জীবন সংগ্রাম ও ভালোবাসা - love is all about staying beside the loved one in every steps of life
জীবন সংগ্রাম ও ভালোবাসা
একটু বেলা করেই ঘুমটা ভাঙ্গল। ভোর রাতে বাড়ি ফিরেছে ছেলেটা। সারাদিনের হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর শরীরটা আর সায় দেয় না। ক্লান্ত বিধ্বস্ত শরীরটা তখন ঐ একটুকরো বিছানাকে খুঁজে বেড়ায়। ছেলেটা যখন কাজের মধ্যে থাকে তখন এক মুহূর্ত দম ফেলার সময় পায় না। নাঃ, আর দেরি করা ঠিক হবে না। দ্রুত তৈরি হতে হবে। দুপুর একটার মধ্যে আবার কাজে যোগ দিতে হবে। সারাদিনের অমানুষিক খাটা খাটুনির পর আবার ভোর রাতে বাড়ি ফেরা। আবার পরদিন বেলা করে ঘুম থেকে ওঠা। তারপর দ্রুত তৈরি হয়ে নিয়ে আবার কাজে যোগ দেওয়া। আগামী কয়েকটা দিন এভাবেই চলবে সৌম্যর। পুরোনাম সৌম্যজিত সাহা, মৃদুভাষী , মেধাবী কলেজের পাশাপাশি সৌম্য পার্ট টাইমে একটি সংস্থায় কর্মরত।। মা-ছেলের ছোট্ট একটা অভাবের সংসার। মাত্র মাস দুয়েক হয়েছে এ কাজে সে জয়েন করেছে। পাশাপাশি সে সমান গুরুত্ব সহযোগে নিজের পড়াশোনাটাও চালিয়ে যাচ্ছে। মেধাবী ছাত্র। কাজটা না করলে সৌম্যকে পড়াশোনায় ইতি টানতে হত। উঁচু ক্লাসের পড়াশোনায় খরচের যা বহর, তাতে সৌম্যর এই কাজটা খুবই প্রয়োজন ছিল। এহেন সৌম্য আবার একটি সম্পর্কে জড়িয়ে পরেছে। মেয়েটি সৌম্যর সঙ্গে একই কলেজে পড়াশোনা করে। তবে সে সৌম্যর থেকে ২ বছরের জুনিয়র। নিজের পারিবারিক এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থার কথা ভেবে প্রথমদিকে সৌম্য এই সম্পর্কের বিষয়ে একটু নিমরাজি ছিল। তারপর যত সময় গড়িয়েছে বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত এবং টানাপড়েনের মধ্যে দিয়ে সম্পর্কটা পরিশেষে একটা মান্যতা পেয়েছে। তাদের দুজনের কথাবার্তা, ঝগড়া, মান-অভিমান, খুনসুটি যাবতীয় কিছু কলেজ ক্যাম্পাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কারন অভাবী সৌম্যর ইচ্ছা থাকলেও তার প্রেয়সীকে বাইরে কোথাও নিয়ে গিয়ে একটু নিরিবিলি সময় কাটাবে সেরকম বিলাসিতা করার মত আর্থিক সামর্থ্য ছিল না। অর্থাৎ সাধ থাকলেও সাধ্য ছিল না বেচারার। সে বহুবার চেষ্টা করেও তার এই অসহায়তার কথা নিলাঞ্জনাকে বলতে পারেনি। প্রতিবারই বলতে গিয়ে মনের মধ্যে কোথাও যেন একটু কুণ্ঠাবোধ হত। নিলাঞ্জনাও সৌম্যর মনের এই অসহায়তার কথা কোনদিন সেভাবে টের পায়নি। সেও অতশত না বুঝে কখনই সৌম্যকে বাইরে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করেনি। বরং সে নিজেও ক্যাম্পাসের মধ্যে মেলামেশা করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ ও নিরাপদ বোধ করত। নিলাঞ্জনার প্রায় সব বন্ধু বান্ধবীরাই একটু আধটু প্রেম টেম করে। ওদের কাছ থেকেই শোনা, বাইরে প্রেম করার অনেক হ্যাপা। কোথাও একটু নিরিবিলি বসে হয়ত গল্প করছে, ব্যাস আশপাশ থেকে জুটে যাবে কিছু বদ ছেলেপুলে। তারপর শুরু হয়ে যাবে তাদের উৎপাত। টাকা দাও নাহলেই বিভিন্ন ভাবে হেনস্থা করবে। কোথাও কোথাও আবার পুলিশের ভয়ও থাকে। তাই প্রেম করার জন্য কলেজের এই ক্যাম্পাসটাই অনেক ভাল। চারপাশে সারাক্ষন বন্ধুবান্ধবরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। তাই এখানেই নিলাঞ্জনা সব থেকে বেশি স্বাচ্ছন্দ এবং নিরাপদ।
সৌম্যকে নিলাঞ্জনা ভীষণ ভালবাসে। ওর আচার ব্যাবহার, ভদ্রতা সর্বোপরি ওর মেধা নিলাঞ্জনাকে বেশ আকর্ষণ করে। নিলাঞ্জনা জানত সৌম্য পড়াশোনার পাশাপাশি কোথাও একটা চাকরি করে। কিন্তু কোথায় করে, কি করে, কত পায় এ ব্যাপারে জানার নিলাঞ্জনার খুব একটা আগ্রহ ছিল না। কিন্তু এবার সেই মিষ্টিমধুর সম্পর্কটায় একটু তাল কাটল। কারনটা আর কিছুই নয়। এই প্রথম নিলাঞ্জনা সৌম্যর কাছে কিছু আবদার করেছিল। খুবই সামান্য ছিল সে চাহিদা। পুজোর পাঁচটা দিন সে সৌম্যর সাথে ঘুরবে। নিরিবিলি কোথাও বসে একটু গল্পগুজব করবে। রেস্তরায় বসে ভালমন্দ খাওয়াদাওয়া করবে। এই প্রথম ওরা একটু বাইরে ঘুরবে। অনেকদিন ধরেই নিলাঞ্জনা এই স্বপ্নটা মনের মধ্যে লালন পালন করে চলেছে।ব্যাপারটা জানলে সৌম্যও নিশ্চয় খুব খুশিই হবে! কিন্তু বিষয়টা সৌম্যকে বলতেই নিলাঞ্জনা বেশ বড়সড় একটা ধাক্কা খেল।
-- সরি নিলু (এ নামেই সৌম্য ওকে ডাকে)! আমার যাওয়া হবে না।
-- কেন!
