তোমাদের এখনকার ছেলে মেয়েদের ব্যাপার আলাদা। তোমরা এখন নিজেকে নিয়ে, নিজের সুখ আল্হাদ নিয়ে অনেক বেশি ভাবো। " উঠে দাঁড়ায় বিতানের মা। দরজার কাছে গিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে ওঠে ,"তোমরা একটা বাচ্চা নিয়ে নাও স্নিগ্ধা ! একটা বাচ্চা চলে এলে দেখো , খুব ভালো লাগবে। তখন এইসব কথা আর মাথায় আসবে না। শরীরের আর কি ? কয়েকদিন পরেই তো শরীরের আর কিছুই থাকবে না, তখন তো শুধু এই মন ! তাই না ? " ধীরে ধীরে বাইরে বেরিয়ে নিজের রুমে চলে যান উনি।
আরো কয়েকমাসের মধ্যে প্রথমে মা, পরে বাবা ওদেরকে ছেড়ে চলে যান, পৃথিবীর সব মায়া ত্যাগ করে !
বিতানের মা বাবা দুজনেই মারা যাওয়ার পরে, ঘরে থাকার আর কোনো মানে খুঁজে পেলো না স্নিগ্ধা ! এমনিতেই বিতানের সাথে সম্পর্কের এই শিথিলতা , তার ওপরে নিজের ডুবতে থাকা কেরিয়ার, দুটো নিয়েই যেন দিশেহারা হয়ে যাচ্ছিলো। বিতানের মা বাবা মারা যাওয়ার পরে , একটু যেন মুক্তির আলো দেখেছিলো স্নিগ্ধা। আবার কাজের জগতে ধীরে ধীরে পা রাখতে শুরু করে স্নিগ্ধা ! এতদিন পরে ফিরে আসার পরে, বড়ো কোনো কাজ ও পাচ্ছিলো না. কেউ ওকে দিয়ে গান নতুন করে গাওয়াতেও রাজি হচ্ছিলো না। তখন ও কিছু এড ফিল্মের জন্য জিঙ্গেল গাইতে শুরু করে। সেখানেও যে খুব একটা কাজ আসছিলো, তা নয় , তবে এইভাবেই নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চাইছিলো স্নিগ্ধা, যাতে সবকিছু ভুলে থাকা যায় !
বিতান বেশ কয়েকবার বলেছিলো ওকে ডিভোর্সের কথা। কিন্তু বিতানের ভালোবাসা, প্রেম ছেড়ে বেরোতেও পারছিলো না স্নিগ্ধা। প্রতিদিন সকালে বিতান ঘুম থেকে উঠে, নিজের ব্রেকফাস্ট তৈরীর সাথে , স্নিগ্ধার জন্যই ব্রেকফাস্ট তৈরী করে দিতো , রাতে ফিরে এসে নিজেও কিছু রান্না করে রাখতো পরের দিনের জন্য। বাজার করা, মাছ - মাংস সবকিছু বিতান নিজে করে আনতো ! কোনোভাবে যাতে স্নিগ্ধার কোনোরকম অসুবিধে না হয়, সব দিকে ওর খেয়াল থাকতো। একটু সামান্য হাত পুড়ে গিয়েছিলো একদিন, বিতান তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরে এসে জোরে করে ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলো। রাতে ঘুমোতে যাওয়ার পরে, বিতান স্নিগ্ধার ওপরে জোর করতো না কখনও। স্নিগ্ধার যখন শরীর জেগে উঠতো, বিতান নিজেকে পুরোপুরি সমর্পণ করে দিতো ওর কাছে। কতবার চেষ্টা করেছে স্নিগ্ধাকে তৃপ্তি দেওয়ার বিতান। স্নিগ্ধা নিজের চোখে দেখেছে , ব্যর্থতার রাতগুলিতে, সেই মুহূর্তে কিভাবে বিতান ভেঙে পড়তো , কাঁদতে কাঁদতে বিছানা থেকে নেমে যেত মেঝের এক কোণে। দেওয়ালে নিজের মাথা ঠুকতো , নিজেকে দোষ দিতো। এইরকম মানুষকে কি করে ও ফেলে চলে যাবে ? স্নিগ্ধা ভাবতেও পারে না , এই মানুষটার থেকে ডিভোর্স নেওয়ার কথা।
স্নানের সময়, একা , কখনো নির্জন দুপুরে , নিস্তব্ধতা ছাপিয়ে ভেসে আসতো স্নিগ্ধার শরীরী আবেশের স্বর - নিজেই নিজের সাথে, নিজের শরীরের সাথে খেলতে খেলতে, তৃপ্ত করতো নিজেকে। সেই মুহূর্ত গুলো খুব করে কাছে চাইতো ও বিতান কে , কিন্তু....
একদিন, এইরকম একটি বৃষ্টি ভেজা দিনে, অলস হয়ে বসেছিলো স্নিগ্ধা ঘরে। ওদের পাশের বাড়ির ছোট ছেলে নতুন বিয়ে করে, হনিমুন সেরে ফিরে এসেছে। বিতান অফিসে চলে গেছে। স্নান করে একটা গল্পের বই হাতে স্নিগ্ধা নিজেদের বেডরুমে বিছানার ওপরে বসে ছিলো। হঠাৎ খিলখিল গলার স্বরে, হাসির আওয়াজে অবাক হয়ে তাকায় স্নিগ্ধা বাইরের দিকে। কোনোকিছু বুঝতে পারে না , আবার পড়ায় মন দেয় ও। আবার মিনিট দুয়েক পরে সেই একইরকম আওয়াজে চমকে ওঠে স্নিগ্ধা। হাসির আওয়াজের উৎস খোঁজে ও। বাইরের ঘরে বেরিয়ে এসে জানালা দিয়ে তাকায় পাশের বাড়ির দিকে। ভীষণভাবে চমকে ওঠে স্নিগ্ধা, তাড়াতাড়ি পর্দা টেনে বসে পড়ে নিচে। একটু পরে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে খুব অল্প ফাঁক করে নজর দেয় পাশের বাড়িতে। পাশের বাড়ির ছোট ছেলে সেদিন অফিস যায় নি। কাকু কাকিমাও বোধহয় ঘরে ছিলেন না সেদিন। ছোট ছেলের স্ত্রী স্নান সেরে ভেজা চুলে দাঁড়িয়েছিলো বারান্দায় , সেই সময় পেছন থেকে ছোট ছেলে এসে জড়িয়ে ধরে ওকে। ঘাড়ের কাছে ঠোঁট নিয়ে গিয়ে আদর করতে শুরু করে , হাত নেমে আসে খোলা পেটের ওপরে , জড়িয়ে ধরেছে নিজের স্ত্র্রীকে। মেয়েটা বোধহয় সুড়সুড়িতে বা আনন্দে হেসে উঠেছে খিলখিল করে। ধীরে ধীরে ছেলেটার হাত দুটো টেনে আনে মেয়েটি নিজের ব্লাউজের ওপরে। একটু পরে ছেলেটা মেয়েটাকে নিয়ে, জড়িয়ে ধরে ঢুকে যায় ভেতরে। একটু পরে আরো কিছু আওয়াজে, আদরের ঘন নিঃশ্বাস প্রশ্বাসে, মৃদু আবেশের শব্দে নিজে আর স্থির থাকতে পারে না স্নিগ্ধা। কোনোদিন যেটা করেনি, সেদিন সেটাই করে ফেলে , ফোন করে বিতানকে অসময়ে।
বিতান তাড়াতাড়ি চলে আসে ঘরে। এসে নিজের কাছে থাকা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে এসে চেঁচিয়ে ওঠে , "কি হয়েছে , স্নিগ্ধা ? তোমার শরীর ভালো আছে তো ? "
স্নিগ্ধা বাথরুমের ভেতর থেকে চেঁচিয়ে ওঠে, "একটু এসো না ! প্লিজ। আমার কাছে একটু এসো ! "
বিতান ছুটে যায় ভেতরে , বাথরুমের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই, স্নিগ্ধা , হ্যান্ড শাওয়ারটা নিয়ে ভিজিয়ে দেয় বিতানকে। প্রথমে ভীষণ অবাক হয়ে যায় বিতান। একটু পরে নিজেও মেতে ওঠে স্নিগ্ধার সাথে আদিম উন্মাদনায়। স্নিগ্ধা যখন ধীরে ধীরে উত্তেজিত হতে শুরু করে, বিতান নিঃশেষ হয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে চরম আশ্লেষে , কেঁপে ওঠে ওর শরীর।
কয়েক মিনিট পরে স্নিগ্ধা প্রচন্ড রাগে, মারতে থাকে বিতানকে , বলে ওঠে ,"কেন বিতান ? কেন বিতান আমাকে এই শাস্তি দিয়ে চলেছো ? আমি কি কোনোদিন , কোনোদিন....." নগ্ন অবস্থায় বেরিয়ে চলে যায় ভেতরে স্নিগ্ধা , ভেতর থেকে বন্ধ করে দেয় দরজা ।
সেই ঘটনার মাস দুয়েক পরে, স্নিগ্ধার হঠাৎ করেই শরীর খারাপ লাগে ! কিরকম একটা বমি বমি ভাব, সারা শরীর ভারী ভারী লাগে ওর। প্রায় মাস দুয়েক পিরিয়ড ও মিস করে। ভয়ে তাড়াতাড়ি বিতানকে বলে ও। বিতান ওকে নিয়ে হসপিটালে আসে। ডক্টর কিছু টেস্ট করে হেসে বলে ওঠে ,"আনন্দের কথা তো , আপনারা মা বাবা হতে চলেছেন। আর কোনো আজে বাজে চিন্তা নয় ! "
প্রেগন্যান্সির সময়ে বিতান ভীষণ ভালোভাবে রেখেছিলো স্নিগ্ধাকে। নিয়ম করে দুজন কাজের লোক আলাদা ভাবে রেখেছিলো ওর দেখাশোনা করার জন্য। নিজেও তাড়াতাড়ি অফিস থেকে চলে আসতো, গভীর রাতে যদি কিছু খেতে ইচ্ছে হতো স্নিগ্ধার, নিজের হাতে বানিয়ে আনতো ! মাঝে মাঝে আইসক্রিম , বা অন্যকিছু খেতে ইচ্ছে হলে , গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়তো বিতান, গভীর রাতেও, ঠিক জোগাড় করে এনে দিতো, স্নিগ্ধার যা চাই। এতো কিছুর মাঝেও স্নিগ্ধার মনে কোনো শান্তি ছিল না। বার বার মনে হতো, এর পর কি ? ছেলে বা মেয়ে, যাই হোক না কেন, একটা সময়ের পরে তো বড়ো হয়ে যাবে। তারপরে ? আমি? আমার কি হবে ?আমি তো এইরকম সংসারের স্বপ্ন দেখিনি ! আমি নিজেও যে কিছু করতে চাই, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে , প্রতিষ্ঠিত হতে চাই, চেয়েছিলাম। কিছুই তো হতে পারছি না। আর তার সাথে আমার আর বিতানের এই ভাঙা সম্পর্ক ? আমি কেন সবসময় অন্যদের কথা ভাববো ? আমার নিজের কথা ভাবার কি কোনো অধিকার নেই আমার ? বিয়ে করেছি বলেই কি সবসময় স্বামীর কথা , তার চাহিদার কথা, তার ভালোলাগা,খারাপ লাগা - এইসব নিয়েই ভাবতে হবে ? আমি, আমার অস্তিত্ব কোথায় ? স্নিগ্ধা কোথায় এখানে ? সে কি হারিয়ে যাবে ? এইসব ভেবে ভেবে আরো অসুস্থ হয়ে পড়তে থাকে স্নিগ্ধা !
