তুমি আমার মা, আমি তোমার মেয়ে। বলো না মা কি পেয়েছ আমায় কোলে পেয়ে- mother and daughter together they complete Cycle of LIFE


শ্রাবন্তী
তুমি আমার মা, আমি তোমার মেয়ে।
বলো না মা কি পেয়েছ আমায় কোলে পেয়ে-
মা গো আমায় কোলে পেয়ে?
তুমি আমার মা, আমি তোমার মেয়ে।
বলো না মা কি পেয়েছ আমায় কোলে পেয়ে-
মা গো আমায় কোলে পেয়ে?
সন্ধ্যা
যেদিন আমার কোলে এলি, প্রথম হলাম মা-
আঁতুরঘরে শাঁখটা সেদিন কেউ বাজাল না।
বলল সবাই, “মেয়ে হল, হল না তো ছেলে!” ঠানদি একাই উলু দিল সবাইকে ফেলে।
শুধু ঠানদি একাই উলু দিল সবাইকে ফেলে।
শ্রাবন্তী
তুমি আমার মা, আমি তোমার মেয়ে।
দুঃখ শুধুই পেলে কি মা তুমি আমায় পেয়ে?
বাবার ভাগ্য যখন বদলে গেল আমার আসার পরে-
বলল সবাই লক্ষ্মী আমি এসেছি সংসারে।
পৃথিবীতে সবাই যা চায় তুমিও তাই পেলে।
মেয়ে হয়েও সবই দিলাম, নাই বা হলাম ছেলে।
আনন্দ কি পাও নি তুমি আমায় বুকে পেয়ে?
মাগো, আনন্দ কি পাও নি তুমি আমায় বুকে পেয়ে?
সন্ধ্যা
ওরে আমার মেয়ে, আমার সোনা মেয়ে।
মেয়ে যে তুই, লালন শুধুই-
করছি আমি রে,
পরের ঘরে যাওয়ার জন্যে, তাকি বুঝিস নে?
সময় হলেই এঘর ছেড়ে যাবি রে তুই চলে।
থাকবি না রে চিরটাকাল তোর মায়ের এই কোলে।
শ্রাবন্তী
ভাবছ কেন মা, আমি বলছি তোমার মেয়ে-
পরকে আপন করব আমি তোমার আশিষ পেয়ে।
মাগো তুমিও তো মা এসেছিলে তোমার মাকে ছেড়ে।
শুভদিনে স্বামীর হাতে সোহাগ সিঁদুর পড়ে।
তোমায় নিজের ঘরে পাঠিয়েছিলেন তোমারও সেই মা।
বলেছিলেন এমন মেয়ের হয়না তুলনা।
তেমনি করেই নিজের ঘরে দিও মা পাঠিয়ে।
আমায় এমনি করেই নিজের ঘরে দিও মা পাঠিয়ে।
সন্ধ্যা
ওরে আমার মেয়ে, মিষ্টি সোনা মেয়ে।
নতুন যুগের মেয়ে রে তুই, বলব তবু আমি।
ভালবাসার চেয়ে আজো নেই তো কিছুই দামী।
যুগটা না হয় পালটে গেছে, বদলে গেছে কাল।
তবু সুখী মেয়ের সিঁথির সিঁদুর তেমনি আছে লাল।
শ্রাবন্তী
যেন তোমার কথাই রাখতে পারি ফোটাই তোমার হাসি।
কাউকে যদি ভালই বাসি সত্যি যেনই বাসি।
জীবন-মরণ দিয়ে যেন চাইব ভাল তার।
স্নেহ মায়া মমতাতে জড়াব সংসার।
ওগো আমার মা তোমায় কথা দিল মেয়ে-
সুখী করেই সুখী হব মনের মানুষ পেয়ে।
হাতটা তোমার দাও না মাগো আমার মাথায় ছুঁয়ে।
ওই হাতটা তোমার দাও না মাগো আমার মাথায় ছুঁয়ে।
সন্ধ্যা
ওরে আমার মেয়ে, আমার পাগল সোনা মেয়ে।
শ্রাবন্তী
ওগো আমার মা, তোমার নেই যে তুলনা।
সন্ধ্যা
ওরে আমার মেয়ে, আমার মিষ্টি সোনা মেয়ে।
শ্রাবন্তী
তুমি আমার মা, আমি তোমার মেয়ে-
আজকের গল্প মা ও মেয়ের চিরন্তন সম্পর্ককে কেন্দ্র করে 

কান পাতে অলকানন্দা মা শ্রীকৃষ্ণের অষ্টত্তর শতনাম পড়ছে,' 
কৃষ্ণ ভজিবার তরে সংসারেতে আইনু 