-- ঐ সময় অফিসে আমার অনেক বেশি কাজ থাকবে।
নিলাঞ্জনা আকাশ থেকে পড়ল। অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল –
-- কাজ! তখন তো তোমার অফিস ছুটি থাকবে।
-- না, আমাদের ছুটি নেই।
-- আমি কখনই তোমার কাছে জানতে চাইনি, তুমি কোথায় চাকরি কর, কি কাজ করো। আজ জানতে ইচ্ছা করছে, তুমি কি এমন অফিসে চাকরি কর যে, পুজর সময়ও তোমার অফিস খোলা!
-- হ্যাঁ মানছি, পুজোর সময় অফিস কাছারি বন্ধ থাকে এটা সত্যি। কিন্তু তাই বলে সবকিছু বন্ধ থাকে না। তুমি কি দেখেছ পুজোর ঐ পাঁচটা দিন রেলের পরিষেবা বন্ধ আছে? তুমি কি দেখেছ ঐ পাঁচটা দিন হাসপাতাল বন্ধ আছে। তুমি কি দেখেছ ঐ পাঁচটা দিন পুলিশ বাড়িতে ঘুমায়? তুমি কি দেখেছ ঐ পাঁচটা দিন বিদ্যুৎ পরিষেবা বন্ধ আছে? এরকম আরও অনেক উদাহরণ আছে নিলু!
-- কিন্তু যেগুলোর কথা তুমি বললে, তার কোনটাতেই নিশ্চয় তুমি চাকরি কর না? তাহলে!
-- অত কৌতূহল ভাল নয়?
সৌম্য আর কোনো কথা না বাড়িয়ে কৌশলে বিষয়টা এড়িয়ে গেল। এরপরেও নিলাঞ্জনা বহুবার সৌম্যকে বোঝাবার চেষ্টা চালিয়ে গেছে। কিন্তু প্রতিবারই সে আশাহত হয়েছে। নিলাঞ্জনা ভীষণভাবে ভেঙ্গে পরেছে। ওর এতদিনকার একটা ছোট্ট স্বপ্ন নিমেষের মধ্যে চুরমার হয়ে গেল। সে এখন কি বলবে, কি করবে কিছুই ভেবে উঠতে পারছে না। পাশাপাশি নিলাঞ্জনার মনের মধ্যে তৈরি হল একটা অজানা আশঙ্কা! সত্যিই তো! সৌম্য কি এমন কাজ করে যেখান পুজোর সময়ও ছুটি থাকে না! না কি ওসব ওর মিথ্যে বাহানা! ও অন্য কারও সঙ্গে কোনরকম সম্পর্কে জড়িয়ে যায়নি তো? কিন্তু সৌম্য তো সেরকম ছেলে নয়! তাহলে সৌম্য কি আমাকে কিছু লুকাচ্ছে? ইত্যাদি... ইত্যাদি.........
নিলাঞ্জনার মন মেজাজ একদম ভাল নেই। আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবের সাথে কথা বলতে গেলেও সামান্য বিষয়ে মেজাজ হারাচ্ছে। সারাটাদিন গুমরে গুমরে থাকে মেয়েটা। ঠিকমত স্নান-খাওয়াদাওয়া হচ্ছে না। ছোট ভাইয়ের সাথেও থেকে থেকে দুর্ব্যবহার করে ফেলছে। যে কিনা নিলাঞ্জনার সব থেকে প্রিয় মানুষ। বিষয়টা বাবার চোখকে এড়াতে পারল না। বাবা তার একমাত্র মেয়ে কে ভীষণ ভালবাসে। মেয়ের এই হঠাৎকরে বদলে যাওয়া, ওর এই ঔদাসিন্য বাবাকে বিচলিত করল। মেয়ের সাথে কথা বলতে হবে। কিছু সমস্যা হয়ে থাকলে ওর মনটাকে হাল্কা করতে হবে। একদিন বাবা একলা ঘরে চুপিচুপি মেয়ের কাছে এসে মাথায় স্নেহের হাত রেখে বলল -
-- কিরে, কি হয়েছে তোর?
-- কিছু না।
-- উঁহু, তা বললে হবে? কিছু তো একটা হয়েছে নিশ্চয়! সারাটাদিন এভাবে গুমরে থাকিস কেন ?
-- বলছি তো কিছু হয় নি?
-- কোন বন্ধুর সাথে ঝগড়া হয়েছে?
-- বাবা, প্লিজ! সত্যি বলছি আমার কিছু হয়নি।
-- আচ্ছা ঠিক আছে। এই শোন পুজোর কটা দিন আমরা যদি বাইরে ঘোরাঘুরি করে রাতের ডিনারটাও বাইরে সারি, তাহলে কেমন হয় বলতো?