স্নিগ্ধার মন খারাপের কারণ বুঝতে পারে বিতান , তবুও চেষ্টা করে ওকে হাসি খুশি রাখার। এইসময় একদিন বিতান স্নিগ্ধার বাবা মাকে নিয়ে আসে অফিস থেকে ফেরার সময়। স্নিগ্ধার মা , মেয়েকে দেখেই ছুটে আসে ওর কাছে। জিজ্ঞেস করে , "কি হয়েছে তোর ? চোখের তলায় এরোকম কালি কেন ? মনে হচ্ছে কত রাত ঘুমোস নি। তুই, তুই চল আমাদের সাথে। "
স্নিগ্ধা যেতে অস্বীকার করে। তখন ওর মা বলে, "ঠিক আছে, আমিই থাকি এখন কিছুদিন তোর কাছে।" বিতানকে ডেকে জিজ্ঞেস করে, "আমি থাকলে কোনো অসুবিধে নেই তো ? "
"কি যে বলছেন মা ? অসুবিধে কিসের ? আপনি থাকলে খুব ভালো হয়। আমি তো কবে থেকে ওকে বলেছি। " উত্তর দেয় বিতান।
পরের দিন বিতান অফিসে চলে গেলে স্নিগ্ধার মা মেয়ের কাছে এসে বলে ওঠেন ," বল তো এবার ! কি হয়েছে তোর ? তুই কি কিছু নিয়ে চিন্তা করছিস? ভাবছিস ? আমাকে বল ! আমি না তোর মা ? "
স্নিগ্ধা ধীরে ধীরে সব কিছু খুলে বলে , বলে বিতানের শারীরিক ভালোবাসায় অক্ষমতার কথা , বলে বিতানের সবসময় ওর পাশে থাকার কথা , বলে বিতানের প্রেমের কথা। সব শুনে মা বলেন ,"ধুর পাগলী ! তুই বেশি আজেবাজে ভাবছিস। আমাদের জামাই তো কত ভালো, তোকে কত ভালোবাসে। একটা দিক না হয় একটু কমজোরি ! সে তো অনেকেরই হয়.....তুই কি ভেবেছিস , আমিও ওই দিক থেকে খুব সুখী ছিলাম? আমরা মেয়েরা কি হতে পারি এইভাবে সুখী ? ওরে, আসল হলো মন। মন দিয়ে সংসার কর ! আর এসব মাথা থেকে বের করে দে। বুঝেছিস ? স্বামীর মঙ্গলকামনা, বাচ্চার ভালোমন্দ , এইসবেই নারীর নারী জন্ম সার্থক। " মা যে মুখ দিয়েও সেই একইরকম সব কথা শোনার পরে আরো ভেঙে পড়ে স্নিগ্ধা। বারেবারে নিজেকে প্রশ্ন করতে থাকে , তাহলে একটা মানুষ হিসেবে আমার অস্তিত্ব কোথায় ? কিন্তু মুখ ফুটে মা কে আর কিছু বলতে পারে না।
নির্দিষ্ট সময়ে একটি ছেলে জন্ম নেয় , স্নিগ্ধা ওর নাম রাখে শৌনক ! সারাদিন ওর দুস্টুমি, ওর পেছনে দৌড়োনো, ছেলের সাথে গল্প করা, ওর ন্যাপি চেঞ্জ করা , ওকে নিয়ে বেরোনো, এইসব করতে করতেই স্নিগ্ধার সময় কেটে যায়। কাজের জগৎ থেকে আবার একটু দূরে সরে আসে এই সময় স্নিগ্ধা। শৌনক এর যখন আড়াই বছর বয়স, হঠাৎ করে ওর পুরোনো ব্যান্ড মেম্বারদের একজন - মলয় ওর সাথে যোগাযোগ করে। ও একটা সিনেমার গান তৈরী করছে, আর ফিমেল লিড হিসেবে স্নিগ্ধা ওর প্রথম পছন্দ। বিতানকে গিয়ে জানায় স্নিগ্ধা। বিতান ভীষণ খুশি হয়।
বেশ কয়েকদিন ধরে ওর প্র্যাক্টিস চলে, আর সেই সময় বিতান অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বাচ্চাটাকে সামলায় ! প্র্যাক্টিস এর শেষ দিনে স্নিগ্ধা যখন বেরিয়ে আসতে যায় , হঠাৎ দেখে সিনেমার প্রোডিউসার বাইরে মলয়ের সাথে কথা বলছে , মাঝে মাঝেই স্নিগ্ধাকে দেখিয়ে কিছু বলে যাচ্ছে আর মলয় হাত পা নেড়ে কিছু বোঝাতে চাইছে ওনাকে। একটু পরে প্রোডিউসার বেরিয়ে গেলে মলয় মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে পাশে রাখা চেয়ারে। স্নিগ্ধা মলয়ের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে ,"কি হলো ? কোনো প্রব্লেম ? "
"আর বলিস না। প্রোডিউসার বলছে ওর নিজের মেয়ে দিয়ে গান গাওয়াতে হবে তোর গানটা ! আমি জানি ওর মেয়ে গান গাইতে পারে না। আমি বললাম। সে আমাকে বলছে অটো টিউন আর সফটওয়্যার ব্যবহার করতে ! আজকাল এভাবেই সব হচ্ছে রে। আমি যে কি বলি তোকে। " চুপ করে যায় মলয়।
স্নিগ্ধার ভেতরে ভেতরে একটা রাগ জমতে থাকে , অনেক কষ্টে সেটাকে দমিয়ে মলয়ের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে ,"কি আর করবে বলো ! এখন উনি টাকা ঢালছেন, ওনার ইচ্ছেতেই সব হবে। তবে এই কয়েকদিন প্র্যাক্টিস করে আমার নিজের অনেক উপকার হয়েছে। আবার সেই পুরোনো ভাইবটা ফিরে পাচ্ছি। আচ্ছা, আমি আসি তাহলে। "
বেরিয়ে আসার সময়ে স্নিগ্ধা শুনতে পায় মলয় চেঁচিয়ে বলছে ওর উদ্দেশ্যে ,"তুই চিন্তা করিস না। আমি পরে যেটা করবো, সেখানে তুই অবশ্যই গান করবি। আমি কথা দিচ্ছি। "
কোনো কথা না বলে গগলস টা চোখে লাগিয়ে বেরিয়ে আসে স্নিগ্ধা !
সেদিন বাড়িতে ফিরে আসার পরেই , বিতান ওর দিকে তাড়াতাড়ি হেঁটে আসে। বলে ওঠে,"এই স্নিগ্ধা ! কখন থেকে তোমার মোবাইল ট্রাই করছি। আমাকে তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে। ফ্যাক্টরিতে আগুন লেগেছে। শৌনক কাজের মেয়েটার কাছে আছে। আমি আসি। "
হঠাৎ সবকিছু কিরকম আগুনের মতো জ্বলতে থাকে স্নিগ্ধার সামনে , প্রচন্ড রাগে চেঁচিয়ে ওঠে স্নিগ্ধা ,"শয়তান, তুমি একটা শয়তান ! তোমার জন্যই আজ আমার এই অবস্থা। কোনো কিছুই হলো না আমার জীবনে। না ঠিক করে স্বামীর সোহাগ পেলাম, না কাজের কাজ কিছু হচ্ছে। তোমার আর কি, ঠিক নিজের মতো করে লাগিয়ে সুখ পাচ্ছ। একবার ও ভেবে দেখেছো আমার কথা ? সারাদিন এই বাচ্চার পেছনে সব সময় দিয়ে আমি সব ভুলে থাকতে চেষ্টা করছি। কিন্তু তুমি ? শুধু গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ ! ছেলে, তাই না ? ছেলে তো, তোমাদের জন্য সব মাফ, আর মেয়েদের যখন যেভাবে খুশি ব্যবহার করতে পারো তোমরা , তাই না ? আমাদের ইচ্ছে অনিচ্ছে বলে কিছু থাকতে নেই ! আমাদের চাহিদা , ভালোলাগা, খারাপ লাগা কিছু হতে নেই ? যাও, বেরিয়ে যাও আমার চোখের সামনে থেকে ! একটুক্ষন ছেলেকে রাখতে হয়েছে বলে বাবুর কি মেজাজ ! কে জন্ম দিয়েছিলো ওকে ? কেন সেদিন ভেতরে..."
তাড়াতাড়ি এগিয়ে আসে বিতান স্নিগ্ধার কাছে, ওর মুখে হাত দিয়ে চেপে বলে ওঠে ,"কি হয়েছে তোমার? এরকম করে কথা বলছো কেন ? প্র্যাকটিসে কিছু হয়েছে ? আর আমি কি কখনও বলেছি শৌনক কে রাখতে আমার কোনো অসুবিধে হচ্ছে ? ফ্যাক্টরিতে আগুন লেগে গেলো বলেই না আমাকে..."
জোর করে বিতানকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ওকে লাথি মেরে বলে ওঠে স্নিগ্ধা ," না না ! তুমি তো মুখে কিছুই বলো না ! সব কাজে বুঝিয়ে দাও। সেটাই তো সমস্যা ! আর আমার হয়েছে জ্বালা , আমি মরি না কেন ? মরে গেলেই তো শান্তি ! " বিতানকে ঠেলে সরিয়ে ভেতরে চলে যায় স্নিগ্ধা ! কিছু বুঝতে না পেরে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে বিতান।
সেই শুরু , বিতান আর স্নিগ্ধার জীবনে একটা ফাটলের সৃষ্টি হয়, শুধু ছোট একটা সুতো আটকে রাখে ওদের দুজনকে , সে হলো শৌনক। বাইরে থেকে দেখে বোঝা যেত না ওদের সম্পর্কের পরিণতি , উল্টে অনেকেই বিতান আর স্নিগ্ধাকে আদর্শ দম্পতি হিসেবে দেখতো , জানতো , মানতো! কিন্তু ভেতরে ভেতরে যে ঘুনপোকা লেগে সেটাকে কুরে কুরে শেষ করে দিচ্ছে, কেউ জানতো না। গুমরে গুমরে ঘুরে বেড়াতো ওদের সম্পর্কের পুড়ে যাওয়ার কটু গন্ধ আকাশে বাতাসে।
মাঝে মাঝেই কথায় কথায় স্নিগ্ধা আর বিতানের ঝগড়া লেগেই থাকতো , তখন স্নিগ্ধার হাত উঠে আসতো বিতানের গায়ে। বিতান চুপ করে সব সহ্য করতো , জড়িয়ে ধরতো স্নিগ্ধাকে। একটু পরে স্নিগ্ধা নিজেই ক্লান্ত হয়ে ভেঙে পড়তো কান্নায় , বিতানকে জড়িয়ে ধরে অঝোর ধারায় বেরিয়ে আসতো চোখের জল। বিতান ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলতো, "পাগলীর মতো কেন করছো তুমি ? কেন এতো রাগ তোমার আমার ওপরে ? "
স্নিগ্ধা কাঁদতে কাঁদতে,বিতানের বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে বলে উঠতো ,"বোঝো না তুমি ? বোঝো না ? তোমাকে আমি কত ভালোবাসি ? আর তোমাকে এতো ভালোবাসি বলেই তো তোমার ওপরে আমার সব রাগ , অভিমান। আমি , আমি কি যে করি , কোনো কিছুই হচ্ছে না আমার জীবনে। মনে হচ্ছে আমি যেন আটকে গেছি সবকিছুর মধ্যে। আমাদের বিয়ে, বিয়ের পরের জীবন, তারপর শৌনক, তোমার কাজ, আমার কোনো কিছু কাজ ঠিকভাবে না হওয়া ! আমি আর পারছি না , হাঁপিয়ে উঠছি বিতান। আমাদের প্রেমের সময়টাই সব থেকে ভালো ছিলো ! কারোর কাছে কোনো এক্সপেক্টশন ছিলো না , শুধু কথাবার্তা, মিষ্টি সুন্দর স্বপ্নের ভেলাতে ভাসতাম আমরা দুজনে। আর এখন এই একঘেয়ে সংসারে আমি , আমি আর পারছি না। "
"একটা কাজ করলে কেমন হয় স্নিগ্ধা ? চলো, আমরা কোথাও থেকে ঘুরে আসি, একসাথে তিনজনে ? হয়তো ভালো লাগবে, হয়তো আবার সব কিছু আগের মতো করে আমরা ফিরে পাবো ? " উত্তর দেয় বিতান।
কয়েকদিন পরে, পুরীতে এসে হাজির হয় তিনজনেই। সামনে বিশাল সমুদ্র, ঘন নীল আকাশ, বালিতে জলে হুড়োহুড়ি করে কেটে গেলো সময়। সমুদ্রের ধারে জলে পা ভিজিয়ে বসে, হাতে হাত রেখে গল্প শুরু করে দুজনে। কত যে কথা জমে গিয়েছিলো এই কয়েক বছরে , বিতান কখনও বুঝতেই পারে নি ! কত কথা, স্নিগ্ধা বলে যাচ্ছিলো, আর বিতান শুধুই হাঁ করে দেখছিলো স্নিগ্ধাকে। শৌনক সামনে খেলতে ব্যস্ত বালি নিয়ে। বালি দিয়ে পাহাড় বানাচ্ছে, সমুদ্রের ঢেউ এসে ভেঙে দিচ্ছে সেই পাহাড়। ওই ভাঙা গড়ার খেলাটাই ওর কাছে আনন্দের , মজার। ও লাফিয়ে খিলখিল করে হাসতে থাকে।
সেই তিনদিন ভীষণ ভালো কাটে তিনজনের একসাথে। রাতে ঘুমোনোর সময়, স্নিগ্ধা নিজে থেকে বিতানকে টেনে নেয় নিজের কাছে , বিতান পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে স্নিগ্ধাকে, স্নিগ্ধা ওর হাত টেনে নেয় নিজের বুকের ওপরে। ফিরে আসার দিন, বিতান বুঝতে পারে, স্নিগ্ধাকে হয়তো সময় কম দিচ্ছে ও। আরো বেশি সময় ওর থাকা উচিত স্নিগ্ধার সাথে। ফিরে আসার পরে কিছুদিন বিতান আবার প্রচন্ড ব্যস্ততার মধ্যে থাকে। এইসময়, এইসময় হঠাৎ করেই, একদিন খোলা বাতাসের মতো, স্নিগ্ধার জীবনে আসে পারভীন।
ব্যান্ড মেম্বার মলয়, স্নিগ্ধাকে একদিন সকালে ফোন করে। ফোনে বলে ,"তুই ঘন্টা দেড়েকের মধ্যে আসতে পারবি একবার আমার অফিসে ? একটা নতুন সিনেমার কথা হচ্ছে , আমি ওর সব গান তোকে দিয়েই গাওয়াবো ঠিকই করেছি। "
স্নিগ্ধা কোনোকিছু প্রত্যাশা না রেখেই উত্তর দেয়, "কি হবে ? সেই তো প্র্যাক্টিস করবো, তারপরে শেষে এসে....."
