valentines day - true love never dies ...it always says best of me is only YOU


"অনি, আজ বিকেলটা ফাঁকা আছিস? একটা মেডিকেল রিলেটেড প্রোগ্রামের বহুকষ্টে দুটো পাস পেয়েছি। যাবি ভাই?" এক নিশ্বাসে আমায়য় বলে গেল রাহুল কথাগুলো। চেয়ে দেখলাম ওর করুণ চোখদুটোতে কেমন যেন একটা আশার আলো ঝিলিক দিচ্ছে। বুঝলাম ওর পিয়ার জন্য ও কোনো নতুন পথের সন্ধান পেয়েছে। একবাক্যে ঘাড় নেড়ে 'হ্যাঁ' বলে দিলাম। সত্যি সেদিনকার সেই যাওয়াটা লাইফে যে কী মোড় নিতে চলেছিল, তা আদৌ বুঝিইনি তখন।
রাহুল আমার ছোটোবেলাকার অন্তরঙ্গ বন্ধু। বড়ই সাদাসিধে আর সেনসিটিভ প্রকৃতির ছেলে। পিয়ার সাথে ওর আলাপ হয়েছিল বছর চারেক আগে, ক্লাস ১১ এ পড়াকালীন। সেই থেকে ওদের ভালোবাসার পথেরপাঁচালির শুরু। দুজনের লাভস্টোরি কলেজেও বেশ সুপারহিট। সত্যি, বড়ই গভীর ওদের প্রেম।
কিন্তু মাস ছয়েক আগে পিয়া হঠাৎ একদিন অসুস্থ হওয়ায়, সবাই জানতে পারলো ওর হার্টের অবস্থা খুবই খারাপ। ট্রান্সপ্লান্ট করতে পারলে যদি কিছু হয় আরকি। ছোটোবেলা থেকেই নাকি মাঝেমধ্যে ভুগতো ও। কিন্তু এতোটা সিরিয়াস ব্যাপার, তা আগে কোনো ডাক্তারই বলেননি। আর মালদায়ের এক প্রত্যন্ত গ্রামের দিকে থাকায় হয়তো সেভাবে বুঝেও ওঠেনি ওরা। মাধ্যমিকের পরেইতো ওদের এই কলকাতায় আসা। পিয়ার কথাটা জানামাত্র দিবারাত্রি নিদ্রাহীন হয়ে পাগলের মতো মেডিকেল ম্যাগাজিন পড়ে, মেডিকেল প্রোগ্রামে ঘুরে ঘুরে হন্যি হয়ে একটা সুরাহা খুঁজছে রাহুলের অদম্য বিশ্বাসী হৃদয়। হয়তো একেই বলে ব্লাইন্ড লাভ।