মেয়ে চুপ। ফলে বাবার এই প্রস্তাবে মেয়ের সম্মতি অসম্মতি কিছুই বোঝা গেলনা। আরও দুচারটা কথাবার্তার পর বাবা বিদায় নিল। একদিন দুদিন করে ধীরে ধীরে পুজটাও এসে গেল। চারিদিকে আলোর রোশনাই, হৈচৈ। একটা খুশি খুশি ভাব। কিন্তু নিলাঞ্জনার মনে শান্তি নেই। সৌম্য এখন কি করছে, কোথায় আছে? কেন সে আমায় রিফিউজ করল? ও অন্য কোনো মেয়ের সাথে ঘুরতে বের হয়নি তো! ইত্যাদি নানান কুচিন্তা নিয়ে মেয়েটা ঘরেই বসে রইল। কয়েকজন বন্ধু ওকে ডেকেছিল। সবাইকেই ও না বলে দিয়েছে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে নিলাঞ্জনা আপন মনে নিজের মোবাইল ফোনটা ঘেঁটে যাচ্ছে। এখন এইটাই ওর সর্বক্ষণের সঙ্গী বলা যায়। বন্ধুরা সব ঘুরতে বেড়িয়ে বিভিন্ন ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করে যাচ্ছে। আর নিলাঞ্জনার সেগুলো দেখেই সারাটাদিন কেটে যায়। এভাবেই একদিন ফেসবুকে এক বন্ধুর প্রোফাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতে একটা ছবিতে নিলাঞ্জনার চোখ আটকে যায়। তাড়াতাড়ি উঠে বসে নিলাঞ্জনা। একি! এটা কি দেখছে সে! ছবিটাকে জুম করল। হ্যাঁ সে ঠিকই দেখছে। এই দেখাতে কোনো ভুল নেই তার। ছবিটা দেখে নিলাঞ্জনা কষ্ট পেল। নিজের অজান্তেই তার দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। এবার নিলাঞ্জনা সরাসরি ফোন করল সেই বন্ধুকে যার প্রোফাইলে সে ছবিটা দেখেছিল। কথায় কথায় জেনে নিল সেই নির্দিষ্ট ছবিটার প্রসঙ্গে। জানতে পারল ছবিটা কোথায় তোলা হয়েছে। ছুটে গেল বাবার কাছে। বাবার প্রস্তাবে সে রাজি। পুজোর কটা দিন সে বাবা মা ভাইয়ের সাথে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘুরবে আর ডিনারটা বাইরেই সেরে আসবে। নিলাঞ্জনার মনে এখন বাঁধন ছেঁড়া উন্মাদনা।
আজ বহুদিন পরে নিলাঞ্জনার মনে খুব আনন্দ। সকালে ঘুম থেকে উঠে চারপাশটা ওর উজ্জ্বল মনে হতে লাগল। রবি ঠাকুরের গান দু-এক কলি আনন্দে গুনগুন করে গেয়ে উঠল সে। নির্দিষ্ট সময়ে পরিবারের সকলে সেজেগুজে বেড়িয়ে পড়ল পুজা পরিক্রমায়। সারাদিন এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে সন্ধ্যার মুখে একটা শপিং মলের সামনে এসে নিলাঞ্জনা বাবার কাছে ডিনারের জন্য বায়না ধরল।
-- কিন্তু এখনও তো ডিনারের সময় হয়নি মা।
-- আমি আর হাটতে পারছি না বাবা। তাছাড়া এখন পুজোর সময়। যে রেস্টুরেন্টেই ঢোক না কেন, এখন থেকে চেষ্টা করলে লাইন পেতে পেতে তোমার ডিনারের সময় হয়ে যাবে বাবা।
মেয়ের কথায় যুক্তি আছে। অগত্যা বাবা রাজি হল। মেয়েও সবাইকে টেনে নিয়ে গেল কাছের শপিং মলের ভিতরে। একদম টপ ফ্লোরে একটা ফুড কোর্ট আছে। সেখানে বিভিন্ন ছোট বড় রেস্তরাঁ আছে। একটা নির্দিষ্ট রেস্তরাঁয় গিয়ে ঢুকল ওরা। বাবাকেও বোঝাল এটাই সব থেকে ভাল রেস্টুরেন্ট। সে বন্ধুদের মুখে শুনেছে। উজ্জ্বল আলোয় রেস্তরাঁর ভিতরটা যতটা না আলোকিত তার থেকেও বেশি আলোকিত নিলাঞ্জনার মুখ। তার কৌতূহলী চোখ দুটো সারা রেস্টুরেন্টে ঘুরপাক খাচ্ছে। নিলাঞ্জনা যে পজিশনে বসেছিল তার ঠিক পেছনেই এসে দাঁড়াল ওয়েটার। বাবা টেবিলের ওপর রাখা মেনু কার্ডটা এগিয়ে দিল মেয়ের দিকে। রেস্টুরেন্টে খাওয়াদাওয়ার ব্যাপার থাকলে সবসময় নিলাঞ্জনার পছন্দ মতই খাবার অর্ডার করা হয়। আজও তার অন্যথা হল না। নিলাঞ্জনা খাবার পছন্দ করে বাবা কে জানিয়ে দিল। পছন্দের খাবার নিয়ে বাবার সাথে ওয়েটারের কথাবার্তা হতেই নিলাঞ্জনা বুঝে গেল তার ঠিক পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে যে, হ্যাঁ তার জন্যই নিলাঞ্জনার এই রেস্তরাঁয় আসা। গলার স্বর চিনতে একটুও ভুল হয়নি তার। হ্যাঁ, হ্যাঁ, এটাই সৌম্যর গলার স্বর। নিলাঞ্জনার খুব ইচ্ছে করছিল একবার ঘাড় ঘুরিয়ে একটু দেখি। কিন্তু না, ওকে সারপ্রাইজ দিতে