সৌন্দর্য - Never Judge a book by its cover
কলকাতার বিশিষ্ট নিউরো সার্জেন আটত্রিশ বছরের ডঃ নিশান সেন । নিজের পেশেন্ট, হসপিটাল, চেম্বার, কনফারেন্স এসব নিয়ে তুমুল ব্যস্ত একজন মানুষ ।একটা রিসার্চের কাজে দুমাস দেশের বাইরে থাকার জন্য তার চেম্বারে এখন পেশেন্টদের যেন উপচে পড়া ভিড় ।তার দুজন অ্যাসিস্টেন্ট মিলেও সবকিছু সামাল দিতেও হিমশিম খাচ্ছে ।পেশেন্ট দের চাপে তাই গত দুসপ্তাহ হল নিশান কে রবিবার ছুটির দিনটাও ছুটতে হয়েছে হসপিটালে ।এইরকম হাজারো ব্যস্ততার মধ্যে নিশানের সারাটা দিন কেটে যায় । কখন যে দিন শুরু হয় আর কখন যে শেষ হয় মাঝে মধ্যে তাও খেয়াল থাকেনা তার ।নিশানের বাবা মারা গেছেন আজ তিন বছর হল।এখন মা কে নিয়ে সল্টলেকে বাইপাসের কাছে সুসজ্জিত একটি ফ্ল্যাটে থাকে সে।নিশান বরাবরই খুব শৌখিন প্রকৃতির, তাই খুব সুন্দর করে নিজের মনের মতো করে সাজিয়েছে সে এই ফ্ল্যাটটি ।বিদেশ থেকে ফেরার পর একটা রবিবারও সে বাড়িতে ওর মায়ের কাছে থাকতে পারেনি, মায়ের সঙ্গে কথাও হয়েছে হাতেগোনা ।তাই আজ একপ্রকার মায়ের অভিমান ভাঙাতেই নিশানের ছুটি নেওয়া ।আজকের দিনটা মায়ের সঙ্গে গল্প করে, বই পড়ে, টিভি দেখে ,বেশ ছুটির আমেজেই কাটাবে এমনই ঠিক করেছে সে ।
বিকেলের দিকে আবার আলাপী আসছে ওর মা বাবার সঙ্গে।নিশানের সাথে বিয়ের কথা ফাইনাল করতে।আলাপী নিজেও একজন ডাক্তার।অনেক দিনের পরিচয় ওদের দুজনের।মেডিক্যাল কলেজে নিশানের একবছরের জুনিয়র ছিল আলাপী ।
বিয়ের ব্যাপার, তাই মা আজ ভীষণ খুশি ।যুদ্ধকালীন তৎপরতায় হাঁটুর ব্যথা কে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে একাহাতে রান্না ঘরের সবকাজ সামলাচ্ছে ।রাতের মেনুতে মুরগি রেজালা,সরষে ইলিশ,চিংড়ির মালাইকারি, পনির পসন্দ কি নেই!!!
নিশানের হোটেল থেকে খাবার আনাবার কথা প্রথমেই মা নাকচ করে দিয়েছে ।বাড়িতে অতিথি এলে নিজের হাতে রান্না করে খাওয়ানোর মায়ের এই অভ্যাস আজও অপরিবর্তিত ।তাই নিশানও আর বাধা দেয়নি মা কে ।
এদিকে বাড়ির কাজের মেয়ে টা সকাল থেকে শুরু করেছে ঘরদোর ঝাড়পোঁছ অভিযান । তবে সবকিছুই যে তার মায়ের ইনস্ট্রাকশান সেটা নিশান ভালো করে জানে ।তাই অগত্যা সোফায় পা তুলে সে চোখ রেখেছে তার ল্যাপটপ স্ক্রিনে ।
এরইমধ্যে ঘরের একপাশে রাখা ধূলোমাখা কিছু পুরনো জিনিসপত্রের মধ্যে
একটা নীল রঙের অ্যালবাম চোখে পড়ল নিশানের ।অ্যালবাম টা তার আঠারো বছরের জন্মদিনে বাবার দেওয়া উপহার।অ্যালবামটা হাতে নিয়ে গায়ে লেগে থাকা ধূলো ঝেড়ে ওটার পাতাগুলো ওল্টাতে ওল্টাতে হঠাৎ একটা গ্রুপ ছবিতে দৃষ্টি আটকে গেল ওর ।
তখন নিশান ক্লাস 12 এ ।
বড়দিনের দিন কৃষ্ণনগরে সব বন্ধুরা মিলে চার্চের সামনে তোলা একটা ছবি ঊচ্চমাধ্যমিকের টেস্ট পরীক্ষার পরে ।
পায়েল,আঁখি, সৌরভ, রাজীব সবাই আছে ছবিতে আর একপাশে দাঁড়িয়ে খুব ফর্সা ছিপছিপে গড়নের ,খোলা চুলে শর্বরী ।
" দাদাবাবু তোমার ঘর ঝকঝকে করে দিয়েছি ,তুমি এবার নিজের ঘরে গিয়ে বসো দেখি " ।কাজের মেয়েটাকে কোনও উত্তর না দিয়ে নিশান গিয়ে দাঁড়াল নিজের ঘরে খোলা জানলার কাছে ।একটা ছবি যেন ওকে আজ টেনে নিয়ে চলেছে স্মৃতির সরণি দিয়ে কুড়ি টা বছর পিছনে ।