মিছা মায়ায় বদ্ধ হইয়া বৃক্ষসম হইনু।
ফলরূপ পুত্র কন্যা ডাল ভাঙ্গি পড়ে
কালরূপ সংসারেতে পক্ষ বাসা করে।'
      হঠাৎই মনে পড়ে যায় আজ তো মাদার্স ডে।
মাদার্স ডের ইমেজ আর কোটসে ছয়লাপ ফেসবুক। ছোটবেলায় মাদার্স ডে জানতো না অলকানন্দা,তবে শুধু জানতো মায়েদের কোন বাড়ী হয়না। হয়ত বা হয়না মায়েদের পছন্দের কোন খাবারও। ছোটবেলায় খেতে বসে প্রায়ই বায়না করতো খাওয়া নিয়ে,মা চেষ্টা করতেন এটা ওটা রান্না করে সামাল দিতে। যেদিন বেশ তৃপ্তি করে খেতো,একটা তৃপ্তির হাসি হেসে মা বলতেন," কি খাবি বলবি আমি রান্না করে দেবো,আমি তো ভুলেই গেছি কি খেতে ভালোবাসতাম ছোটবেলায়। বিয়ের পর ও বাড়িতে গেলেই মা তোর বাবার পছন্দমত রান্নাই করতো। না না একেবারে খাইনি বললে ভুল হবে তুই আর বাবু হবার সময় বেশ কিছুদিন ছিলাম মায়ের কাছে তখন বাবা আর মা বলতেন কি খেতে ইচ্ছে করে,যা বলতাম মা রান্না করে দিতো। যদিও বৌদি বিরক্ত হত বুঝতাম।"
      মনে মনে অলকানন্দা ভাবতো,ও যখন বড় হবে চাকরি করবে তখন মাকে খাওয়াবে মায়ের পছন্দের রান্নাগুলো। প্রতিদিন একবার জিজ্ঞেস করে নেবে কি খাবে মা?ঠাকুমাকে মাঝে মাঝেই বলতে শুনতো,এ কেমন তোমার কাজের ছিরি বৌমা,কতদিন বলেছি এ বাড়িতে এসব চলবেনা। মাথা নিচু করে মা বলতো,ঠিক আছে মা আর ভুল হবেনা। কখনো ছোট অলকা আর বাবুকে খাওয়াতে খাওয়াতে চোখটা ছলছল করতো মায়ের। না বুঝেই ও বলতো,' মন খারাপ কোরোনা মা,তোমার মায়ের কাছে যাবে? বাবাকে বলবো?' মা চোখ মুছে হেসে বলতেন," বোকা মেয়ে আমার।" ছোটমেয়েটা তখন বুঝতেই পারেনি বিয়ের পর মায়ের বাড়িটা মেয়েদের আর নিজের বাড়ি থাকেনা। ঠাকুমা মারা যাবার পর একদিন হঠাৎ বাবাকেও বলতে শুনলো," এই যে শোনো সংসারে হাড়ি ঠেলা ছাড়া আর তো কোন কাজে লাগলেনা,কি করে যে এতো খরচ সামলাই তা আমিই জানি। কোথায় টাকা পাও বোনকে নিয়ে আদিখ্যেতা করার জন্য,নিজের বাড়ি সামলে এতো দিকে আর সামলাতে পারবোনা।"
খুব খারাপ লেগেছিলো,ভেবেছিলো না না ওকে একটা কিছু করতে হবে। মায়ের মত ওকে যেন কেউ বলতে না পারে আমার বাড়িতে এসব চলবেনা। কেমন আশ্চর্য লাগতো মাকে দেখে,মায়ের জীবনে রান্নাঘর আর ঘর গোছানো পূজো করা এসব ছাড়া তেমন কিছু ছিলোনা।
তবুও অলকানন্দার জীবনেরও স্বপ্ন পূরণ হোলোনা, দাদা তখন পড়ছে। অলকানন্দা বি.এ পরীক্ষা দিয়েছে,হঠাৎই বাবার ব্যবসার অবস্থা খারাপ হওয়াতে বাবা পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন,আর পড়াতে পারবেননা ওকে,কারণ ছেলেকে পড়াতেই হবে। আর ওর তেমন কোন ভবিষ্যতও নেই। তাই বিয়ে হয়ে গেলো অলকানন্দার। আপত্তি করাতে শুনেছিলো বাবার কাছে,' আমার বাড়িতে এসব অবাধ্যতা চলবেনা। যদি না পোষায় নিজের ব্যবস্থা নিজে করে নাও।' স্বপ্নগুলো সব অধরাই রয়ে গেলো,দাদাকে পড়াশোনার সুযোগ করে অলকানন্দা কণকাঞ্জলি দিয়ে নিজের ঘর খুঁজতে বেরোলো। মাকে নিজের বাড়ি আর নিজের পছন্দমত খাবার খাওয়ানো আর বোধহয় হবেনা। ছোটবেলার সব কথাগুলো রূপকথার মতো মিথ্যেই রয়ে গেলো।