হবে। নিলাঞ্জনার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকার দরুন সৌম্য ওকে চিনতে পারলনা। কিছুক্ষন পরে সৌম্য খাবার নিয়ে টেবিলের সামনে আসতেই এবার ওর চোখ পড়ল নিলাঞ্জনার দিকে। চমকে উঠল সৌম্য। চমকে উঠল নিলাঞ্জনা। একি অবস্থা হয়েছে সৌম্যর! চোখেমুখে ফুটে উঠেছে ক্লান্তির ছাপ। ফর্সা মুখটা কেমন ফ্যাকাসে আর শুকনো দেখাচ্ছে। সৌম্যর হাতদুটো কাঁপছে। সে আজ ধরা পরে গেছে। তার অসহায়তার গল্প আর লুকিয়ে রাখা গেল না। লজ্জায় চোখমুখ লাল হয়ে উঠেছে সৌম্যর। নিলাঞ্জনা কি ভাববে? এত সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে! শেষে কিনা আমার মত একজন ওয়েটারের সাথে ………
কিন্তু নিলাঞ্জনা! সে কি ভাবছে? নিলাঞ্জনা যতটা খুশি হবে ভেবেছিল তার থেকেও বেশি আঘাতটা সে আজ পেল। সৌম্যর লড়াইটা আজ সে খুব কাছ থেকে দেখল। ওর ঐ বিধ্বস্ত চেহারাটা নিলাঞ্জনা সহ্য করতে পারছেনা। চারিদিকে সবাই যখন নতুন জামাকাপড় পরে উৎসবের আনন্দে নিজেদের ভাসিয়ে দিয়েছে তখন তার সৌম্য দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করে যাচ্ছে। সৌম্যকে সে চেনে। এত মেধাবী একটা ছেলে। এটা ওর জায়গা হতে পারেনা! নিলাঞ্জনার সামনে টেবিলের উপর সব ভাল ভাল খাবার রাখা আছে। সবকটা পদই মোটামুটি ওর প্রিয়। সৌম্য মাথা নিচু করে নিঃশব্দে নিজের হাতে একটা একটা করে পরিবেশন করে যাচ্ছে। ওকে দেখেই মনে হচ্ছে সারাদিন ছেলেটার হয়ত ঠিকমত খাওয়া হয়নি! নিলাঞ্জনা জানে, এত ভাল ভাল খাবার সৌম্য সারাদিন ঘাঁটাঘাটি করলেও এর একটাও ওর পেটে যায় না। সৌম্যকে দেখে নিলাঞ্জনার খুব মায়া হল। কিন্তু এখানে যে কিছু বলার উপায় নেই। হঠাৎ নিলাঞ্জনার মনে হল ওর ঠিক পাশেই টেবিলের উপর দু ফোঁটা জল পড়ল। আড়চোখে সৌম্যর দিকে তাকাতেই নিলাঞ্জনা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। সৌম্য নীরবে কাঁদছে! যা আর কারও চোখে ধরা পরবে না। নিলাঞ্জনা প্রায় ছুটে চেয়ার ছেড়ে উঠে বেড়িয়ে গেল। সে এখন ওয়াশরুমে। অঝরে কাঁদছে নিলাঞ্জনা। বাইরে উৎসবের আবহে সারা শহর তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে, রেস্তরাঁর ভিতরে দুপ্রান্তে দুটি হৃদয়ে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। নিলাঞ্জনা চোখেমুখে জল দিয়ে ধীর পায়ে বেড়িয়ে এল। নিজের টেবিলে ফিরে আসার পথে সে আর সৌম্য মুখোমুখি। অভিমানী নিলাঞ্জনা শুধু অস্ফুটে বলে উঠল, ‘অসভ্য ছেলে কোথাকার’! সৌম্য অপরাধীর মত মাথা নিচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে। নিলাঞ্জনা দ্রুত পায়ে ফিরে এল খাবার টেবিলের সামনে। সৌম্য এখন কাছে নেই। নিলাঞ্জনার কিচ্ছু ভাল লাগছে না। তার খাওয়ার ইচ্ছেটাই আর নেই। সৌম্য কিছু খায়নি। সে কি করে খায়! বাবাকে সে জানিয়ে দিল কিছু খাবে না। শরীরটা তার ভাল লাগছে না। শুধু সৌম্যর ফেলে যাওয়া দু ফোঁটা অশ্রু নীরবে নিজের মাথায় মুছে নিল। সকলে যখন খাওয়ায় ব্যাস্ত নিলাঞ্জনা তখন ব্যাস্ত ফোনে। সৌম্যর বুক পকেটে রাখা ফোনটা হঠাৎ বেজে উঠে থেমে গেল। সৌম্য ফোনটা বার করে দেখল। একটা লম্বা SMS ।
-- “তুমি না পারলেও আমি পেরেছি সৌম্য। পারলেনা তো নিজেকে লুকিয়ে রাখতে! পুজোর কয়েকটা দিন তোমার সাথে সময় কাটাতে চেয়েছিলাম। সেটা আমি পেরেছি। আজ এসেছি। কাল আসব। তারপরের দিনও আসব। রোজ আসব। পুজোটা এভাবেই শুধু তোমার সাথেই কাটাতে চাই। দেখি তুমি আমায় ছেড়ে কিভাবে লুকিয়ে থাক। তোমায় যে খুব ভালবাসি সৌম্য”।