"না না , সেরকম আর কিছু হবে না। আমি কনট্র্যাক্ট করিয়ে নিয়েছি , আমার কথাই শেষ কথা এখানে। আর সিনেমাতে হিরো কে জানিস ? পারভীন ! একবার এখানে সুযোগ হয়ে গেলে, তুই বুঝতে পারছিস ব্যাপারটা ? " মলয় ফোনে ওকে বুঝিয়ে দেয়, কিভাবে কোথায় আসতে হবে !
স্নিগ্ধা তাড়াতাড়ি করে সেজে, ঘরের সারাক্ষণের কাজের লোকটির জিম্মায় শৌনক কে রেখে বেরিয়ে আসে বাড়ি থেকে। ভাবতে থাকে , পারভীনের সাথে কাজ ? সেই পারভীন, যাকে, আমি একসময়ে প্রচন্ড অপমান করে নিজের জীবন থেকে বের করে দিয়েছিলাম, সেই পারভীন, যাকে আবার, বিতানের সাথে বিয়ের সময় দেখেছিলাম, সেই পারভীন, যে এখন একজন সুপারস্টার ! দেখা যাক কি হয়।
নির্দিষ্ট সময়ে মলয়ের অফিসে আসার পরে, মলয় ওকে গানগুলো বুঝিয়ে দেয়। একটা রবীন্দ্রসংগীত , দুটো পার্টি সং, একটা লোকগীতি আর একটা ভীষণ মন কেমন করা গান - ঘনিষ্ঠতার গান, অন্তরঙ্গ হওয়ার গান। মলয় বলে ওঠে, "সবার প্রথমে আমরা এই ইনটিমেট যে গানটা আছে, সেটাই রেকর্ড করবো। তোর গলায় একটা ব্যাপার আছে, একটা হাস্কি, ডাস্কি টোন আছে তোর গলায়। আর গানের মাঝে কিছু আওয়াজ, মানে মিলনের আকুতি, যৌনতা মেশানো কিছু পাঞ্চ তোকে দিতে হবে। "
স্নিগ্ধা বেশ কিছুক্ষণ পরে বলে ওঠে,"না মলয় ! আমি পারবো না এই গানটা করতে। এই গানের কথা, সুর, আর তুমি যে সব পাঞ্চের কথা বলছো - হবে না ! মানে আমার কিরকম একটা..."
"লজ্জা করছে ? কেন স্নিগ্ধা জি ? লজ্জার কি আছে ? মানে আপনি কি জানেন না এইসব কিছু , না কি হাসব্যান্ডের কাছ থেকে পারমিশন নিতে হবে ? "
চমকে ঘুরে পেছনে তাকায় স্নিগ্ধা। পেছনে দাঁড়িয়ে পারভীন। পারভীনকে দেখে মলয় এগিয়ে যায় , ওকে ভেতরে নিয়ে আসে। পারভীনের দুস্টুমি মাখা চোখ দেখে হঠাৎ যেন একটা জেদ চেপে যায় স্নিগ্ধার মধ্যে। ও দৃঢ় স্বরে বলে ,"ওকে , কবে রেকর্ড করতে হবে ? আর প্র্যাক্টিস কখন করবো ? রেকর্ডিংয়ের আগে, আমার পুরো গানটা চাই। "
সেই শুরু পারভীনের সাথে আবার নতুন করে জড়িয়ে পড়া।
টুং টাং করে বেজে ওঠে হাতের মুঠোর মধ্যে ধরে থাকা ছোট্ট ফোনটা। ফোনটা কানে লাগাতেই ওদিক থেকে ভেসে আসে পারভীনের গলা, "তোমার কি দেরি হবে , স্নিগ্ধা? এখন তো প্রায় বারোটা বাজে। "
স্নিগ্ধা তাড়াতাড়ি সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে বলে ,"আরে না না ! আসলে এই একটু বেরোতে গিয়ে দেরী হয়ে গিয়েছিলো। আমি আসছি, আর এই মিনিট পনেরো ! কেমন ?
গাড়িটা ড্রাইভ করে আবার শুরু করে যাত্রা , পারভীনের বাড়ির উদ্দেশ্যে। সত্যি, সেই সময় পারভীন এসে না দাঁড়ালে, ও সময় মতো না বোঝালে, আজকেও আমাকে ওই লোকটার সাথেই ঘর করতে হতো, আর প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত , একটু একটু করে মরতাম আমি, শেষ হয়ে যেতাম , ধীরে ধীরে বয়স এসে থাবা বসাতো শরীরে , দেখতে দেখতে শরীরটাই বার্ধক্যের জালে, ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। একটাই তো জীবন, কেন আমি আমার মতো করে উপভোগ করবো না ? কেন শুধু একটা তপ্ত সম্ভাবনাকে ঠান্ডা বরফের মধ্যে ডুবিয়ে শেষ করে দেবো জীবনের সব রং রূপ কে ? পারভীন যে সেই ছোট বয়সে আমার করা প্রত্যাখ্যান, অপমান, সব কিছু ভুলে আবার আমার বন্ধু হয়ে পাশে দাঁড়াবে, আমাকে ভালো কাজের অফার দেবে, ভাবতে পারিনি কখনও। এই জন্যই বলে, ছোটবেলার বন্ধুরাই জানে - বন্ধুত্ব কথাটার মানে।
পুল থেকে উঠে আসে পারভীন, পাশের বেঞ্চ থেকে টাওয়েলটা টেনে নিয়ে গা হাত পা মুছতে মুছতে ভেতরে আসে। আজ ভীষণ আনন্দ হচ্ছে মনের ভেতরে। জয়ের আনন্দ, জোর না করেও , স্নিগ্ধাকে নিজের কাছে টেনে আনার আনন্দ। রাতে যখন স্নিগ্ধা ফোন করে, ওর গলাতে ঝরে পড়ছিলো আকুতি - কাকুতি - মিনতি - নির্লজ্ব আকুলতা। তবে অপেক্ষা করতে হয়েছে তার জন্য অনেকদিন পারভীনকে। ধীরে ধীরে দক্ষ শিকারীর মতো অপেক্ষা করেছে, সুযোগ খুঁজে গেছে। এমনভাবে খেলাটা সাজিয়েছে, যাতে কেউ না বুঝতে পারে - স্নিগ্ধা নিজেও না। আর সেই পাতা ফাঁদে ধীরে ধীরে স্নিগ্ধাকে জড়িয়েছে , এমনভাবে ওকে সবকিছু বুঝিয়েছে , এমনভাবে ওর মনের ওপরে নিজের প্রভাব বিস্তার করেছে , সেটা থেকে বেরোতে পারার সব রাস্তা আজ বন্ধ ওর সামনে। আর আজ রাতেই সেই খেলা শেষ করতে হবে। আর টেনে নিয়ে যাওয়া যাবে না এই ব্যাপারটা। এমনিতেই স্নিগ্ধা মাঝে মাঝেই ফোন করে ওকে বিয়ের কথা বলছে।
বিয়ে, বিয়ে ? হাসি ফুটে ওঠে পারভীনের চোখে মুখে। সে একদিন ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলো আমাকে , আমার দেওয়া গোলাপটা পায়ের নিচে মাড়িয়ে চলে গিয়েছিলো, আজ সে, সেই স্নিগ্ধা নিজে ফিরে এসে আমার পায়ে পড়েছে। হাহাহাহা ! জোরে জোরে হেসে ওঠে পারভীন। ওপরে উঠে, একটা স্টোর রুমে গিয়ে, একটা অনেক পুরোনো ট্রাঙ্ক বের করে নিয়ে আসে পারভীন।
ট্রাঙ্ক এর ওপর থেকে ধুলো ঝেড়ে, হাতে মুখে ধুলো মেখে, ট্রাঙ্ক খুলে পারভীন চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ ! অনেক অনেক বছর পরে এই ট্রাঙ্ক খুলেছে ও। বের করে আনে ভেতর থেকে বেশ কিছু একটা ধূসর, হলুদ হয়ে যাওয়া ফটো, একটা ছেঁড়া ডায়রি , ডায়রির পাতার ভাঁজে শুকিয়ে যাওয়া, ছিঁড়ে ঝুরঝুরে হয়ে যাওয়া গোলাপের পাপড়ি। ধীরে ধীরে হাতে তুলে নেয় ফটোগুলো , সাবধানে, যত্নের সাথে। স্মৃতির সাথে মনটাও চলে যায় অনেক অনেকগুলো বছর আগে। ও যেন অবলোকন করতে থাকে ঘটনাপ্রবাহ, নিজের চোখের সামন......
একটা পাহাড়ী রাস্তা, একটু আগেই বৃষ্টিতে ভিজে চারদিক হয়ে উঠেছে শান্ত, পবিত্র, নির্মল। সবুজ গাছপালার মধ্যে, পাখীদের কলতান, পাতাগুলো দোলার মর্মর ধ্বনি ! লাল টুকটুকে সাইকেল চালিয়ে, বান্ধবীদের সাথে গল্প করতে করতে চলেছে মেয়েটি। ওদের হাসি, কথা বলা, সাইকেলের আওয়াজে, নিস্তব্ধ প্রকৃতিও নেচে উঠেছে আনন্দে। দূর থেকে, গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে একটি ছেলে। সাইকেল গুলো এগিয়ে আসার শব্দে চুপ করে দাঁড়িয়ে পড়ে ছেলেটি, হাতে একটা পুরোনো রোল ক্যামেরা। ধীরে ধীরে সন্তর্পণে , গাছের আড়াল দিয়ে মুখ বাড়িয়ে তোলে দুটো ফটো। মেয়েগুলো রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলে যাচ্ছে , হঠাৎ লাল সাইকেলে বসা মেয়েটি পেছনে মুখ ঘুরিয়ে কি যেন একটা খুঁজতে থাকে। ছেলেটি তাড়াতড়ি মাথা নিচু করে বসে পড়ে , ভাবে, এই রে ! দেখে ফেললো না তো !
কলেজে গিয়ে লাঞ্চ এর সময়ে খেলা ছেড়ে, বন্ধু বান্ধবদের থেকে দূরে এসে, সামনের কনভেন্টের পেছনের বেড়া টপকে আসে ছেলেটি, একটি আড়ালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে মেয়েটিকে। মেয়েটি তখন ওর বান্ধবীদের সাথে একটা জায়গাতে বসেছিলো, গান করছিলো। মন্ত্রমুগ্ধের মতো মেয়েটির গান শুনছিলো ছেলেটি। মনে হচ্ছিলো যেন হাওয়াতে ভাসছে ছেলেটি, পাশে মেয়েটিও ভাসছে, হাতে হাত রেখে। হঠাৎ লাঞ্চ শেষের ঘন্টা পড়ে , মেয়েটি বাকিদের সাথে ভেতরে ঢুকে যায় ! ছেলেটিও বেরিয়ে চলে আসে, ফিরে আসে কলেজের সামনে।
তখন ছেলেটি পড়ে ফার্স্ট ইয়ারে আর মেয়েটি ক্লাস ইলেভেন। কিছুদিন পরেই ছিলো ভ্যালেন্টাইন্স ডে ! অনেকটা সাহস সঞ্চয় করে ছেলেটি। হাতে একটি গোলাপ নিয়ে মেয়েটির সামনে এসে দাঁড়ায় ভ্যালেন্টাইন্স ডে র দিন সকালে। সেদিন ও পরেছিলো একটা গোলাপী রঙের হাঁটু পর্যন্ত স্কার্ট, আর ওপরে একটা সাদা টপ ; মাথায় ছিল আকাশী নীল রঙের উলের টুপি! সাথে ছিলো আরো কয়েকজন বান্ধবী। ছেলেটিকে দেখে, অন্যরা হাসতে হাসতে এ ওর গায়ে ঢলে পড়ে ; একটু পরে সবাই ওকে বাই বাই বলে চলে যায়। রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে শুধু ছেলেটি আর মেয়েটি। ছেলেটি প্রথমে পকেট থেকে বের করে আনে ওর হাতে তোলা ফটো গুলো, তুলে দেয় মেয়েটির হাতে। মেয়েটি কিছু না বলে ফটোগুলো তুলে নেয় হাতে, হাসি ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয় গাম্ভীর্যে। এর পরে ছেলেটি মেয়েটির দিকে বাড়িয়ে দেয় গোলাপ, প্রপোজ করে ওকে। জিজ্ঞেস করে ,"স্নিগ্ধা ! তুমি কি আমার ভ্যালেন্টাইন হবে ? শুধু আজকের জন্য নয়, বা কয়েক সপ্তাহের জন্য নয় ! সারা জীবনের জন্য ? আমি, আমি তোমার গান শুনেছি, তোমাকে দেখেছি , তোমাকে আমার ভালো লেগেছে। যদিও আমি জানি, তোমার তুলনায় আমি হয়তো কিছুই না , আমার মা বাবা নেই, মামার বাড়িতে মানুষ , পড়াশোনাতেও মোটামুটি। জানি না ভবিষ্যতে কি হবে, তবে তুমি পাশে থাকলে...."