এখন আর নিশানের সঙ্গে পুরনো কোনও বন্ধুরই সেভাবে যোগাযোগ নেই বা বলা যেতে পারে ওর
বাবা কৃষ্ণনগর থেকে ট্রান্সফার হয়ে কলকাতা চলে আসার পর ইচ্ছাকৃত যোগাযোগ রাখেনি সে পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে।
সেইসব পুরনো ঘটনা মনে পড়লে আজও নিশানের খুব কষ্ট হয়,চোখ ভিজে আসে ।
সব বন্ধুদের কাছে কেমন যেন একটা হাস্যকর বস্তু হয়ে গেছিল সেদিন সে।
ছোট থেকেই কো-এড স্কুলে পড়াশোনা নিশানের ।পড়াশোনা তে বরাবরই সে খুব ভালো ছিল।গায়ের রঙ কালো ছিল তাই বাবা, মা নাম রেখেছিল নিশান।
সব বন্ধুদের মধ্যে শর্বরী ছিল ওর বেস্ট ফ্রেন্ড।একসঙ্গে পড়াশোনা, গল্প, আড্ডা, বাড়িতে না বোলে সিনেমা দেখা, টিফিন ভাগ করে খাওয়া এমনকী সিগারেটের প্রথম সুখটানের অভিজ্ঞতাটাও ওই শর্বরীর সঙ্গেই।শর্বরীর ওর বাবার সিগারেটের প্যাকেট থেকে চুরি করে আনা সিগারেট
দিয়ে ।
শর্বরীর সঙ্গে প্রথম পরিচয় টা খুব অদ্ভুত ভাবে হয়েছিল ।একদিন বাংলা দিদিমণি ক্লাসের সকলকে নিজের নিজের নামের মানে বলতে বলায় জানা গেল শর্বরী এবং নিশান এর নামের মানে একই 'রাত্রি ' ।তবে দুজনের নামকরনের কারন টা একেবারে ভিন্ন ।শর্বরীর জন্ম রাত্রি বেলা তাই তার নাম শর্বরী আর নিশানের গায়ের রঙ ছিল কালো তাই ওর ঠাম্মা আদর করে ওর নাম রেখেছিল নিশান ।এসব কথা মনে করে নিজের অজান্তেই ঠোঁটে এক চিলতে হাসি খেলে গেল আজ নিশানের ।
আজও মনে আছে নিশানের
ক্লাস 10 এ শর্বরী যখন একবার খুব অসুস্থ হলো তখন সে নিজে সারা রাত জেগে শর্বরীর জন্য সমস্ত নোটস বানিয়ে দিয়েছিল ।শর্বরীদের আর্থিক অবস্থা তেমন একটা ভালো ছিলনা।কতবার বাড়িতে মিথ্যে কথা বোলে সে তার বাবার কাছে টাকা নিয়ে শর্বরী কে সাহায্য করেছে।শর্বরী ওর কাছে বন্ধুর থেকে হয়তো আরও বেশি কিছু
ছিল ।খুব ভালোবাসত নিশান ,শর্বরী কে ,নিজের থেকেও বেশি।কিন্তু কখনও নিজের মনের কথা সে শর্বরীর কাছে প্রকাশ করতে পারেনি।
তারপর একদিন ক্লাস 12 এর পরীক্ষার পর নিজের মনে অনেক শক্তি সঞ্চয় করে নিশান জানায় নিজের মনের কথা, নিজের ভালোলাগার কথা শর্বরী কে ।সবকিছু জেনে হাসিতে ফেটে পড়েছিল শর্বরী ।
ওকে যে এত খারাপ ভাষায় অপমান করতে পারে শর্বরী তা কল্পনাও করেনি নিশান ।সে নাকি কালো,কুৎসিত তাই কোনও ভাবেই সে শর্বরীর যোগ্য নয়।এটাই বুঝিয়ে দিয়েছিল শর্বরী তাকে সব বন্ধুদের সামনে।খুব অচেনা অজানা লেগেছিল সেদিন শর্বরী কে নিশানের।শর্বরী কে কোনও উত্তর না দিয়েই বাড়ি ফিরে এসেছিল সে ।কারণ তার চোখের জলের মূল্য, তার ভালোবাসার মূল্য শর্বরী যে দেবেনা সেটা সেদিন উপলব্ধি করেছিল নিশান ।এরপর আর কোনও দিন শর্বরীর মুখোমুখি হয়নি সে ।অনেকটা সময় লেগেছিল নিজেকে সামলাতে। নিশানের বাবা সবটাই জানতেন। তাই তার বাবা অফিসে নিজের কলকাতায় ট্রান্সফার টা প্রায় জোর করেই করিয়েছিলেন ছেলের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ।পরীক্ষার রেজাল্টের পর কৃষ্ণনগর ছেড়ে সেই চলে আসা ওদের এই কলকাতায় ।
পুরনো কথা,শর্বরীর কথা, মনে পড়লে আজও নিশানের বুকের ভীতরের কষ্টটা গলার কাছে কেমন যেন দলা পাকিয়ে যায়।