একটু বেলা করেই ঘুমটা ভাঙ্গল। ভোর রাতে বাড়ি ফিরেছে ছেলেটা। সারাদিনের হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর শরীরটা আর সায় দেয় না। ক্লান্ত বিধ্বস্ত শরীরটা তখন ঐ একটুকরো বিছানাকে খুঁজে বেড়ায়। ছেলেটা যখন কাজের মধ্যে থাকে তখন এক মুহূর্ত দম ফেলার সময় পায় না। নাঃ, আর দেরি করা ঠিক হবে না। দ্রুত তৈরি হতে হবে। দুপুর একটার মধ্যে আবার কাজে যোগ দিতে হবে। সারাদিনের অমানুষিক খাটা খাটুনির পর আবার ভোর রাতে বাড়ি ফেরা। আবার পরদিন বেলা করে ঘুম থেকে ওঠা। তারপর দ্রুত তৈরি হয়ে নিয়ে আবার কাজে যোগ দেওয়া। আগামী কয়েকটা দিন এভাবেই চলবে সৌম্যর। পুরোনাম সৌম্যজিত সাহা, মৃদুভাষী , মেধাবী কলেজের পাশাপাশি সৌম্য পার্ট টাইমে একটি সংস্থায় কর্মরত।। মা-ছেলের ছোট্ট একটা অভাবের সংসার। মাত্র মাস দুয়েক হয়েছে এ কাজে সে জয়েন করেছে। পাশাপাশি সে সমান গুরুত্ব সহযোগে নিজের পড়াশোনাটাও চালিয়ে যাচ্ছে। মেধাবী ছাত্র। কাজটা না করলে সৌম্যকে পড়াশোনায় ইতি টানতে হত। উঁচু ক্লাসের পড়াশোনায় খরচের যা বহর, তাতে সৌম্যর এই কাজটা খুবই প্রয়োজন ছিল। এহেন সৌম্য আবার একটি সম্পর্কে জড়িয়ে পরেছে। মেয়েটি সৌম্যর সঙ্গে একই কলেজে পড়াশোনা করে। তবে সে সৌম্যর থেকে ২ বছরের জুনিয়র। নিজের পারিবারিক এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থার কথা ভেবে প্রথমদিকে সৌম্য এই সম্পর্কের বিষয়ে একটু নিমরাজি ছিল। তারপর যত সময় গড়িয়েছে বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত এবং টানাপড়েনের মধ্যে দিয়ে সম্পর্কটা পরিশেষে একটা মান্যতা পেয়েছে। তাদের দুজনের কথাবার্তা, ঝগড়া, মান-অভিমান, খুনসুটি যাবতীয় কিছু কলেজ ক্যাম্পাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কারন অভাবী সৌম্যর ইচ্ছা থাকলেও তার প্রেয়সীকে বাইরে কোথাও নিয়ে গিয়ে একটু নিরিবিলি সময় কাটাবে সেরকম বিলাসিতা করার মত আর্থিক সামর্থ্য ছিল না। অর্থাৎ সাধ থাকলেও সাধ্য ছিল না বেচারার। সে বহুবার চেষ্টা করেও তার এই অসহায়তার কথা নিলাঞ্জনাকে বলতে পারেনি। প্রতিবারই বলতে গিয়ে মনের মধ্যে কোথাও যেন একটু কুণ্ঠাবোধ হত। নিলাঞ্জনাও সৌম্যর মনের এই অসহায়তার কথা কোনদিন সেভাবে টের পায়নি। সেও অতশত না বুঝে কখনই সৌম্যকে বাইরে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করেনি। বরং সে নিজেও ক্যাম্পাসের মধ্যে মেলামেশা করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ ও নিরাপদ বোধ করত। নিলাঞ্জনার প্রায় সব বন্ধু বান্ধবীরাই একটু আধটু প্রেম টেম করে। ওদের কাছ থেকেই শোনা, বাইরে প্রেম করার অনেক হ্যাপা। কোথাও একটু নিরিবিলি বসে হয়ত গল্প করছে, ব্যাস আশপাশ থেকে জুটে যাবে কিছু বদ ছেলেপুলে। তারপর শুরু হয়ে যাবে তাদের উৎপাত। টাকা দাও নাহলেই বিভিন্ন ভাবে হেনস্থা করবে। কোথাও কোথাও আবার পুলিশের ভয়ও থাকে। তাই প্রেম করার জন্য কলেজের এই ক্যাম্পাসটাই অনেক ভাল। চারপাশে সারাক্ষন বন্ধুবান্ধবরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। তাই এখানেই নিলাঞ্জনা সব থেকে বেশি স্বাচ্ছন্দ এবং নিরাপদ।
সৌম্যকে নিলাঞ্জনা ভীষণ ভালবাসে। ওর আচার ব্যাবহার, ভদ্রতা সর্বোপরি ওর মেধা নিলাঞ্জনাকে বেশ আকর্ষণ করে। নিলাঞ্জনা জানত সৌম্য পড়াশোনার পাশাপাশি কোথাও একটা চাকরি করে। কিন্তু কোথায় করে, কি করে, কত পায় এ ব্যাপারে জানার নিলাঞ্জনার খুব একটা আগ্রহ ছিল না। কিন্তু এবার সেই মিষ্টিমধুর সম্পর্কটায় একটু তাল কাটল। কারনটা আর কিছুই নয়। এই প্রথম নিলাঞ্জনা সৌম্যর কাছে কিছু আবদার করেছিল। খুবই সামান্য ছিল সে চাহিদা। পুজোর পাঁচটা দিন সে সৌম্যর সাথে ঘুরবে। নিরিবিলি কোথাও বসে একটু গল্পগুজব করবে। রেস্তরায় বসে ভালমন্দ খাওয়াদাওয়া করবে। এই প্রথম ওরা একটু বাইরে ঘুরবে। অনেকদিন ধরেই নিলাঞ্জনা এই স্বপ্নটা মনের মধ্যে লালন পালন করে চলেছে।ব্যাপারটা জানলে সৌম্যও নিশ্চয় খুব খুশিই হবে! কিন্তু বিষয়টা সৌম্যকে বলতেই নিলাঞ্জনা বেশ বড়সড় একটা ধাক্কা খেল।
-- সরি নিলু (এ নামেই সৌম্য ওকে ডাকে)! আমার যাওয়া হবে না।
-- কেন!