স্নিগ্ধা হাত তুলে বাধা দেয় ছেলেটিকে। রাগের স্বরে বলে ওঠে, "তুমি ! তুমিই তো আমাকে ফলো করতে , তাই না? লজ্জা করে না , এইভাবে মেয়েদের পেছনে ঘুরে বেড়াতে? কি যেন বললে, তোমার মা বাবা নেই, মামার বাড়িতে মানুষ ? পড়াশোনাতেও মোটামুটি ? আমি কেন মেনে নেবো তোমাকে ? কি আছে তোমার মধ্যে ? দেখতেও তো এমন কিছু আহামরি নয় তোমাকে যে তোমাকে পাশে নিয়ে ঘুরলে সবাই অটোগ্রাফ নিতে আসবে ! আর এই যে, এই ফটোগুলো নিয়েছো , এগুলো নিয়ে যদি আমি পুলিশে যাই, কি হবে তোমার , সেটা জানো তো ? ডিসগাস্টিং। আমার সাথে আর কোনোদিন দেখা করার চেষ্টাও করবে না। আমি তোমাকে ভালোবাসি না, তোমাকে আমার পছন্দ হয় নি একদম। তোমার সাথে তো আমার কোনো ভবিষ্যৎ আমি দেখতে পাচ্ছি না। যাও যাও, সামনে থেকে সরে যাও ! একদিন যখন আমি গান গেয়ে অনেক ওপরে উঠবো, তখন না হয়, রেডিও তে বা ক্যাসেটে আমার গান শুনো ! যত্তসব। গোলাপটা রাস্তার ওপরে ছুঁড়ে ফেলে, পা দিয়ে মাড়িয়ে চলে যায় স্নিগ্ধা। ফটো গুলো উড়িয়ে দেয় হাওয়াতে। একটু পরেই ছেলেটা স্নিগ্ধার বাকি বান্ধবীদের গলা পায় , সবাই হাসছে ওকে নিয়ে, মজা করছে। কেউ কেউ বলে ওঠে জোরে জোরে , "বেশ করেছিস।"
"কি সাহস দেখ, আবার প্রপোজ করছে !
" "আবার ফটো ও তুলেছে "
সেদিন চোখের জলে ভেসে যায় ছেলেটি। সেই ছেলেটি আজকের পারভীন। আজ পারভীনের কাছে হাত পাততে হচ্ছে কাজের জন্য, শরীরের জন্য স্নিগ্ধাকে। সেদিন রাতে বারবার প্রার্থনা করেছিলো ভগবানের কাছে ছেলেটি , "আমাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করো ভগবান, আর তারপরে আর একবার আমাকে আর ওকে সামনাসামনি এনে দিও। যে আমাকে এতো কাঁদিয়েছে, তাকে, তাকে..."
স্নিগ্ধাকে অনেকদিন পরে পারভীন দেখেছিলো, ওর আর বিতানের বিয়েতে। সেদিন, অনেকদিন পরে, আবার সেই পুরোনো অপমানের জ্বালাটা ফিরে আসে, দাউদাউ করে জ্বালাতে থাকে ওকে। মনে মনে হেসে ওঠে, তাহলে এভাবেও ফিরে আসা যায় ?
গানের রেকর্ডিং এর সূত্রে , মলয় স্নিগ্ধাকে নিয়ে আসে ওর সামনে। সেই শুরু। ধীরে ধীরে পারভীন স্নিগ্ধাকে নিজের কাছে নিয়ে আসে। কখনও কোনো ভাবে জোর করতে হয় নি ওকে , তবে বিতানের সমস্যাটা , কোনো একদিন, এক অসতর্ক মুহূর্তে স্নিগ্ধা বলে ফেলে পারভীনকে। আর পারভীন সেই থেকে স্নিগ্ধার কানের কাছে ধীরে ধীরে সময় আর সুযোগ বুঝে , বোঝাতে থাকে ওকে। বলে ও নারী হিসেবে সম্পূর্ণ নয় ! কেন এইরকম সম্পর্কে নিজেকে শেষ করে দিচ্ছে ও ? স্নিগ্ধা এতো ট্যালেন্টেড একজন সিঙ্গার, সারাক্ষণ মনের মধ্যে বিতান , বিতানের ভালোবাসা না পাওয়ার জ্বালা নিয়ে কেন নিজেকে কষ্ট দিচ্ছে ও ? নারী হিসেবে, একজন স্বাধীন মানুষ হিসেবে , স্নিগ্ধার নিজের ও পুরো স্বাধীনতা আছে নিজের শর্তে বাঁচার। শরীরটা জাস্ট একটা অজুহাত, সেটা দিয়েই সমাজ জোর করে বেঁধে রেখেছে নারী পুরুষের সম্পর্ক কে, বিয়ের মাধ্যমে। বিয়ে যদি না ও ভাঙতে চায় স্নিগ্ধা , তবুও তো ওর কাছে, ওর সামনে সুযোগ আছে। আগে নাহয়, ও কাজ করতো না। কিন্তু এখন তো কাজের সূত্রে বেরোচ্ছে বাইরে। আরো অনেক লোকজনের সাথে মেলা মেশা করতে হচ্ছে।
স্নিগ্ধা দুর্বল হতে থাকে।
মানসিকভাবে দুর্বল মানুষদের একটা সমস্যা আছে - সে যে সমস্যা নিয়ে চিন্তা করে, আর সেটা থেকে বেরিয়ে আসার কথা, যে বলে দিনের পর দিন, কানের সামনে, তার ওপরে সে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে তার অবচেতনে। ধীরে ধীরে সেই অবিচেতন গ্রাস করে চেতনার জগৎকে। ঠিক ভুল বুঝতে পারে না মানুষ। স্নিগ্ধাও ধীরে ধীরে পারভীনের দিকে এগিয়ে আসে , একদিন ভীষণভাবে কেঁদে ওঠে পারভীনের সামনে। নিজেকে মেলে ধরে সম্পূর্ণ ভাবে।
সেদিন রাতে, রেকর্ডিং বন্ধ করিয়ে, পারভীন স্নিগ্ধাকে নিয়ে এসেছিলো নিজের বাড়িতে। প্রথম দিকে জড়তা, সমাজ, লজ্জা, ভয় সবকিছু নিয়ে দ্বিধার মধ্যে ছিলো স্নিগ্ধা। পারভীন কোনো কিছু না বলে এগিয়ে এসে হঠাৎ করে ওর ঠোঁটের ওপরে রাখে নিজের ঠোঁট। আর পারে না স্নিগ্ধা নিজেকে আটকাতে। সম্পূর্ণ ভাবে উজাড় করে দেয় পারভীনের কাছে স্নিগ্ধা নিজেকে।
সেদিন প্রথমবার, স্নিগ্ধা চরম তৃপ্তিতে কেঁপে ওঠে বারে বারে ! শেষে কান্নায় ভেঙে পড়ে , পারভীনের নগ্ন বুকে মাথা রেখে নগ্ন স্নিগ্ধা চোখের জলে ভিজিয়ে দিতে থাকে পারভীনকে। ধীরে ধীরে জিজ্ঞেস করে, "এটা , এটা কি ঠিক হলো পারভীন ? আমি যে অন্য কারোর স্ত্রী, তার সন্তানের মা। আমি কেন এতো দুর্বল হয়ে পড়লাম পারভীন ? ছি, ছি ! তুমি আমাকে খুব খারাপ মেয়ে ভাবছো, তাই না ? আমি,এই আমিই তোমাকে একসময়....! "
পারভীন স্নিগ্ধার ঠোঁটের ওপরে আঙ্গুল চেপে বলে ওঠে ,"পুরোনো কথা ভুলে যাও স্নিগ্ধা ! আর তুমি শুধু একটা কথা ভাবো, কারো স্ত্রী বা কারোর মা হওয়ার আগেও, তুমি একজন নারী, একজন সম্পূর্ণ মানুষ। আমাদের শরীরের বেঁচে থাকার জন্য যেরকম জল, খাদ্যের প্রয়োজন, তেমনি মনের জন্য - শরীরের চাহিদা কামনা মেটানোটাও দরকার সময়ে সময়ে। তুমি খুব ভালো স্নিগ্ধা , তুমি জানো সেটা ? আমি এটাও জানি, তুমি বিতানকে খুব ভালোবাসো, আর সেটাই স্বাভাবিক। থাক না আমাদের এই সম্পর্ক সমাজের বেঁধে দেওয়া নিয়মের বাইরে , দিতে হবে না কোনো নাম এই সম্পর্কের। এটা শুধু এক বন্ধু আর বান্ধবীর সম্পর্ক , সেটা শুধু আমাদের মধ্যেই থাকবে , কেউ জানবে না ! "
গভীর রাতে, প্রায় আড়াইটের সময়ে ফিরে আসে স্নিগ্ধা। বিতান জানলো, ও রেকর্ডিং শেষ করে ফিরে এসেছে।
সেই শুরু, এর পর মাঝে মাঝেই দুজনে একসাথে থাকতো। এর বদলে, স্নিগ্ধা হঠাৎ করেই পারভীনের সব সিনেমার প্লে ব্যাক করার সুযোগ পেয়ে গেলো ধীরে ধীরে।
স্নিগ্ধা আসার পরেই, দরজা খুলে দাঁড়ায় পারভীন নিজে। খালি গায়ে, শুধু একটা সাদা ট্রাউজার পরে বেরিয়ে আসে পারভীন। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় এখনো লেগে জলের ফোঁটা , নিজেকে সামলাতে পারে না স্নিগ্ধা। জোরে ঝাঁপিয়ে পড়ে পারভীনের ওপরে। পারভীনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কুকুর দুটো, ঘেউ ঘেউ শব্দ করে ডেকে ওঠে ! ওদের কে ধমকে কিছু একটা বলে পারভীন, চুপ করে ভেতরে চলে যায় ওরা। স্নিগ্ধাকে তাড়াতাড়ি সম্পূর্ণ উম্মুক্ত করে, নিচের ঘরেই , সোফার ওপরে বসিয়ে, ওকে আদর করতে করতে নিচের দিকে নেমে আসে পারভীন। প্রবল আশ্লেষে স্নিগ্ধার চোখ যখন বন্ধ হয়ে আসে, ওকে কোলে তুলে নিয়ে ওপরে উঠে আসে পারভীন। পা দিয়ে বেডরুমের দরজা ঠেলে, ভেতরে ঢুকে , বিছানায় গড়িয়ে দেয় স্নিগ্ধাকে। বিছানার ওপরে উঠে বসে ইশারা করে পারভীনকে ডাকে স্নিগ্ধা এগিয়ে আসার জন্য, অপেক্ষা করে থাকে সেই মুহূর্তের, যার জন্য মনে হয় সারা বিশ্বসংসার মিথ্যে, সারা পৃথিবী মিথ্যে, সবার অস্তিত্ত্ব একটা বিরাট বড়ো ভ্রম। শুধু এই মুহূর্তটুকুই সত্যি, আর সত্যি নিজের শরীরের ওঠা নামা - শ্বাস প্রশ্বাস !