           কে জানে শুধু মা বোধহয় বুঝেছিলেন ওর কষ্টটা,তাই বাবার কথা শুনে যখন কান্নায় আর অভিমানে মায়ের কোলে মাথা রেখে ফুঁপিয়েছিলো। এক আপোশ করা খাঁচায় বন্দী নারী আরেকজনকে বলেছিলো,' এমনই রে মেয়েদের জীবন,একদিন আমাদেরই ভুলে যাবি। হয়ত সময়ই পাবিনা এই বাড়িতে আসার স্বামী সংসার সামলে।'
       দুঃখ ভোলাতে স্বপ্নের কাজল পরিয়ে দিয়েছিলেন অলকার চোখে মা।
    শ্বশুর বাড়ির জানালার পর্দায় স্বপ্নের আঁকিবুকি কেটেছিলো অলকানন্দা। ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখতো সুন্দর সুন্দর ফুল। ছোটবেলায় খেলনাবাটি খেলতে খেলতে বড় হয়ে হয়ত সত্যিকারের রান্নাঘরটাকেও বেসেছিলো ভালো। সত্যিই তাই সময়ই পায়না মায়ের কাছে যাবার একদম। কলকাতা থেকে দিল্লীতে চলে এসেছে অলকানন্দা। তবে যখন পাঁচবছরেও ওর কোন সন্তান এলোনা,তখন একটু বেশিই ঘনিষ্ঠ হয়ে পরলো ওর স্বামী নিশার সঙ্গে। প্রশ্ন করে উত্তর পেয়েছিলো,আমার বাড়িতে আমি যা খুশি করবো। খাচ্ছো,দাচ্ছো,দামী শাড়ী ড্রেস পাচ্ছো এতেই খুশি থাকো। কি গুণ আছে তোমার?"
আবারও একবার বুঝেছিলো অলকা এই বাড়িটাও ওর নিজের বাড়ি নয়।
      সত্যিই তো গুণও নেই আর যাবার যায়গাও নেই এর মাঝে দাদারও বিয়ে হয়ে গেছে। আর দাদার বিয়ের কিছুদিন পরেই মারা গেলেন বাবা। মা হয়ত এখন আরো বেশি বোঝা সংসারের। আগের মত তেমন কাজও করতে পারেনা মা। মাঝে মাঝে অলকানন্দাই ফোন করে,সব কথা হয়ত ভালো করে বলতে ও পারেনা মা। এরমাঝেই একদিন শুনলো দাদা খুব চাপ দিচ্ছে বাড়িটা ওর নামে করে দেবার জন্য। সমাধান ওরা মা মেয়ে মিলেই করেছিলো দাদাকে বাড়িটা লিখে দিয়েছিলো মা। সুখের চেয়ে স্বস্তি ভালো।
      এর মাঝেই অলকানন্দার বিয়েটা ভেঙে গেলো,উপায় ছিলোনা ডিভোর্স পেপারে সই না করে। সত্যিই আর পারছিলোনা অলকা। বাপের বাড়ি না দাদার বাড়ি চলে এলো অলকা। অনেকদিন বাদে আবার কলকাতায়,নিজের পুরোনো শহরে। মায়ের ঘরটা আর মায়ের নেই,ওদের ছোট্ট স্টোররুমটায় মা এখন থাকে। অবাক হলো অলকা,দাদাকে জিজ্ঞেস করাতে উত্তর পেলো,আমাদের এখন সংসার বড় হয়েছে। বাড়িতে লোকজন আসে ঘরের দরকার। মা কি করবে অত বড় ঘর নিয়ে। অলকাও স্বত্ব হারিয়েছে,এ বাড়িটা যে ওর আর মায়ের কারো নয়। তাই মায়ের ঘরেই অনেকদিন বাদে মায়ের একদম কাছে শুয়ে ছোটবেলার সেই মিষ্টি গন্ধটা পেলো। একসময় জিজ্ঞেস করতো মা তুমি গায়ে কি মাখো গো?