-- ঐ সময় অফিসে আমার অনেক বেশি কাজ থাকবে।
নিলাঞ্জনা আকাশ থেকে পড়ল। অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল –
-- কাজ! তখন তো তোমার অফিস ছুটি থাকবে।
-- না, আমাদের ছুটি নেই।
-- আমি কখনই তোমার কাছে জানতে চাইনি, তুমি কোথায় চাকরি কর, কি কাজ করো। আজ জানতে ইচ্ছা করছে, তুমি কি এমন অফিসে চাকরি কর যে, পুজর সময়ও তোমার অফিস খোলা!
-- হ্যাঁ মানছি, পুজোর সময় অফিস কাছারি বন্ধ থাকে এটা সত্যি। কিন্তু তাই বলে সবকিছু বন্ধ থাকে না। তুমি কি দেখেছ পুজোর ঐ পাঁচটা দিন রেলের পরিষেবা বন্ধ আছে? তুমি কি দেখেছ ঐ পাঁচটা দিন হাসপাতাল বন্ধ আছে। তুমি কি দেখেছ ঐ পাঁচটা দিন পুলিশ বাড়িতে ঘুমায়? তুমি কি দেখেছ ঐ পাঁচটা দিন বিদ্যুৎ পরিষেবা বন্ধ আছে? এরকম আরও অনেক উদাহরণ আছে নিলু!
-- কিন্তু যেগুলোর কথা তুমি বললে, তার কোনটাতেই নিশ্চয় তুমি চাকরি কর না? তাহলে!
-- অত কৌতূহল ভাল নয়?
সৌম্য আর কোনো কথা না বাড়িয়ে কৌশলে বিষয়টা এড়িয়ে গেল। এরপরেও নিলাঞ্জনা বহুবার সৌম্যকে বোঝাবার চেষ্টা চালিয়ে গেছে। কিন্তু প্রতিবারই সে আশাহত হয়েছে। নিলাঞ্জনা ভীষণভাবে ভেঙ্গে পরেছে। ওর এতদিনকার একটা ছোট্ট স্বপ্ন নিমেষের মধ্যে চুরমার হয়ে গেল। সে এখন কি বলবে, কি করবে কিছুই ভেবে উঠতে পারছে না। পাশাপাশি নিলাঞ্জনার মনের মধ্যে তৈরি হল একটা অজানা আশঙ্কা! সত্যিই তো! সৌম্য কি এমন কাজ করে যেখান পুজোর সময়ও ছুটি থাকে না! না কি ওসব ওর মিথ্যে বাহানা! ও অন্য কারও সঙ্গে কোনরকম সম্পর্কে জড়িয়ে যায়নি তো? কিন্তু সৌম্য তো সেরকম ছেলে নয়! তাহলে সৌম্য কি আমাকে কিছু লুকাচ্ছে? ইত্যাদি... ইত্যাদি.........
নিলাঞ্জনার মন মেজাজ একদম ভাল নেই। আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবের সাথে কথা বলতে গেলেও সামান্য বিষয়ে মেজাজ হারাচ্ছে। সারাটাদিন গুমরে গুমরে থাকে মেয়েটা। ঠিকমত স্নান-খাওয়াদাওয়া হচ্ছে না। ছোট ভাইয়ের সাথেও থেকে থেকে দুর্ব্যবহার করে ফেলছে। যে কিনা নিলাঞ্জনার সব থেকে প্রিয় মানুষ। বিষয়টা বাবার চোখকে এড়াতে পারল না। বাবা তার একমাত্র মেয়ে কে ভীষণ ভালবাসে। মেয়ের এই হঠাৎকরে বদলে যাওয়া, ওর এই ঔদাসিন্য বাবাকে বিচলিত করল। মেয়ের সাথে কথা বলতে হবে। কিছু সমস্যা হয়ে থাকলে ওর মনটাকে হাল্কা করতে হবে। একদিন বাবা একলা ঘরে চুপিচুপি মেয়ের কাছে এসে মাথায় স্নেহের হাত রেখে বলল -
-- কিরে, কি হয়েছে তোর?
-- কিছু না।
-- উঁহু, তা বললে হবে? কিছু তো একটা হয়েছে নিশ্চয়! সারাটাদিন এভাবে গুমরে থাকিস কেন ?
-- বলছি তো কিছু হয় নি?
-- কোন বন্ধুর সাথে ঝগড়া হয়েছে?
-- বাবা, প্লিজ! সত্যি বলছি আমার কিছু হয়নি।
-- আচ্ছা ঠিক আছে। এই শোন পুজোর কটা দিন আমরা যদি বাইরে ঘোরাঘুরি করে রাতের ডিনারটাও বাইরে সারি, তাহলে কেমন হয় বলতো?