প্রায় মিনিট কুড়ি পরে ক্লান্ত দুটো নগ্ন শরীর, বিছানায় শুয়ে, একে অপরকে জড়িয়ে ! এইভাবেই আরো কিছুক্ষণ শুয়ে থাকে স্নিগ্ধা। একবার তাকিয়ে দেখে পারভীনের দিকে, বাচ্চা ছেলের মতো নরম হয়ে গেছে ওর মুখ, মাথার ঝাঁকড়া চুলে বয়সের রেখা , উপুড় হয়ে থাকা ঘর্মাক্ত পিঠের ওপর দিয়ে প্রতিফলিত হয়ে পিছলে আসছে আলো। পারভীনের কপালে আদর করে , ধীরে ধীরে উঠে আসে স্নিগ্ধা। পারভীন চুপ করে শুয়ে থাকে। লাগোয়া টয়লেটে গিয়ে , একটু পরে বেরিয়ে আসে স্নিগ্ধা। পারভীনের স্টোরেজে রাখা রাতপোশাকটা টেনে নিয়ে গায়ে জড়িয়ে এসে বসে বিছানার ওপরে। সাইড টেবিলে রাখা জলের বোতল টেনে নিয়ে ঢকঢক করে জল ঢালে গলায়। হঠাৎ চোখে পড়ে সাইড টেবিলে রাখা একটা ডায়রি ! কৌতূহল বশে হাতে টেনে নেয় ডায়রিটা।
ডায়রি থেকে কয়েকটা ফটো পড়ে যায় মেঝেতে। ফটো গুলো তুলেই প্রচন্ড চমকে ওঠে স্নিগ্ধা। এ তো, এগুলো তো সেই সব পুরোনো ফটো। অতদিন আগে তোলা ফটোগুলো আজ ও পারভীন রেখে দিয়েছে ? কেন ? আর ফটোগুলোর ওপরে বড়ো করে লাল পেন দিয়ে ক্রস করা কেন? একটা হাড় হিম করা স্রোত নেমে যায় স্নিগ্ধার মেরুদন্ড বেয়ে। হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে একটা অজানা আশঙ্কায়।
পারভীনের দিকে তাকিয়ে দেখে স্নিগ্ধা। এখনও একইভাবে শুয়ে আছে ও। ডায়রির পাতা ওল্টায় ও।
পারভীনের ডায়রি। ....................
"আজ স্নিগ্ধাকে দেখলাম, ওর বিয়েতে। কি ভালোই না লাগছিলো ওকে। সেই প্রথম দিনের মতো। ওর পাশে, ওর স্বামী, বিতান, খুব ভালো মানিয়েছে দুজনকে। তবে ওদের দুজনের বয়সের পার্থক্যটা বেশ বেশি, তাই না ? "
"অনেকদিন হয়ে গেলো, স্নিগ্ধা কোনো কিছু কাজ করছে না। মাঝে কিছু ব্যান্ডের সাথে কাজ করছিলো। কেন ? ও কি কাজ পাচ্ছে না ? আমি দেখি একটু, যদি কিছু করা যায় ! "
"মলয়, আমার নতুন সিনেমার গানের রেকর্ডিং করার জন্য মুম্বাই থেকে একজনকে আনবে বলেছিলো। আমি ওকে স্নিগ্ধার নাম রেকমেন্ড করেছিলাম। আজ আবার আমার সামনে ছিলো স্নিগ্ধা। প্রচন্ড ইন্টিমেট গানটা রেকর্ড করবে না বলেছিলো প্রথমে। আমি একটু ছোট করে 'চিমটি' দিলাম ওকে। তাতেই কাজ হলো দেখলাম। কিন্তু ও ভালো করতে পারছে না গানটা। আমার একটা সন্দেহ জাগছে মনের ভেতরে। "
"ধীরে ধীরে স্নিগ্ধা অনেক স্বাভাবিক হয়েছে। আমি ওকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছি, যে পুরোনো কোনো কথা মনে রেখে, আমি মনের ভেতরে ওর জন্য কোনো রাগ পুষে রাখিনি। আমরা এখন খুব ভালো বন্ধু। মাঝে মাঝে তবে ও ভীষণ উদাস হয়ে থাকে। কেন বুঝতে পারি না। মাঝে এক দুবার আমি ওকে কাঁদতেও দেখেছি ভেতরে। কিন্তু এখনও জিজ্ঞেস করার সময় আসে নি। "
"আজ আমি অনেকটাই জানতে পারলাম। স্নিগ্ধা আর বিতানের সম্পর্ক নিয়ে, ওদের ভেতরের গোপন কথা, কেন স্নিগ্ধা মাঝে মাঝে এরকম আচরণ করে , কেন ও আইটেম গান বা ঘনিষ্ঠ দৃশ্যের গান করার সময় হারিয়ে যায় কোথাও। এই তো, আমি অবশেষে পেয়ে গেছি , সেই দুর্বল জায়গাটা। এটা নিয়েই আমাকে খুব সাবধানে....আমি, আমি এখনো ভুলতে পারি না সেই ছেলেটাকে স্নিগ্ধা , সেই সময়টাকে। "
"ওহ, কি আগুন , কি উদ্দামতা, কি পাগলামো। এতো এতো আগুন ও থাকতে পারে , কারোর মধ্যে ? আমি আবার পুড়তে চাই , সাথে তোমাকেও আমি পোড়াতে চাই স্নিগ্ধা। ঠিক সেইভাবে, যেভাবে আমি জ্বলেছি , দিনের পর দিন। "
"ইউ আর জাস্ট গ্রেট পারভীন, জাস্ট গ্রেট। স্নিগ্ধা অবশেষে, বিতানকে ছেড়ে, সবকিছু ছেড়ে বেরিয়ে গেছে ! ওদের সবকিছু ভেঙে চুরমার করে দিয়েছি আমি, আমি, হ্যাঁ আমি। স্নিগ্ধা বুঝতেও পারে নি কিছু । ও ভেবেছে ও নিজের কথা বলছে ? ও আসলে ওর মুখ দিয়ে আমার কথাগুলোই বলেছে। এটাকেই তো বলে, লোহা যখন গরম, তখন তাকে পেটাও। যখন স্নিগ্ধা প্রচন্ড দুর্বল হয়ে পড়েছিল, প্রতিমুহূর্তে, ফোন করে, দেখা করে, সামনে বসিয়ে আমি তো এগুলোই বলে এসেছি ওকে। সংসার কি ? সংসার তো জাস্ট একটা মায়া , সেখানে শুধু প্রেম ভালোবাসা দিয়ে কিছুই হয় না। যেখানে শরীর নেই, বিতানের শরীরের স্পর্শে জেগে ওঠে না স্নিগ্ধা, সেখানে স্নিগ্ধার থাকার ও কোনো দরকার নেই। এভাবে কি বেঁচে থাকা যায়? পুরো পৃথিবীটাই তো শরীর, আর শরীর সর্বস্ব, শরীরের জন্যই তো সব। হাহাহাহাহা....মূর্খ, আকাট মূর্খ। কোনোকিছু গড়ে তুলতে যত সময় লাগে, কয়েক সেকেন্ডে সেটাকে ভেঙে দেওয়া যায়। ঠিক যেরকম ভাবে আমাকে শেষ করে দিয়েছিলে তুমি, আমি প্রায় শেষ করে দিয়েছিলাম নিজেকে। মনে পড়ে স্নিগ্ধা ? মনে পড়ে ? "
ভীষণ ভাবে চমকে ওঠে স্নিগ্ধা। এ আমি কি পড়লাম ? তাহলে, তাহলে আমি যা ভেবে এসেছি এতদিন ধরে, যা লালন করে এসেছি মনের মধ্যে , যা বিশ্বাস করে এসেছি, সবটাই কি ভুল ? আমি কি কোনোভাবে ভীষণ বড়ো একটা ভুল করে ফেলেছি ? নিজের প্রতি, বিতানের প্রতি , শৌনকের প্রতি? আর সবকিছুর মূলে রয়েছে এই, এই পারভীন?
ধীরে ধীরে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় স্নিগ্ধা। পারভীনের দিকে তাকায়। পারভীন ধীরে ধীরে উঠে বসে। স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে ,"কি হলো ? তোমার মুখ চোখ এরকম লাগছে কেন ? "
ঝাঁপিয়ে পড়ে স্নিগ্ধা পারভীনের ওপরে রাগে, ঘৃণায় ! চেঁচিয়ে ওঠে,"তুমি, তুমি আমার এতো বড়ো সর্বনাশ করতে পারলে ? এগুলো, এসব কি ?" ডায়রিটা ছুঁড়ে মারে পারভীনের মুখের ওপরে স্নিগ্ধা। ডায়রিটা হাতে তুলে নিয়ে , শান্ত গলায় বলে ওঠে পারভীন ,"ওহ, তুমি তাহলে সব জেনে গেছো ? ভালোই হয়েছে , বুঝেছো। আমি ও আর পারছিলাম না খেলাটা চালাতে। তোমাকে আমার কিছু বলার নেই। তুমি জানো বাইরে বেরোনোর দরজাটা কোনদিকে। "
"তুমি, তুমি কি করে পারলে ? কেন আমাকে, আর বিতানকে আলাদা করে দিলে ?"
পারভীন ধীরে ধীরে বলে ওঠে,"একটা কথা জানো তো স্নিগ্ধা ! মানুষ নিজের ভুল না দেখে, সবসময় অন্যের দিকে আঙ্গুল তোলে। এটা আমার ভীষণ অপছন্দের। তোমার জন্য এই হয়েছে, ওই মানুষটার জন্য আমার ক্ষতি হয়ে গেলো। কেন ? সবসময় কেন অজুহাত খোঁজার চেষ্টা করো ? যা হয়েছে, তোমার নিজের ইচ্ছেতে হয়েছে। আমি শুধু তোমাকে কিছু কথা বলেছিলাম, কিন্তু সে সব তো সত্যি কথা। ভালো করে ভেবেই দেখো না , ওর মধ্যে কি ভুল আছে। এবার সেটা তুমি কিভাবে গ্রহণ করেছো, সেটা তোমার ব্যাপার। আমি এর জন্য কোনোভাবে দায়ী নই ! আর শোনোলতা মঙ্গেশকর না নও, না তোমার গানে এক্সট্রা অর্ডিনারি কিছু আছে তোমার আজকের ক্যারিয়ার আমার দয়াতে । তুমি একটা শরীরসর্বস্ব মেয়ে ছাড়া কিছু নও। তোমার শরীর পুরোনো হয়ে গেছে আর আমও তো নতুন করে কোনা চার্ম খুঁজে পাচ্ছি না l তুমি কোন মিউসিক ডিরেক্টর কি প্রোডিউসার সাথে হুক উপ হয়ে যেয়ো নয়তো প্লেব্যাক চান্স ও পাবে না জাস্ট ফ্রেন্ডলি সাজেশন । হা হা "
"রাগে কাঁপতে কাঁপতে চেঁচিয়ে ওঠে স্নিগ্ধা ,"আর আমার সাথে, আমার শরীর নিয়ে যখন তখন খেলা করা ? যখন তখন আমাকে ডাকা? সেটাও সব আমার দোষ, তাই না ? আমিই তার জন্য দায়ী ! তাই তো ? "
"অফকোর্স। ভালো করে ভেবে দেখো তো, তখন যদি আমি না থাকতাম, হতে পারতো অন্য কারোর কাছে তুমি যেতে। যেতে না ? তোমার তখন অবস্থা এমনটাই ছিলো, কেউ যদি তোমার সাথে একটু ভালোবেসে, হেসে কথা বলতো, কয়েকদিন পরে তুমি তার দিকেই ঝুঁকতে। ভালো করে নিজের মনকে প্রশ্ন করো। আমাকে নয়! তুমি তখন পালাতে চেয়েছিলে, ওই, ওই লোকটা, কি যেন নাম ? বিতান, বিতানের কাছ থেকে। কিন্তু বিতান যে তোমাকে প্রচন্ড ভালোবাসে, সেটাকে অস্বীকার করে তুমি বেরোতে পারছিলে না। আমি তো শুধু একটা অনুঘটক মাত্র। যাই হোক। আমার, আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। তুমি বরং এবার এসো। আর ভালো করে ভেবে দেখো। আর একটা কথা শোনো যাওয়ার আগে , একদিন একটা সময়ে আমি প্রচন্ড জ্বলেছি , তোমার জন্য, তোমার সেই, সবার সামনে আমাকে অপমানের পরে। একটু নিজেও জ্বলে দেখো। যদিও, যদিও আমি তোমাকে ভালোবাসি, আজ ও, কিন্তু তবুও আমি , আমি হাঁপিয়ে উঠেছি তোমাকে নিয়ে। জাস্ট গেট লস্ট। "
ধীরে ধীরে মেঝের এক কোণে বসে পড়ে স্নিগ্ধা , মাথা দুই হাঁটুর মধ্যে গুঁজে কাঁদতে থাকে অঝোরে। মনের ভেতরে হাজার একটা প্রশ্ন এসে উঁকি দিয়ে চলে যায় ;
তাহলে কি সব কিছু মিথ্যে?
আমার চিন্তা ভাবনা মিথ্যে?
আমার চাহিদা , কামনা, বাসনা , সব মিথ্যের জাল?
আমার আগে এগিয়ে যাওয়ার চিন্তাটাও মিথ্যে?
আমার মিউসিক ক্যারিয়ার একটা ইলুশন ?