           একটা কাজের খোঁজে তখন দিশাহারা হয়ে ঘুরছে অলকানন্দা,যা হোক একটা কাজ। মেয়েদের যে নিজের পায়ে দাঁড়ানো কত জরুরী সেটা অনুভব করে কষ্ট পায়,দিশাহারা লাগে। হঠাৎই দেখা হয়ে যায় তুলির সাথে,ওর সাথে পড়তো। হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় ওকে বাড়িতে কত গল্প হোলো। অবাক হয়ে যায় অলকা বিয়ে করেনি তুলি,মা আর মেয়ে থাকতো। মা মারা যাবার পর এখন একা। হঠাৎই বলে,' কি করছিস? কাজ করবি? তুই তো খুব ভালো সেলাই করতিস আর ছবি আঁকতিস,এখন করিস না?সত্যিই তো একটা কাজের খুব প্রয়োজন তার,তুলিকে বলতে পারেনি সে কথা। সত্যি কি ভালো আছে তুলি!আসলে ওকে তো কেউ বলেনা আমার বাড়িতে এসব চলবেনা। তুলির নিজের একটা বাড়ি আছে।
       তুলির উদ্যোগে কিছু গয়না বিক্রী করে,তুলির সাথেই শুরু করলো হস্তশিল্পের ব্যাবসা। কিছু করতে পারলো অলকানন্দা,ওর স্বপ্ন সত্যির পথ দেখালো তুলি। এই কয়েকবছরে দাদার কাছে অনেকবারই শুনেছে,সারাদিন বাড়িতে থাকিসনা সংসারের কোন কাজে লাগিসনা এইসব আমার বাড়িতে চলবেনা। একটা অপদার্থ! না করলি সংসার,না হোলো পড়াশোনা।সহ্য করলো অলকা নিরুপায় হয়ে।কাঁদলো মা আর মেয়ে দুজনে দুজনকে জড়িয়ে,সত্যিই তো ওদের নিজের বাড়ি নেই। তাই কখনো শাশুড়ি,কখনো স্বামী আবার কখনো আত্মজর কাছে শুনতে হয় জীবনের প্রতি ধাপে,আমার বাড়িতে এসব চলবেনা।
          মায়ের হাত ধরে অলকানন্দা চলে এসেছিলো ওদের বাড়িতে মানে যেখানে শুধুই থাকবে ও আর মা,অনেক কষ্টে অনেক লড়াইয়ে মাকে দিতে পেরেছে এমন একটা বাড়ি যেখানে কেউ বলতে পারবেনা আমার বাড়িতে এসব চলবেনা। এক কামরার ফ্ল্যাট,একটাই ঘর সেখানে তবুও শান্তির নীড় আর সেটাই অলকানন্দার স্বপ্ন দেখার একটুকরো আকাশ। সত্যিই মাদার্সডের কথা ভাবতে ভাবতে কোথায় যে হারিয়ে গিয়েছিলো মনটা। রান্নাঘরে গিয়ে আজ ফুলকো লুচিটা ভেজে প্লেটে সাজায় অলকানন্দা। মায়ের পছন্দের ভুলে যাওয়া পুরোনো রান্নাগুলো আবার মনে পড়েছে মায়ের, এক একদিন একেকটা রান্না হয়। ব্যাচেলর লাইফ এনজয় করো মা আবার সুখি থেকো নিজেকে নিজের ইচ্ছেমতো রেখে। মা দিবসে একটু মুক্তির স্বাদ নাও তোমার স্বপ্নের পৃথিবীতে। মনে মনে বলে অলকানন্দা। জানেনা মা কতটা খুশি এ জীবনে,আসলে খাঁচাবন্দী পাখি কখন যে খাঁচাটাকেই খোলা আকাশ ভেবে নেয়।
         পূজো সেরে উঠে এসেছে মা, মাকে প্রণাম করে পরম আশ্রয়ে মায়ের ঘাড়ে মাথাটা রাখে পরম তৃপ্তিতে। মনে মনে বলে,'আছি গো মা,অনুভব করি তোমায়,ভালো রাখতে চাই তোমাকে। শুধু মাদার্স ডে নয় ভালো থাক আর সম্মানিত হোক মায়েরা বাকি তিনশো চৌষট্টি দিনেও। সন্তানের কাছে সব দিনগুলোই হোক মায়েদের একটু ভালো রাখার দিন। অক্লান্ত পরিশ্রমের ফাঁকে একটু সহানুভূতির স্পর্শ মাখিয়ে দিলে ক্ষতি কি? ফেসবুক স্ট্যাটাসে মাকে রাখার সাথে সাথে মণের মণিকোঠায় যত্নে থাক মায়েরা একটু ভালোবাসায় আর সহানুভূতিতে।

Comments