মেয়ে চুপ। ফলে বাবার এই প্রস্তাবে মেয়ের সম্মতি অসম্মতি কিছুই বোঝা গেলনা। আরও দুচারটা কথাবার্তার পর বাবা বিদায় নিল। একদিন দুদিন করে ধীরে ধীরে পুজটাও এসে গেল। চারিদিকে আলোর রোশনাই, হৈচৈ। একটা খুশি খুশি ভাব। কিন্তু নিলাঞ্জনার মনে শান্তি নেই। সৌম্য এখন কি করছে, কোথায় আছে? কেন সে আমায় রিফিউজ করল? ও অন্য কোনো মেয়ের সাথে ঘুরতে বের হয়নি তো! ইত্যাদি নানান কুচিন্তা নিয়ে মেয়েটা ঘরেই বসে রইল। কয়েকজন বন্ধু ওকে ডেকেছিল। সবাইকেই ও না বলে দিয়েছে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে নিলাঞ্জনা আপন মনে নিজের মোবাইল ফোনটা ঘেঁটে যাচ্ছে। এখন এইটাই ওর সর্বক্ষণের সঙ্গী বলা যায়। বন্ধুরা সব ঘুরতে বেড়িয়ে বিভিন্ন ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করে যাচ্ছে। আর নিলাঞ্জনার সেগুলো দেখেই সারাটাদিন কেটে যায়। এভাবেই একদিন ফেসবুকে এক বন্ধুর প্রোফাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতে একটা ছবিতে নিলাঞ্জনার চোখ আটকে যায়। তাড়াতাড়ি উঠে বসে নিলাঞ্জনা। একি! এটা কি দেখছে সে! ছবিটাকে জুম করল। হ্যাঁ সে ঠিকই দেখছে। এই দেখাতে কোনো ভুল নেই তার। ছবিটা দেখে নিলাঞ্জনা কষ্ট পেল। নিজের অজান্তেই তার দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। এবার নিলাঞ্জনা সরাসরি ফোন করল সেই বন্ধুকে যার প্রোফাইলে সে ছবিটা দেখেছিল। কথায় কথায় জেনে নিল সেই নির্দিষ্ট ছবিটার প্রসঙ্গে। জানতে পারল ছবিটা কোথায় তোলা হয়েছে। ছুটে গেল বাবার কাছে। বাবার প্রস্তাবে সে রাজি। পুজোর কটা দিন সে বাবা মা ভাইয়ের সাথে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘুরবে আর ডিনারটা বাইরেই সেরে আসবে। নিলাঞ্জনার মনে এখন বাঁধন ছেঁড়া উন্মাদনা।
আজ বহুদিন পরে নিলাঞ্জনার মনে খুব আনন্দ। সকালে ঘুম থেকে উঠে চারপাশটা ওর উজ্জ্বল মনে হতে লাগল। রবি ঠাকুরের গান দু-এক কলি আনন্দে গুনগুন করে গেয়ে উঠল সে। নির্দিষ্ট সময়ে পরিবারের সকলে সেজেগুজে বেড়িয়ে পড়ল পুজা পরিক্রমায়। সারাদিন এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে সন্ধ্যার মুখে একটা শপিং মলের সামনে এসে নিলাঞ্জনা বাবার কাছে ডিনারের জন্য বায়না ধরল।
-- কিন্তু এখনও তো ডিনারের সময় হয়নি মা।
-- আমি আর হাটতে পারছি না বাবা। তাছাড়া এখন পুজোর সময়। যে রেস্টুরেন্টেই ঢোক না কেন, এখন থেকে চেষ্টা করলে লাইন পেতে পেতে তোমার ডিনারের সময় হয়ে যাবে বাবা।
মেয়ের কথায় যুক্তি আছে। অগত্যা বাবা রাজি হল। মেয়েও সবাইকে টেনে নিয়ে গেল কাছের শপিং মলের ভিতরে। একদম টপ ফ্লোরে একটা ফুড কোর্ট আছে। সেখানে বিভিন্ন ছোট বড় রেস্তরাঁ আছে। একটা নির্দিষ্ট রেস্তরাঁয় গিয়ে ঢুকল ওরা। বাবাকেও বোঝাল এটাই সব থেকে ভাল রেস্টুরেন্ট। সে বন্ধুদের মুখে শুনেছে। উজ্জ্বল আলোয় রেস্তরাঁর ভিতরটা যতটা না আলোকিত তার থেকেও বেশি আলোকিত নিলাঞ্জনার মুখ। তার কৌতূহলী চোখ দুটো সারা রেস্টুরেন্টে ঘুরপাক খাচ্ছে। নিলাঞ্জনা যে পজিশনে বসেছিল তার ঠিক পেছনেই এসে দাঁড়াল ওয়েটার। বাবা টেবিলের ওপর রাখা মেনু কার্ডটা এগিয়ে দিল মেয়ের দিকে। রেস্টুরেন্টে খাওয়াদাওয়ার ব্যাপার থাকলে সবসময় নিলাঞ্জনার পছন্দ মতই খাবার অর্ডার করা হয়। আজও তার অন্যথা হল না। নিলাঞ্জনা খাবার পছন্দ করে বাবা কে জানিয়ে দিল। পছন্দের খাবার নিয়ে বাবার সাথে ওয়েটারের কথাবার্তা হতেই নিলাঞ্জনা বুঝে গেল তার ঠিক পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে যে, হ্যাঁ তার জন্যই নিলাঞ্জনার এই রেস্তরাঁয় আসা। গলার স্বর চিনতে একটুও ভুল হয়নি তার। হ্যাঁ, হ্যাঁ, এটাই