শুধু কি ভালোবাসা দিয়েই সব কিছু ভোলা সম্ভব?
আমার নারী হয়ে ওঠার সার্থকতা কি শুধুই ত্যাগে, মুখ বুজে, সব ভুলে, স্বামী বাচ্চা নিয়ে সংসার ধর্ম পালনে?
কোনো উত্তর খুঁজে পায় না স্নিগ্ধা। একটু পরে চোখের জল মুছে চুপ করে বেরিয়ে আসে পারভীনের বাড়ি থেকে। কেঁদে কেঁদে, চোখের কাজল ঘেঁটে লেপ্টে গেছে চোখের চারদিকে, চোখের জল শুকিয়েছে গালের ওপরে। ফেস পাউডার, মেকআপ সব কিরকম ধেবড়ে গেছে এখন। মাথা কাজ করছে না একদম, সব যেন কিরকম অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে।
গাড়ির ড্রাইভারের সিটে বসে, বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে, ধূসর ঘন সবুজ প্রেক্ষাপট, তার ওপরে টুকরো টুকরো কিছু ছবি ভেসে উঠেছে - একটি মেয়ে ভয়ে বিতানের হাতের মুঠোর মধ্যে নিজের হাত ঢুকিয়ে বাঁচতে চাইছে ; একটি মেয়ে বিতানের কাঁধে মাথা রেখে শুনছে বিতানের আবৃত্তি ; একটি মেয়ে বিতানের বুকের ওপরে শুয়ে রয়েছে; একটি মেয়ে ছোট্ট একরত্তি একটা ছেলেকে নিয়ে কোলে করে ঘোরাতে ঘোরাতে, বিতানের লেখা কবিতায় সুর করে গান গেয়ে শোনাচ্ছে !
আবার একটু পরে ঘন সবুজ , ধূসর মেঘের মতো প্রেক্ষাপট পরিবর্তিত হয়ে, চোখের সামনে নেমে এলো রক্তলাল এক পর্দা ; তার ওপরে ভেসে উঠছে একে একে অন্যরকম কিছু টুকরো টুকরো ছবি, - একটি মেয়ে গর্বে, দর্পে, পা দিয়ে গোলাপ মাড়িয়ে চলে যাচ্ছে ; একটি মেয়ে বিতানের গায়ের ওপরে হাত তুলছে; একটি মেয়ে বিতানকে লাথি মেরে সরিয়ে দিচ্ছে নিজের কাছ থেকে ; একটি মেয়ে রাতের অন্ধকারে নেমে, জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বিতানকে দেখিয়ে টেনে নিচ্ছে পারভীনকে, মিশিয়ে দিচ্ছে নিজের ঠোঁট পারভীনের ঠোঁটের সাথে, টেনে নিচ্ছে পারভীনের লোলুপ হাত নিজের উদ্ধত ব্লাউজের ওপরে; একটি মেয়ে; একটি মেয়ে বিতানের দিকে ছুঁড়ে মারছে গ্লাস, ফ্লাওয়ার ভাস ; একটি মেয়ে রাতের পর রাত, শুধু নিজের সুখের জন্য ছেলেকে ছেড়ে, রেকর্ডিংয়ের নাম করে বাইরে রাত কাটিয়ে আসছে , জানতেও পারছে না মেয়েটি ওর ছেলে রাতে কি খেলো, কতটুকু খেলো। ভাবনায় ডুবে যায় সিগ্ধা। ..আমি কি বিতানকে ভালোবাসতে পেরেছি কখনও ? আমি কি ওর ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য? ও যখন আমার জন্য, আমাদের সন্তানের জন্য, এতো পরিশ্রম করছিলো, দিন রাত এক করে দিয়েছিলো, আমাদের সবরকম ভাবে ভালো রাখার চেষ্টা করছিলো, নিজের অক্ষমতার কথা পাশে রেখে আমাকে সবসময় খুশি রাখার প্রচেষ্টায় নিমজ্জিত করেছিলো , তখনই আমি ধীরে ধীরে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিলাম ওর কাছ থেকে। চরম অপমান করেছি, ওর গায়ে হাত পর্যন্ত তুলেছি। আমাকেও তো মারধোর করতে পারতো বিতান ! কোনোদিন সেটা করেনি, উল্টে আমার রাগ, আমার ক্রোধ, আমার হাত পা ছোঁড়াছুঁড়ির সামনে, চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকেছে , সহ্য করে গেছে দিনের পর দিন সবকিছু। ওকে দেখিয়ে দেখিয়ে পারভীনের সাথে আমার মিথ্যে প্রেমের নাটকটাও দেখে আমার ওপরে আক্রমণ করেনি। ও কি মানুষ ? মানুষ হলে তো রাগ হবে, ক্রোধের আগুনে সব পুড়িয়ে ছারখার করে দেবে ? নাকি, এটাই বিতানের ভালোবাসা ? যে ভালোবাসা দিয়ে ও আমাকে, আমার সবকিছুকে মেনে নিয়েছিলো ? যদি কিছুদিন পরে, আবার সেই একই কারণে আমার বিতানের ওপরে রাগ হয় ? আবার যদি, যদি অন্য কারোর সাথে আমি সম্পর্কে লিপ্ত হই ? আমার কাছে কি আমার নিজের সুখটাই সব থেকে বেশি ? আর আমার ছেলে, বিতান ? ওদের কথা, ওদের কি কোনো মূল্য নেই আমার কাছে ? আমি, আমি নিজেও একটা মানুষ ? নাকি আমি শুধু শরীর সর্বস্ব একটি নারী , যে জানেনা কোনোকিছুর সাথেই নিজেকে মানিয়ে নিতে ; শুধুই ভাবে নিজের শরীরের সুখের কথা, ভাবে নিজের ইচ্ছে অনিচ্ছের কথা , ভাবে নিজের চাওয়া পাওয়ার কথা........!
সজোরে ব্রেক চেপে রাস্তার এক ধারে এসে দাঁড় করায় গাড়িতে স্নিগ্ধা। কাঁদতে কাঁদতে মাথা নেমে আসে স্টিয়ারিংয়ের ওপরে।
একটু পরে ধীরে ধীরে একটা পুলিশের জীপ পাশে এসে দাঁড়ায়। একজন অফিসার নেমে এসে জিজ্ঞেস করে স্নিগ্ধাকে , "ম্যাম , আর ইউ ওকে ? "
চমকে অফিসার এর দিকে তাকায় স্নিগ্ধা। অফিসার স্নিগ্ধাকে চিনতে পারে, তাড়াতাড়ি একটা ছোট কাগজের টুকরো, আর ওপরের বুকপকেট থেকে একটা পেন বের করে বাড়িয়ে দেয় ওর দিকে, অটোগ্রাফের জন্য। কোনোরকমে হেসে, নিজেকে ঠিক করে, ধীরে ধীরে গাড়ি ড্রাইভ করে ফিরে আসে স্নিগ্ধা। নিজেদের এপার্টমেন্টে। নিচে গাড়ি পার্ক করে ধীরে ধীরে লিফ্টে করে ওপরে আসে , ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে আসে। হাতঘড়ি দেখে, সময় এখন - রাত আড়াইটে।
কোনোরকমে টলতে টলতে, নিজের মৃত শরীরটাকে টেনে নিয়ে আসে ওপরে স্নিগ্ধা। সুপর্ণা (শৌনকের ন্যানি)দরজা খোলার আওয়াজে, চোখ রগড়াতে রগড়াতে উঠে আসে, শৌনকের রুম থেকে। স্নিগ্ধাকে সামনে দেখে জিজ্ঞেস করে ওঠে, "দিদি, এই এলে ? আজ খুব ক্লান্ত লাগছে তোমাকে। দাও, তোমার হাতের ব্যাগটা দাও আমাকে। "
স্নিগ্ধা হাত তুলে সুপর্ণাকে চুপ করিয়ে ভাঙা গলায়, ধীরে ধীরে জিজ্ঞেস করে ,"সোনু কোথায় রে ? ও খেয়েছে ? "
"দেখো না দিদি। ও রাতে আজ আর কিছু খেলোই না। সেই যে তুমি চলে গেলে, তোমার ওপরে রেগে গেলো, ওই নিজের টেডি নিয়ে খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে পড়েছে। ও তোমার রুমেই শুয়ে পড়েছিলো তোমার ছেড়ে রাখা শাড়ির আঁচল জড়িয়ে। আমি তো আবার ওকে টেনে এনে, ওর রুমে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছি। ডেকে তুলবো ? তুমি কিছু খাইয়ে দেবে ওকে ? "ভেতরে স্নিগ্ধার রুমের দিকে যেতে যেতে সুপর্ণা জিজ্ঞেস করে।
কোনো উত্তর না পেয়ে সুপর্ণা পেছনে তাকায়, স্নিগ্ধা কে দেখতে পায় না। তাড়াতাড়ি শৌনকের রুমে ঢুকে আসে সুপর্ণা , দেখতে পায় এক অভাবনীয় অথচ অতি কাঙ্খিত দৃশ্য চোখের সামনে।
শৌনককে জড়িয়ে স্নিগ্ধা শুয়ে পড়েছে ওর পাশে, টেনে নিয়েছে শৌনককে নিজের বুকের মাঝে। শৌনক ঘুমের চোখে 'মা' বলে নিজের পা তুলে দিয়েছে স্নিগ্ধার গায়ের ওপরে, মুখে একটা শান্তির আভাস।
এই দৃশ্য দেখার জন্য তিন তিনটে বছর সুপর্ণা অপেক্ষা করেছিলো , মাঝে মাঝেই প্রার্থনা করতো ঈশ্বরের কাছে, "হে ভগবান, মা আর ছেলেকে এক করে দাও। দিদিকে একটু বোঝাও, যাতে সময় থাকতে ছেলের কাছে ফিরে আসে, ওকে টেনে নেয় বুকে। চোখের কোণে চিকচিক করে ওঠে জল , সুপর্ণা দরজাটা ভেজিয়ে ধীরে ধীরে নেমে আসে নিচে, নিজের রুমে।
এ এক নুতুন সকাল
বিতানের কথা
সময় এখন সকাল নটা , কবিতা লিখতে লিখতে কখন যে বিতান ঘুমিয়ে পড়েছিলো টেবিলের ওপরে ! হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় ওর, তাড়াতাড়ি উঠে বসে সোজা হয়ে। মনে পড়ে যায় রাতের কথা। তাড়াতাড়ি ছুটে যায় মেহেক রাতে যে রুমে ছিলো সেখানে। কাউকে দেখতে না পেয়ে একটু অবাক হয় ও। রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা কিছু আওয়াজে , কিচেনের দিকে পা বাড়ায় বিতান। মেহেক চা বানাচ্ছে দুজনের জন্য। ওকে দেখে হেসে মেহেক বলে ওঠে," গুড মর্নিং। তুমি ঘুমোচ্ছ দেখে, আর ডাকি নি তোমাকে, ভাবলাম চা টা তৈরী করে নিয়ে তারপরে ডাকবো। " বিতান লজ্জায় পড়ে যায়, একটু হেসে বলে, "আরে, চা তো আমার তৈরী করার কথা ছিলো ! ঠিক আছে, আপনি যখন করছেন, আমি তাহলে একটু চোহে মুখে জল দিয়ে আসি , তারপরে একসাথে বসে চা খেয়ে আপনাকে ছেড়ে দিয়ে আসবো ! "
ভেতরে এসে চোখে মুখে জল দেয় ভালো করে বিতান। ব্রাশ করে বাইরে আসে। মেহেক আজ ওর সবকটা ঘরের জানালা খুলে দিয়েছে। অনেকদিন পরে হু হু করে বাইরের সব আলো একসাথে ভেসে এসেছে ভেতরে। এতদিন রুদ্ধদ্বার দেখে যে সব আলোর কণা ভেতরে ঢুকতে পারেনি, আজ খোলা হাওয়ার সাথে, তারাও এসে ভিড় জমিয়েছে, আলোকিত করে তুলেছে ভেতরের সব আসবাবপত্র, টেবিল, পর্দা, বিছানার চাদর - সবাইকে।
বিতানের মনটা আনন্দে ভরে ওঠে। কতদিন পরে এইরকম একটা দিন ও প্রত্যক্ষ করছে , নিজেও মনে করতে পারছে না ভালো করে। সেই স্নিগ্ধা যখন ছিলো...."এসে গেছি। " মেহেকের গলার স্বরে ঘোর থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো বিতান। মেহেক দু কাপ চা নিয়ে এসে বাইরের ঘরের সেন্টার টেবিলের ওপরে রেখেছে। বিতান ওকে বসতে বলে, ভেতর থেকে বিস্কিট নিয়ে আসে। দুজনে মিলে চা খেতে খেতে, বিতান জিজ্ঞেস করে ওঠে মেহেক কে ,"আচ্ছা মেহেক ! আপনি কাল রাতে, আমাকে আপনার কথাও বলেছিলেন , আপনার ভাই, মা, বাবার কথাও উল্লেখ করেছিলেন। যদি কিছু মনে না করেন, আপনার ভাই কে আমার সাথে দেখা করতে বলবেন ? আজ সাড়ে বারোটার দিকে ? আমি আমার ব্যবসা বাড়ানোর জন্য আরো কিছু ছেলে খুঁজছি। আর আপনার ভাই তো গ্র্যাজুয়েশন করে নিয়েছে। ওর একটা চটি ইন্টারভিউ নিয়ে, যদি দেখি ও ফিট করে যাচ্ছে...."