চা টা ঠাণ্ডা জল হয়ে গেছে ।কাজের মেয়েটা কখন চা রেখে গেছে খেয়ালই করেনি নিশান ।ঘড়িতে তখন বেলা
একটা ।
মা ও এদিকে তাড়া দিচ্ছে স্নান সেরে দুপুরে খেয়ে নেবার
জন্য । হঠাত্ অন্যমনস্ক ভাবে মোবাইল ফোনটা হাতে নেয় নিশান।হসপিটাল থেকে দশটা মিসড কল হেড নার্স অপর্ণার। হসপিটাল থেকে খুব এমার্জেন্সি না হলে তাকে কেউ ডিসটার্ব করেনা ছুটির দিনে সচরাচর। নিশান ফোন করে অপর্না কে। হেড নার্স অপর্না জানায় একটা বছর পাঁচেকের বাচ্চা ছেলে তার কাকার বাড়ির ছাদে ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে পড়ে গেছে। মারাত্মক চোট লেগেছে মাথায় ও শিরদাঁড়ায় ।আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে নিশান তখুনি বেরিয়ে যায়। হসপিটালে পৌঁছে সোজা ঢুকে পড়ে অপারেশন থিয়েটারে।একটা ফুটফুটে সুন্দর বাচ্চা শুয়ে আছে অপারেশন টেবিলে ,চোখ দুটো বন্ধ ।
কি নিশ্পাপ মুখ খানা। স্ক্যান রিপোর্টে একবার চোখ বুলিয়ে নিশান শুরু করে অপারেশন ।হসপিটালেরই আরও দুজন জুনিয়র ডাক্তার ওকে অ্যাসিস্ট করে ।অপারেশন যখন শেষ হয় তখন ঘড়িতে রাত এগারোটা।অপারেশন সাকসেসফুল ।জুনিয়র ডাক্তারদের সব বুঝিয়ে দিয়ে নিশান যায় রেস্ট রুমে।সকালের পরে আর কিছুই প্রায় খাওয়া হয়নি ওর খুব ক্লান্ত লাগছে তাই ।
এক কাপ কফির অর্ডার দিয়ে রেস্টরুমের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছিল সে।আলাপী কে এর মাঝে সবকিছু ফোনে জানিয়েছে নিশান ।সে নিজেও একজন ডাক্তার তাই সে খুব ভালোভাবে বোঝে এরকম ইমার্জেন্সি হলে একজন ডাক্তার হিসেবে কি কি করনীয় ।
হঠাৎ রেস্টরুমের বাইরে একটা খুব চেনা গলা, কেউ যেন নিশান বলে ডাকল।নিশান চোখ খুলে দেখে তার সামনে শর্বরী দাঁড়িয়ে।এতগুলো বছর পর আবার দুজনে মুখোমুখি।বিশ্বাস করতে পারছিল না নিশান । খুব বিধ্বস্ত, চুল উসকো খুসকো ,বোঝা যাচ্ছে সাংঘাতিক মানসিক চাপের মধ্যে শর্বরী ।চোখের জল মুছে নিজেকে একটু সামলে নিয়ে সে জানাল ,এতক্ষণ যে বাচ্চাটির অপারেশন করে নিশান যাকে নতুন জীবন দিয়েছে সে শর্বরীর একমাত্র সন্তান ।কলকাতায় কাকার বাড়িতে বেড়াতে এসে এই ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা, সবকিছু শুনে নিশান নির্বাক ।
শর্বরী কে চেয়ারে বসিয়ে জলের গ্লাস এগিয়ে দিল সে ।
শর্বরীর চোখের জলে আজ যেন ধুয়ে মুছে যাচ্ছিল নিশানের মনে জমে থাকা এত বছরের রাগ,অভিমান, গ্লানি সবকিছু ।খুব পরিপূর্ণ মনে হচ্ছিল নিশানের আজ নিজেকে, শর্বরী কোলে তার একমাত্র সন্তানকে ফিরিয়ে দিতে পেরে ।সে যে আজ প্রমাণ করতে পেরেছে মানুষের বাহ্যিক সৌন্দর্য আপেক্ষিক ।
এরইমধ্যে নার্স এসে খবর দেয় আই সি ইউ তে একজন নতুন পেশেন্ট ভর্তি হয়েছে খুব সিরিয়াস ।কথা শেষ না করে মাঝপথেই নিশান ছুটে যায় আই সি ইউ এর দিকে। ঝাপসা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে শর্বরী ।
আজ যে সর্বোপরি নিশানের পরিচয়, সে একজন ডাক্তার, আর মানুষের জীবন বাঁচানো, অসুস্থকে সুস্থ করে তাকে তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দেওয়াটাই
ওর জীবনের একমাত্র ব্রত।।।
Comments
Post a Comment