সৌম্যর গলার স্বর। নিলাঞ্জনার খুব ইচ্ছে করছিল একবার ঘাড় ঘুরিয়ে একটু দেখি। কিন্তু না, ওকে সারপ্রাইজ দিতে হবে। নিলাঞ্জনার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকার দরুন সৌম্য ওকে চিনতে পারলনা। কিছুক্ষন পরে সৌম্য খাবার নিয়ে টেবিলের সামনে আসতেই এবার ওর চোখ পড়ল নিলাঞ্জনার দিকে। চমকে উঠল সৌম্য। চমকে উঠল নিলাঞ্জনা। একি অবস্থা হয়েছে সৌম্যর! চোখেমুখে ফুটে উঠেছে ক্লান্তির ছাপ। ফর্সা মুখটা কেমন ফ্যাকাসে আর শুকনো দেখাচ্ছে। সৌম্যর হাতদুটো কাঁপছে। সে আজ ধরা পরে গেছে। তার অসহায়তার গল্প আর লুকিয়ে রাখা গেল না। লজ্জায় চোখমুখ লাল হয়ে উঠেছে সৌম্যর। নিলাঞ্জনা কি ভাববে? এত সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে! শেষে কিনা আমার মত একজন ওয়েটারের সাথে ………
কিন্তু নিলাঞ্জনা! সে কি ভাবছে? নিলাঞ্জনা যতটা খুশি হবে ভেবেছিল তার থেকেও বেশি আঘাতটা সে আজ পেল। সৌম্যর লড়াইটা আজ সে খুব কাছ থেকে দেখল। ওর ঐ বিধ্বস্ত চেহারাটা নিলাঞ্জনা সহ্য করতে পারছেনা। চারিদিকে সবাই যখন নতুন জামাকাপড় পরে উৎসবের আনন্দে নিজেদের ভাসিয়ে দিয়েছে তখন তার সৌম্য দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করে যাচ্ছে। সৌম্যকে সে চেনে। এত মেধাবী একটা ছেলে। এটা ওর জায়গা হতে পারেনা! নিলাঞ্জনার সামনে টেবিলের উপর সব ভাল ভাল খাবার রাখা আছে। সবকটা পদই মোটামুটি ওর প্রিয়। সৌম্য মাথা নিচু করে নিঃশব্দে নিজের হাতে একটা একটা করে পরিবেশন করে যাচ্ছে। ওকে দেখেই মনে হচ্ছে সারাদিন ছেলেটার হয়ত ঠিকমত খাওয়া হয়নি! নিলাঞ্জনা জানে, এত ভাল ভাল খাবার সৌম্য সারাদিন ঘাঁটাঘাটি করলেও এর একটাও ওর পেটে যায় না। সৌম্যকে দেখে নিলাঞ্জনার খুব মায়া হল। কিন্তু এখানে যে কিছু বলার উপায় নেই। হঠাৎ নিলাঞ্জনার মনে হল ওর ঠিক পাশেই টেবিলের উপর দু ফোঁটা জল পড়ল। আড়চোখে সৌম্যর দিকে তাকাতেই নিলাঞ্জনা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। সৌম্য নীরবে কাঁদছে! যা আর কারও চোখে ধরা পরবে না। নিলাঞ্জনা প্রায় ছুটে চেয়ার ছেড়ে উঠে বেড়িয়ে গেল। সে এখন ওয়াশরুমে। অঝরে কাঁদছে নিলাঞ্জনা। বাইরে উৎসবের আবহে সারা শহর তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে, রেস্তরাঁর ভিতরে দুপ্রান্তে দুটি হৃদয়ে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। নিলাঞ্জনা চোখেমুখে জল দিয়ে ধীর পায়ে বেড়িয়ে এল। নিজের টেবিলে ফিরে আসার পথে সে আর সৌম্য মুখোমুখি। অভিমানী নিলাঞ্জনা শুধু অস্ফুটে বলে উঠল, ‘অসভ্য ছেলে কোথাকার’! সৌম্য অপরাধীর মত মাথা নিচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে। নিলাঞ্জনা দ্রুত পায়ে ফিরে এল খাবার টেবিলের সামনে। সৌম্য এখন কাছে নেই। নিলাঞ্জনার কিচ্ছু ভাল লাগছে না। তার খাওয়ার ইচ্ছেটাই আর নেই। সৌম্য কিছু খায়নি। সে কি করে খায়! বাবাকে সে জানিয়ে দিল কিছু খাবে না। শরীরটা তার ভাল লাগছে না। শুধু সৌম্যর ফেলে যাওয়া দু ফোঁটা অশ্রু নীরবে নিজের মাথায় মুছে নিল। সকলে যখন খাওয়ায় ব্যাস্ত নিলাঞ্জনা তখন ব্যাস্ত ফোনে। সৌম্যর বুক পকেটে রাখা ফোনটা হঠাৎ বেজে উঠে থেমে গেল। সৌম্য ফোনটা বার করে দেখল। একটা লম্বা SMS ।
-- “তুমি না পারলেও আমি পেরেছি সৌম্য। পারলেনা তো নিজেকে লুকিয়ে রাখতে! পুজোর কয়েকটা দিন তোমার সাথে সময় কাটাতে চেয়েছিলাম। সেটা আমি পেরেছি। আজ এসেছি। কাল আসব। তারপরের দিনও আসব। রোজ আসব। পুজোটা এভাবেই শুধু তোমার সাথেই কাটাতে চাই। দেখি তুমি আমায় ছেড়ে কিভাবে লুকিয়ে থাক। তোমায় যে খুব ভালবাসি সৌম্য”।
Comments
Post a Comment