"না না বিতান, আপনি এভাবে দয়া করবেন না আমাকে। " বলে ওঠে মেহেক।
"দয়া ? দয়া নয় মেহেক , ও যদি আমার ইন্টারভিউ ক্র্যাক করতে পারে, তবেই ওকে নেবো। সেটা আমার ওপরে ছেড়ে দিন ! আর আমাকে এখন কাউকে হায়ার করতে হলে, পেপারে বিজ্ঞাপন দিতে হবে, জব সাইট গুলোতে পোস্ট করতে হবে। অনেকটা সময় চলে যাবে। তার থেকে যদি চেনা কন্ট্যাক্ট এর মাধ্যমে হয়ে যায় , ক্ষতি কি ? তাই না ? " টেবিলের ওপরে রাখা একটা পেপারের নিচ থেকে নিজের বিজনেস কার্ডটা বের করে মেহেকের হাতে তুলে দিয়ে বলে ওঠে বিতান, "এই যে, এইটা আমার অফিসের ঠিকানা। আপনি পাঠিয়ে কথা বলে নিন আপনার ভাইয়ের সাথে, যদি ও রাজি থাকে, ওকে অবশ্যই সাড়ে বারোটার সময়ে আসতে বলবেন। সাড়ে বারোটা থেকে এক মিনিট ও যদি দেরি হয়, আমি কিন্তু ওকে পাঠিয়ে দেবো। "
একটু পরে বাইরে বেরিয়ে আসে দুজনেই। মেহেককে একটা গাড়িতে তুলে দিয়ে ফিরে আসে বিতান। বিতান সুইচ অফ থাকা ফোনটা অন করে। ফোনটা অন করতেই একের পর এক মিসড কল এলার্ট আসতে থাকে ফোনের স্ক্রিনে। বিতান স্তব্ধ হয়ে বসে পড়ে সোফার ওপরে , বারোটা মিস কল - সবকটাই স্নিগ্ধার নম্বর থেকে ! কেন? এতদিন পরে, কি চায় স্নিগ্ধা ? ও কি, ও কি ফিরে আসতে চাইছে ? হঠাৎ একটা অজানা আশঙ্কায় মন কেঁপে ওঠে বিতানের। শৌনকের কিছু হলো না তো ? ও ভালো আছে তো ?
তাড়াতাড়ি সিগ্ধার নম্বর ডায়াল করে বিতান।
সিগ্ধা আর শৌনকের কথা
আজ বেশ সকালেই ঘুম ভেঙেগেছে শৌনকের। ঘুম ভেঙে পাশে শুয়ে থাকা মা কে দেখে ভীষণ অবাক হয়ে ওঠে ও। সেই কত ছোট বয়সেই মা ওকে আলাদা করে দিয়েছিলো, ওকে বাধ্য করেছিলো একা একা শুতে , অন্য একটা ঘরে। তখন কতই বা বয়স শৌনকের ? চার ? মা বলেছিলো, "শৌনক, তুমি খন বড়ো হয়ে গেছো, আর বড়োরা একা, আলাদা ঘুমোয় !"
ও মা কে বলেছিলো, "কিন্তু তুমি আর বাবা তো একসাথে ঘুমোয় , তোমরাও তো বড়ো ! তাহলে ? "
"আমাদের ব্যাপারটা আলাদা , আর বাবার তো খুব ভূতের ভয়। আমি পাশে না ঘুমোলে, বাবা যদি চেঁচিয়ে ওঠে মাঝ রাত্তিরে ? তাহলে ? কিন্তু আমার সোনু তো ভীষণ স্ট্রং আর বাহাদুর, তাই না ? ও তো একা শুতে ভয় পাবে না। আর আমরা তো পাশের রুমেই আছি। কোনো ভয় নেই ! "
একা একা ঘুমোতে, প্রথম প্রথম খুব ভয় করতো শৌনকের , কিন্তু মা যে বলেছে ও স্ট্রং আর বাহাদুর ! ও ভয় পাবে না একদম। কিন্তু খুব, খুব মিস করতো বাবা আর মায়ের মাঝে ঘুমোনোটা ও। রাতে একবার বাবাকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়তো, আবার কখনো বা মায়ের বুকের ভেতরে মুখ গুঁজে। এখানে, এই নতুন জায়গায় আসার পরে তো মা মাঝে মাঝেই রাতে কাজের জন্য বেরিয়ে যেত। সুপর্ণাদির কাছে থাকতে হতো। সুপর্ণা দি রাতে খাইয়ে দিতো ওকে। আজ হঠাৎ কি হয়েছে মায়ের ? আর মায়ের চোখের নিচে, বিছানা এরকম ভেজা কেন ? মায়ের চোখে কিছু হয়েছে ? শৌনক ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি মাকে ঠেলে ওঠায় , "মা ? ও মা ? ওঠো না ! কি হয়েছে তোমার ? "
ধড়ফড় করে উঠে বসে স্নিগ্ধা। এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না গত রাতের সব ঘটনা। সব যেন কোনো এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন ! চোখের সামনে শৌনককে দেখে বুঝতে পারে, সবটাই সত্যি, কঠোর বাস্তব। তাড়াতাড়ি শৌনককে জড়িয়ে ধরে নিজের বুকের মাঝে, আদরে, চুমুতে ভরিয়ে দেয় ওর মুখ। বার বার বলতে থাকে স্নিগ্ধা , "সোনু, তোকে আমি অনেক কষ্ট দিয়েছি , তাই না ? তোর মা, ভীষণ ভীষণ খারাপ ! খুব খারাপ। আর তোকে আমি কোনো কষ্ট দেবো না ! কাউকে আর আমার জন্য কোনো কষ্ট পেতে হবে না। "
অনেকদিন পরে, মায়ের গায়ের চেনা গন্ধটা পেলো শৌনক। ও নিজেও কাঁদতে শুরু করে মাকে জড়িয়ে ধরে। আজ আর ইচ্ছে করছে না কোথাও যেতে, খালি মনে হচ্ছে মাকে জড়িয়ে বসে থাকি, মায়ের কোলে মাথা রেখে চুপ করে শুয়ে থাকি, মা গান শোনাবে আমাকে, মাথায় চুলে বিলি কেটে দেবে , মাঝে মাঝে আদর করবে আমায়। "
কাঁদতে কাঁদতেই শৌনক বলে ওঠে,"মা ! মা ! খুব খিদে পেয়েছে। "
বাস্তবের মাটিতে ফিরে আসে স্নিগ্ধা। কপট রাগ দেখিয়ে, ছেলেকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। একটু রাগী রাগী স্বরে বলে ওঠে ,"খিদে তো পাবেই। কাল রাতে না ঘুমিয়ে খুব শুয়ে পড়া হয়েছিলো, তাই না ? আমাকে সুপর্ণা সব বলেছে। এবার ওঠো, যাও, বাথরুমে যাও। ব্রাশ করে ফ্রেশ হয়ে আয়। আজ আমি তোকে নিজের হাতে ব্রেকফাস্ট বানিয়ে খাওয়াবো। আজ আমরা লুচি আর আলুভাজা খাবো। কেমন ? "
শৌনক নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না , লুচি ? মা নিজে রান্না করবে ? কতদিন মায়ের হাতের রান্না খাইনি। সুপর্ণা দি রেডি করে দিতো, তাও কর্নফ্লেক্স বা ওটস, বা নুডলস ! মা বলতো, লুচি ছোটোলোকেরা খায় , আর ঐসব আজেবাজে তেলেভাজা খেলে শরীর খারাপ করে। ও আরো একবার জিজ্ঞেস করলো , "সত্যি ? সত্যি আজ আমরা লুচি খাবো ? " মাথা নাড়ে স্নিগ্ধা। ও চেঁচিয়ে ওঠে আনন্দে। তারপরে বলে,"মা, বলছি লুচি আর সাথে আলুর দম করো না ! আলু ভাজা বাবা ভালো করতো, কিন্তু তুমি কি ভালো আলুর দম করতে , মনে আছে তোমার ? প্লিজ ! প্লিজ ! "
হেসে ওঠে স্নিগ্ধা। "ঠিক আছে, ঠিক আছে। লুচি আলুর দম-ই হবে। এবার ওঠ, আর ভাগ বাথরুমে। "
শৌনক বাথরুমে চলে গেলে, তাড়াতাড়ি নিজের হাতে পুরো বিছানা করে ফেলে স্নিগ্ধা। ও মনে মনে ভাবে, আজ কেন জানি না, ঘরের এইসব কাজ করতে এতো ভালো লাগছে। আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম এই সব কাজের কথা , সুপর্ণাই সব কিছু করে দিতো।
স্নিগ্ধা বেরিয়ে আসে শৌনকের রুম থেকে। নিজের রুমের দিকে যেতে যেতে, চেঁচিয়ে ডাকে সুপর্ণা কে, সুপর্ণা নিচের থেকে মুখ বাড়ালে, স্নিগ্ধা বলে ,"তুই কয়েকটা আলু নিয়ে একটু সেদ্ধ করতে বসা, আর ময়দা মেখে দে। আজ আমরা সবাই লুচি আলুর দম খাবো। আর আমি করবো। বাকিটা একটু ফ্রেশ হয়ে, জামা কাপড় চেঞ্জ করে নিচে আসছি। সোনু নিচে এলে, ওকে একগ্লাস দুধ দিয়ে দিস ! "
নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায় স্নিগ্ধা।
নিচ থেকে সুপর্ণা ভাবে, "কি হলো দিদির ?" কিচেনের দিকে যেতে যেতে হেসে ওঠে নিজের মনে ,"যা হয়েছে ভালোর জন্যই হয়েছে তবে। "
নিজের রুমে এসে স্নিগ্ধা ঘড়ি দেখে। সাতটা বাজে। টাওয়েল নিয়ে বাথরুমের দিকে যেতে যেতে হঠাৎ কি মনে করে , পার্স থেকে মোবাইলবের করে আনে স্নিগ্ধা। তাড়াতাড়ি বিতানের নম্বর বের করে এনে , চুপ করে দেখতে থাকে স্ক্রীনটা। একটু পরে মনে হলো স্নিগ্ধার, কেউ যেন ওর আঙুলগুলোকে ঠেলে দিচ্ছে বিতানের নম্বর ডায়াল করার দিকে, কিছু বুঝে ওঠার আগেই নম্বর ডায়াল হয়ে যায়। ওদিক থেকে ভেসে আসছে যান্ত্রিক একটা শব্দ, - এই নম্বরটি এখন সুইচ অফ করে রাখা আছে।
আবার ফোন করে স্নিগ্ধা , আবার...আবার....আজ কথা যে বলতেই হবে বিতানের সাথে।
স্নিগ্ধা বেশ কিছুক্ষণ পরে নেমে আসে শৌনককে কোলে করে। সুপর্ণা শৌনককে স্নিগ্ধার কোলে দেখে অবাক হয়ে ওঠে আরো। ও তাড়াতাড়ি কিচেন থেকে বেরিয়ে আসে, "দিদি, লেগে যাবে তোমার। আমাদের সোনু কি আর ছোট্ট টি আছে ? নামিয়ে দাও ওকে কোল থেকে ! নামিয়ে দাও।"
শৌনক রেগে চেঁচিয়ে ওঠে স্নিগ্ধার কোল থেকে, "এই সুপু মাসী ! একদম কিছু বলবে না। আজ আমি মায়ের কোলে চড়ে ঘুরে বেড়াবো। আমার খুব ভালো লাগছে। খুব বাবার কথা মনে পড়ছে। বাবা ও এইরকম ভাবে..."