কথামতো সেদিন বিকালে দুজনে গেলাম সেই সায়েন্সের দুনিয়ার তারকাখচিত গ্যালারিতে। সে এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা হল সেদিন। পরিচয় হল 'ব্রেনডেথ' নামক শব্দটির সাথে। আরও জানলাম যে মৃত মানুষের অঙ্গপ্রতিস্থাপনে কী করে ম্যাক্সিমাম পাঁচজন মূমূর্ষ মানুষ জীবন নামক শব্দটি উপহার পেতে পারে। কিছু মানুষ তাদের জীবনের অভিজ্ঞতা শেয়ার করলেন। যেমন একজন কর্পোরেট লেডি বললেন তার স্বামীকে যখন দেশের প্রায় সব নেফ্রোলোজিস্ট জবাব দিয়ে দিয়েছিলেন, ঠিক তখনই কত ঝড়ঝাপটার মধ্য দিয়ে উনি আবার নতুন ভোরের সূর্য দেখেছিলেন, একজনের শরীরের কিডনি ওনার স্বামীর শরীরে ট্রান্সপ্লান্ট করিয়ে। আরেকটি গ্রাম্য মেয়ে তার শহুরে সাহসী গলায় বলছিল তার মৃত্যুঞ্জয়ী কাহিনী। আর এক সদ্য বাবাকে হারানো ছেলে শ্রদ্ধায় গর্বে বলছিল, "আমার বাবা সারাটা জীবন নিজের কর্মস্থলের পাশাপাশি বাকি সময়টুকু পরের জন্য কিছু না কিছু করায় ব্যস্ত থাকতেন। তাই হয়তো ওনার একদিন অফিস হতে ফেরার পথে যখন ক্রমশ কোলাপ্স হয়ে যাচ্ছিলো অঙ্গগুলো, তখনও তার শেষ ইচ্ছানুযায়ী ওনাকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছি আমরা। সেটা শুধু কয়েকজন মানুষের শুধু শারীরিক অংশ হয়ে নয়, তাদের জীবনের নতুন সূর্যোদয়ের সঙ্গী হয়ে।" এসব স্পিচে পুরো গ্যালারি হাততালিতে মুখরিত হয়ে উঠছিল। কম বেশি আবেগতারিত হয়ে পরেছিলাম আমরা সকল শ্রোতাই। ফেরার পথে দুজনেই বাকরুদ্ধ ছিলাম। রাহুল একবার শুধু আবেগময় কণ্ঠে বলে উঠল " আমি পিয়াকে ভালোবেসেছি, আমৃত্যু একসাথে থাকার স্বপ্ন নিয়ে। তাই আমাদের ভালোবাসাটাকেও দীর্ঘজীবী দেখতে চাইরে। কিন্তু তাই বলে কারো মৃত্যু আমার কাম্য নয়।" বলে কিছুক্ষণ চুপ থেকে একটা আস্তিক দীর্ঘশ্বাসের সাথে বলল "শুধু তার উপরই ভরসা, যে সব জন্ম মৃত্যুর হিসেবের মালিক ... ", বলে অশ্রুভেজা চোখে আকাশের দিকে তাকালো ও এক অচেনা অদৃষ্টের খোঁজে।
এদিকে পিয়ার অবস্থা এতোটাই খারাপ যে হসপিটালে ভর্তি করাতে হল। সেদিন ছিল ৩১শে জানুয়ারি, পিয়ার জন্মদিন। রাহুল ওদের ভালোবাসার এক একটা স্মৃতি কুড়িয়ে জড়ো করেছিল ওর ভালোবাসার অনুভূতিগুলোকে আপ্রাণ নিংড়ে। পিয়া ফ্যাকাসে চেহারায় ম্লান হাসিতে বলছিল " আরো চোদ্দটাদিন আমি বাঁচবই। এই স্পেশাল ভ্যালেন্টাইনসডেতে তোর প্রোপোজের পাঁচ বছর পূরণ হবে। তার আগে মরছিনা .."। আর দাঁড়াতে পারেনি রাহুল। মুখে চিৎকার করে বলতে বলতে বেরিয়ে গেছে সে তখন "দেখি কী করে যাস আমায় ছেড়ে ...?"
দুদিন পরে পিয়ার অবস্থার অবনতিতে আই. সি. ইউ. তে নিয়ে যাওয়া হয় ওকে। সেদিন রাহুলের পাশে থেকে আমিই যেন আর নিজেকে সামলে উঠতে পারছিলাম না। দিনগুলো কেমন যেন এক একটা নিভন্ত আশার আলো জ্বালছিল। এমনসময় তৃতীয়দিনে সন্ধ্যায় হঠাৎ একটা ফোন এলো রাহুলের ফোনে। কী যে কথা হল বুঝে ওঠার আগেই ও পাগলের মতো আমায় নিয়ে ছুট লাগালো মেডিকেলে। সেখানে গিয়ে জানলাম, একজন অল্প বয়সী মেয়ের ব্রেনডেথ হয়েছে। হার্ট ট্রান্সপ্লান্টেশনের জন্য মেডিকেল টিম যাবে আমাদের সাথে, পিয়ার জন্য। আমি মূহূর্তে স্তব্ধ। সেই অনুষ্ঠানের দিনই, রাহুল ওখানে সব ইনফরমেশন দিয়ে এসেছিল। সেই সূত্রেই নাকি ওদের আজকের ফোন। বলে বোঝানো যাবেনা, যে কী মারাত্মক মানসিক উদ্বেগে কেটেছিল পরবর্তী সময়টুকু। তারপর বিজ্ঞানের চমৎকৃত সাফল্যে নবজন্ম পেল আমার বন্ধুর ভালোবাসা।
অত:পর আমি সাক্ষী হয়ে রইলাম জীবনের অবিস্মরণীয় এক মূহূর্তের। যেদিন ভালোবাসার রঙে রঙিন হয়ে গিয়েছিল হসপিটালের পুরো রুমটা। আর রাহুল একটা আংটি এনে ডাক্তার, নার্স আর দুপরিবারের সবার সামনে পিয়ার বাহাতের অনামিকায় পরিয়ে দিয়ে বলল "হ্যাপি ভ্যালেন্টাইনসডে মাই লাভ"। সবার চোখে তখন চিকচিক করছে বিজয়াশ্রু। ঠিক তখনই দরজার পাশে একটা লাল গোলাপের বোকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল এক বছর ত্রিশের যুবককে। জানতে পারলাম, পরিচয়ে নাকি সে হার্ট ডোনারের প্রেমিক ছিল। তার ভালোবাসার হৃদয়টির দীর্ঘ ভালোবাসাপূর্ণ নবজীবনের কামনায় আজ এখানে হাজির হয়েছে সে। অত:পর ডাক্তারবাবু এগিয়ে এসে স্টেথোস্কোপটা তার কানে লাগিয়ে পিয়ার হার্টবিটটা শোনালেন।

পিয়ার অন্তরস্থ হৃদয়টির অতীত ও বর্তমান, দুই প্রেমিকই তখন আবেগে অশ্রুস্নাত। পিয়া রাহুলকে চোখের ইশারায় কিছু বলতে যাবে, এমনসময় নিজের গিটারটা হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে গেয়ে উঠল রাহুল
'অর আহিস্থা কিজিয়ে বাতে, ধড়কনে কোয়ি শুন রাগা হোগা।
লবস গিড়নে না পায়ে হোটোসে, বক্ত কি হাত ইনকো চুনলেঙ্গে, কান রাখতে হ্যায় ইয়ে দরো দিবার, রাজ কি সারি বাত শুন লেঙ্গে।
অর আহিস্থা কিজিয়ে বাতে...'
পিয়ার দুর্বল কণ্ঠের ছান্দিক মৃদু সুরও তখন আত্মগোপন করল সেই গানের কলির মধ্যে।

Comments