:"এই তো, মা আছে তো তোর সাথে সোনু। " শৌনকের কথা শেষ করতে না দিয়েই বলে ওঠে স্নিগ্ধা। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এসে শৌনককে টেবিলের সামনে চেয়ারে বসিয়ে সুপর্ণার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করে, "দুধ রেডি ? তাহলে ওকে এক গ্লাস দুধ দিয়ে দে দেখি। আর আমি এবার কিচেনে ঢুকছি। তুই সোনুর পাশে গিয়ে বোস। তোর জন্যও আমি ছটা লুচি ভাজছি, তোকেই খেতে হবে কিন্তু সুপর্ণা। " কিচেনে ঢুকে গেলো স্নিগ্ধা।
একটু পরেই একবাটি ভাজা লুচি আর আলুর দম নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে স্নিগ্ধা। সুপর্ণা তাড়াতাড়ি করে তিনটে প্লেট আর বাটি নিয়ে আসে। স্নিগ্ধা একটা প্লেট আর বাটি সরিয়ে রেখে, একটায় সুপর্ণাকে লুচি আর আলুর দম দিয়ে বসিয়ে, নিজে শৌনকের পাশে বসে। একটা প্লেট টেনে নিয়ে, বেশ কয়েকটা লুচি তুলে , নিজের হাতে শৌনককে খাইয়ে দিতে থাকে স্নিগ্ধা পরম মমতায়। শৌনক খেতে খেতে, হঠাৎ করেই জড়িয়ে ধরে মাকে। মুখ ভর্তি লুচি নিয়ে কোনোরকমে বলে ওঠে ,"মা, খুব ভালো হয়েছে। " লুচির টুকরো গুলো গিলে নিয়ে একটু পরে ধীরে ধীরে বলে, "মা, এভাবেই আবার খাওয়াবে তো আমাকে ? আমার খুব খুউউউউউউউব ভালো লাগছে তোমার হাতে খেতে। "
চোখ থেকে বেরিয়ে আসা জলের ফোঁটাগুলো কোনোরকমে সামলে, স্নিগ্ধা বলে ওঠে ,"হ্যাঁ রে সোনু। আমি এবার থেকে তোকে নিজে হাতে রান্না করে খাইয়ে দেবো। " অন্যদিকে ঘুরে ধীরে ধীরে বলে ওঠে স্নিগ্ধা ,"অনেক কিছু ভুল হয়ে গেছে, তোর দিকে দেখার ও সময় ছিলো না আমার। সব ধীরে ধীরে ঠিক করতে হবে আমাকে। "
শৌনক আনন্দে চেঁচিয়ে ওঠে ,"কি মজা ! মা আমাকে খাইয়ে দেবে ,আর আমাকে এই সুপু মাসীর হাতে খেতে হবে না। তুমি জানো মা ? এই সুপু মাসী না একদম আমাকে খাওয়াতে পারে না। আমাকে খাওয়াতে গিয়ে আমাকে স্নান করিয়ে দিতো তরকারিতে , আমার সারা মুখে, চোখে লাগিয়ে দিতো সব। বেশ হয়েছে। "
সুপর্ণা চোখদুটো গোলগোল করে, রাগী রাগী মুখ করে বলে ওঠে ,"তাই ? কবে আমি এরকম করেছি সোনু ? আমার বিরুদ্ধে নালিশ ? এই আমি আড়ি করলাম তোর সাথে। "
"মা দেখো না , আমার সাথে আড়ি করে দিয়েছে। " স্নিগ্ধার কোলে মুখ গুঁজে তাকায় স্নিগ্ধার মুখের দিকে। হেসে ওঠে স্নিগ্ধা। "তোরা থামবি দুটোতে ? সুপর্ণা, ও তো বাচ্চা, তুই ও বাচ্চাদের মতো হয়ে যাবি ? আর পারি না বাবা তোদেরকে নিয়ে। "
তিনজনেই হেসে ওঠে একসাথে। আজ কতদিন পরে একটা সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে এসেছে এই ঘরে ! খোলা জানালা আর বারান্দা দিয়ে ঘরে ঢুকে আসছে হাসির আলো, শান্তির হাওয়া , বেরিয়ে যাচ্ছে দমবন্ধ করে রাখা ঘন কালো দৈত্যগুলো।
ভাঙ্গা আয়নার জোড়া লাগা কি নুতুন দিনের আলো
কিচেনে রাখা স্নিগ্ধার মোবাইল ফোনটা হঠাৎ বেজে ওঠে। স্নিগ্ধা খেতে খেতেই ইশারা করে সুপর্ণাকে ফোনটা এগিয়ে দিতে ওর দিকে। সুপর্ণা কিচেনে গিয়ে ফোনটা রিসিভ করে , "স্নিগ্ধা ? আমি বিতান বলছি। তোমার অনেকগুলো মিস কল দেখলাম। এনি প্রবলেম ? "
আনন্দে নেচে ওঠে সুপর্ণার মন , বিতান দা। দিদিকে ফোন করছে ? আর দিদি সকাল থেকে অনেকবার বিতান দা কে ফোন করেছে ? তাহলে কি , তাহলে কি , স্নিগ্ধাদি আর বিতান দা, আবার......
সুপর্ণা ফোনটা এগিয়ে দেয় স্নিগ্ধার হাতে। স্নিগ্ধা ফোনটা কানে লাগিয়ে, সুপর্ণাকে ইশারায় বলে সোনুকে বাকি লুচি গুলো খাইয়ে দিতে, নিজে বেরিয়ে আসে বারান্দায়।
বিতানের গলা শুনতে পায় স্নিগ্ধা , সেই একইরকম গলা, একটু কি ভারাক্রান্ত ? মন খারাপের গলা ? গলায় একটা অস্বস্তিও যেন ফুটে উঠেছে ওর। বিতান আবার বলে, "হ্যালো ! স্নিগ্ধা ? শুনতে পাচ্ছ ? হ্যালো ? "
স্নিগ্ধা বারান্দায় বেরিয়ে আসে তাড়াতাড়ি, কোনোরকমে ফোনটা কানের ওপরে চেপে ধরে, বলতে যায় হ্যালো, কিন্তু একি ? কান্নার শব্দ কেন বেরিয়ে আসছে মুখ থেকে ? কেন সামলাতে পারছে না নিজেকে ও আজ ? এতদিন , এতো মাস, এতগুলো বছর পেরিয়ে, আজ ও কেন দুর্বল হয়ে যাচ্ছি আমি ? কোনোরকমে নিজেকে সামলে নেয় স্নিগ্ধা , কেটে যায় প্রায় মিনিট তিনেক। বিতান কি কিছু বুঝতে পেরেছে ফোনের ওদিক দিয়ে ? ও চুপ করে কেন আছে? কিছু বলছে না কেন ? চোখের জল মুছে, স্নিগ্ধা ধীরস্বরে জিজ্ঞেস করে, "কেমন আছো বিতান ? " নিজেকে সামলাতে চাইছে স্নিগ্ধা, তবুও গলা কেঁপে উঠলো। 'বিতান' কথাটা উচ্চারণের সময় গলাতে আকুতি ফুটে ওঠে।
বিতান চুপ করে থাকে। বেশ কিছু সেকেন্ড সময় নিয়ে জিজ্ঞেস করে, "তুমি কাঁদছো স্নিগ্ধা ? "
এখনও বিতান বুঝতে পারে আমার সুবিধে অসুবিধে, ফোনের অন্য প্রান্ত থেকেও ? বারান্দার দরজা বাইরে থেকে ভেজিয়ে মেঝেতে বসে পড়ে স্নিগ্ধা, দেওয়ালে হেলান দিয়ে। বলে ওঠে,"তুমি, তুমি একটা....পাষন্ড, খারাপ লোক, শুওর, ইতর.....বিতান। তবুও, তবুও আমি যে তোমাকেই ভালোবাসি , তোমাকে ছাড়া আমি কেন কাউকে ভালোবাসতে পারছি না ? কেন আমাকে আমাকে অন্যের দরজায় দরজায় ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে , বলতে পারো ? কি অভিশাপ দিয়েছো তুমি আমাকে ? কেন তুমি সেদিন জোরে জোরে আমাকে ঠাস ঠাস করে মেরে আটকালে না ?"
"শান্ত হও স্নিগ্ধা , শান্তি নেমে আসুক তোমার জীবনে, মনে। এটাই তো আমি সবসময় চেয়ে এসেছি। আমি কি তোমার খারাপ চাইতে পারি কখনও ? আমি তোমাকে সেদিন আটকাই নি ; কেন জানো ? আমি তো তোমাকে সবসময় সুখী, খুশি দেখতে চেয়েছি। তোমার সুখেই যে আমার সুখ। " একটু থেমে বিতান আবার বলে ওঠে ,"যাক গে, যা হওয়ার হয়ে গেছে, তাকে আর টেনে কি লাভ। বলো , কেন ফোন করেছো ? "
আর্তির স্বরে স্নিগ্ধা বলে ওঠে,"আমি ফিরতে চাই, বিতান। আমি তোমার কাছে ফিরতে চাই। আমার ছেলে, আমাদের ছেলে, আমাদের দুজনকে ছাড়া সম্পূর্ণ নয়। আমি ভেবেছিলাম আমি একাই সব সামলে নেবো। কিন্তু পারিনি বিতান। তোমাকে দরকার, আমাদের দুজনেরই। আজ, আজ বিকেলে দেখা করতে পারবে ?
একবার, প্লিজ ? আমি জানি, আমি যা করেছি তোমার সাথে, তারপরে তোমার আমার ওপরে রাগ, ঘৃণা, বিতৃষ্ণা সব কিছু করার অধিকার আছে তোমার, তবুও, আমি, আমি আর শৌনক তোমাকে ছাড়া অসম্পূর্ন। ..
বিতান জিজ্ঞেস করে ' কিন্তু কি এমন হলো যে তুমি আবার ফিরতে চাও ? মনে পরে সিগ্ধা তুমি আমাকে তোমার জীবন থেকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলে তুমি চলে যাওয়ার পরে, প্রথম কয়েক মাস, কত রাত আমি না ঘুমিয়ে কাটিয়েছি ! অনেক যন্ত্রনা নিয়ে দিনের পর দিন কাটিয়েছি । জানো আজ আমি চাকরি ছেড়ে কেন ব্যব সা শুরু করেছি ? চাকরিতে থাকলে একটা নির্দিষ্ট সময় শেষে সেই তো ঘরে ফিরে আসতে হতো ! আর এই ফাঁকা শূন্য ঘর, আমাকে খেয়ে ফেলতো প্রতি রাতে। আমি যেন একটা হাহাকার শুনতে পেতাম সবসময়। মাঝে মাঝে এতো একা লাগতো, চেঁচাতে ইচ্ছে হতো। চেঁচিয়েছি জোরে , কিছু একটা বলে , ফাঁকা শূন্য ঘরে সেটাই আবার প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসতো। ভীষণ ভয় পেতাম আমি। ভীষণ। ব্যবসা করতে গিয়ে আজ আমি সবকিছু নিজে সামলাই মার্কেটিং, ফাইন্যান্স, অপারেশন, এইচ আর , সব। তোমাদের ভুলতে নিজেকে কাজের মধ্যে ডুবিয়ে দিয়েছি তবু মাঝে মাঝে, কোনো ছুটির দিনে, অলস বিকেলে তোমাদের কথা আজও ভীষণ ভাবে মনে পরে তুমি চলে যাবার তোমার জায়গাটা আজও কাউকে দিতে পারলাম না।হয়তো এটাই আমার অভিশাপ তোমাকে উজাড় করে প্রচন্ডভাবে ভালোবাসার পরিণাম !! "
যাকগে ছাড়ো শোনো আজ আমার কিছু ইম্পর্ট্যান্ট কাজ আছে, দুপুরে দুটো নাগাদ শেষ হয়ে করতে পারবো। তারপরে, আড়াইটের সময়, আমরা একসাথে লাঞ্চ করতে পারি কি ? তখন আমরা কথা বলি একসাথে? আর শৌনকের তো কয়েকদিন পরে জন্মদিন, ওর তো চাইনিজ পছন্দ ভীষণ, তাই না? ." রেস্টুরেন্টের নাম ঠিকানা দিয়ে দেয় বিতান।
ফোন কেটে দেয় স্নিগ্ধা। কাঁদতে কাঁদতে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায় সামনের দিকে তাকিয়ে। বারান্দায় ওর চোখের ওপরে এসে পড়ছে সূর্যের আলো, মুখ হয়েছে লাল , চোখের জল ঝরছে অঝোর ধারায়। ইচ্ছে করছে, ইচ্ছে করছে বিতানকে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরতে, ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে ওর কাছে,ওর বুকের মাঝে । যে রাস্তা একদিন নিজেই বন্ধ করে দিয়েছিলো স্নিগ্ধা, যে সম্পর্কের মাঝে তুলে দিয়েছিলো একটা সুবিশাল প্রাচীর, আজ তাকেই ভেঙে ফেলে, তছনছ করে আবার নতুন করে সবকিছু গড়তে মন চাইছে খুব। কিন্তু বিতান, ও কি মেনে নেবে ? ও কি এতো কিছু সহ্য করার পরেও টেনে নেবে আমাকে, শৌনক কে ওর বুকে !
একরাশ দ্বিধা আর দ্বন্দ্বের মাঝে দাঁড়িয়ে স্নিগ্ধা, দুপুরের অপেক্ষা।
Comments
Post a Comment